ঢাকা ০৫:৩৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আল্লাহ যেন আমাদের হেদায়েত করেন ?বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:১৯:২৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ জুন ২০১৫
  • ৫৬৭ বার

আর মাত্র দুই দিন বাকি মুসলিম বিশ্বের সব থেকে কাঙ্ক্ষিত পবিত্র মাস রমজান। প্রত্যেক মুসলমান মাহে রমজানের আশায় সারা বছর উন্মুখ হয়ে থাকে। চেষ্টা করে রমজানে নিজেকে ত্রুটিমুক্ত করতে। মুসলমানমাত্রেই বিশ্বাস করে পবিত্র রমজানে নিজেকে শুদ্ধ করতে না পারলে তার চেয়ে দুর্ভাগা আর কেউ নেই। তাই দয়াময় আল্লাহ যেন আমাদের হেদায়েত করেন, পাপমুক্ত করেন। গত দুই সপ্তাহ কিশোরগঞ্জে ছিলাম। বড় ভালো লেগেছে সেখানে। ভৈরব-কুলিয়ারচর-বাজিতপুর-কটিয়াদী-করিমগঞ্জ-ইটনা-মিঠামইন- কোথায় যাইনি? শেষে পাকুন্দিয়া-হোসেনপুর-গুপ্তবৃন্দাবন হয়ে সাগরদীঘিতে ছিলাম। গুপ্তবৃন্দাবন হিন্দুদের এক পবিত্র তীর্থস্থান। এখনো বলাবলি হয়, গুপ্তবৃন্দাবনের তমালতরু গাছে রাধা-কৃষ্ণ লীলা করেছেন। মানুষের বিশ্বাস উল্টাবে কে? কোথায় অযোধ্যায় কংসের কারাগার? বাসুদেব আর দেবকীর পুত্র শ্রীকৃষ্ণ গোয়ালিনী যশোদা মাইয়ার ঘরে গোকুলে পালিত হয়েছেন। তিনি কবে, কোনকালে ঘাটাইলের সাগরদীঘির গুপ্তবৃন্দাবন এলেন এবং রাধার সঙ্গে লীলা করলেন? মথুরার বৃন্দাবন আর গুপ্তবৃন্দাবন দুটো যে এক নয়, তা হয়তো অনেকেই বুঝতে চান না। তবু শত শত বছরের বিশ্বাস খণ্ডনের প্রয়োজন কী? দুই মাস আগে গুপ্তবৃন্দাবনের পাশে ফুলবাড়িয়ার সোয়াইতপুরে ছিলাম। কিশোরগঞ্জ থেকে ফেরার পথে ভেবেছিলাম গুপ্তবৃন্দাবনের তমালতরুর ছায়ায় কিছু সময় কাটিয়ে আসব। কিন্তু আমাদের দীর্ঘদিনের কর্মী আকরামের কথা গুপ্তবৃন্দাবন আর সোয়াইতপুর খুবই কাছাকাছি। তাই লোহানী সাগরদীঘি প্রাইমারি স্কুল মাঠে থাকলে ভালো হয়। তার কথায়ই সেখানে ছিলাম। রূপা শিকদারের ছেলে লালু, তার ভাতিজা ফজলু মাস্টার, মুক্তিযোদ্ধা আফাজ, ইঞ্জিনিয়ার জামাল, সোবান ও পাগল মোস্তফা কী যে যত্ন করেছে বলে শেষ করা যাবে না। সাগরদীঘিতে কেন যেন বার বার কাশেমের কথা মনে পড়ছিল। একসময়ের রসুলপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাশেম মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি গুলিবিদ্ধ হয়ে আমি যখন গুরুতর আহত হই তখন ডা. শাহাজাদা চৌধুরী, নুরুন্নবী এবং আবুল কাশেম মা ও ছোট ভাইবোনদের নারিন্দার ছারা খালার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। সে জন্য তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। জামাল ইঞ্জিনিয়ার কয়েকবার ফোন করেছিল কিন্তু ধরতে পারিনি। কিন্তু পরদিন সকালে কাশেম এসে যখন জড়িয়ে ধরে তখন এক অপার আনন্দ অনুভব করি। বৃষ্টির কারণে সাগরদীঘিতে খুব কষ্ট হলেও মানুষজনের স্বতঃস্ফূর্ততা বুক ভরিয়ে দিয়েছে। আমাদের দাবি একটাই, সোনার বাংলায় শান্তি চাই। মাঠভরা লোকের সামনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখানে কেউ কি আছেন যে শান্তি চায় না? একজন হাত তুলেছিল তাও আবার বুঝতে পেরে পরে নামিয়ে ফেলে। কে কে শান্তি চায় বললে মাঠশুদ্ধ সবাই হাত তোলে। সেখানে যে সবাই গামছার বা আমাদের সমর্থক ছিল তা নয়। বেশির ভাগই ছিল বড় দুই দলসহ অন্যান্য মত ও পথের। কিন্তু শান্তি সবাই চায়। সাগরদীঘি আসার আগে হোসেনপুর ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে রাত কাটাতে গিয়ে আশপাশের মানুষের যে সাড়া পেয়েছি তা ভোলার নয়। হোসেনপুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী দেখতে, কথা বলতে এসেছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভীষণ আপন করে নিয়েছিল। আমরা যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন শিক্ষিকা মোবাশ্বিরা আক্তার মুক্তার ছিল শুভ জন্মদিন। সে তার স্কুলের সব বাচ্চাকে চকলেট খাইয়েছে, আমাকেও দুটি উপহার দিয়েছে। আমি তো এমনিতেই সব সময় চকলেট বিলাই। তাই আমিও তাকে চকলেট দিয়েছি। হোসেনপুরে ব্রহ্মপুত্রের ওপর কয়েক বছর হলো সেতু হয়েছে। তাতে গফরগাঁও এবং কিশোরগঞ্জের দূরত্ব অনেকটাই কমে গেছে। তাই ভেবেছিলাম ওই রাস্তা দিয়ে ভালুকা হয়ে সাগরদীঘি আসব। কিন্তু সবাই বলছিল রাস্তা খুব খারাপ, যাতায়াতের অযোগ্য। হোসেনপুর থেকে গফরগাঁও ১২ কিলোমিটার, গফরগাঁও থেকে ভালুকা ২০-২১ কিলোমিটার। তাই শেষ পর্যন্ত সেই ভাঙা রাস্তায়ই ধরেছিলাম। রাস্তাটা অবশ্যই খারাপ কিন্তু লোকজন যতটা বলেছে ততটা নয়। দেশব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে কোনো দিনই সকালে ভাত খাইনি। কিন্তু হোসেনপুর থেকে যখন উঠি উঠি করছিলাম তখন পাশের সিংহবাড়ির পঙ্কজ সিংহ এসে আবদার করছিল, ডাল-ভাত রান্না করেছি, একটু মুখে দিয়ে যাবেন। মানুষের মন রাখতে কত কী যে করতে হয়। গিয়েছিলাম সিংহবাড়ি। নয় ভাইয়ের একান্নবর্তী পরিবার। সাতজন এখনো জীবিত। এক একর জায়গার ওপর বিশাল বাড়ি। ডাল-ভাতের কথা বললেও মাছ-ভাত খাওয়াতেও ভোলেনি। অসাধারণ এক সুস্বাদু খাবার। তাদের আতিথেয়তার কথা অনেক দিন মনে থাকবে। একনাগাড়ে প্রায় দুই সপ্তাহ কিশোরগঞ্জের নানা স্থানে ঘুরেফিরে সাগরদীঘিতে ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে কিশোরগঞ্জ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম তারেকের কথা বড় বেশি মনে পড়ছিল। তার ছেলে রিফাতুল ইসলাম দীপ সেই ২৮ জানুয়ারি থেকে আছে। মতিঝিলের ফুটপাথে প্রতিদিন সকালে উঠতেই দেখতাম দেশব্যাপী কর্মসূচিতেও ফজরের নামাজ শেষে তাঁবুর বাইরে প্রতিদিন দীপকে। দীপের মা আরিফা ইসলাম লাকী, বোন শেহরীন তামান্না জ্যোতি সবাই একাকার হয়ে আছে। এমএ পরীক্ষা দেওয়া পরীর মতো সুন্দর মেয়ে গ্রামে গিয়ে পরের ঘরে ঢুকে কারও হাঁড়ি থেকে খাবার আনে? দীপের বোন জ্যোতি শবেবরাতের রাতে তাই করেছে। ভাটগাঁও এক অচেনা বাড়িতে রান্নাঘরে ঢুকে নিজ হাতে হাঁড়ি থেকে যখন আমার জন্য ভাত আনছিল তখন বাড়ির লোকজন বলাবলি করছিল, মেয়েটা পাগল নাকি? সত্যিই কেউ পাগল না হলে অমন করতে পারে? জ্যোতি সত্যিই দেশে শান্তি স্থাপনের মহাসংগ্রামের এক পাগল।

কত হাওর-বাঁওর, পাহাড়-নদী, চর-ভর পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত সখিপুরে এসেছি। এর আগেও একবার পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে গজারিয়ার কীর্তনখোলায় তিন-চার দিন ছিলাম। এবার এসেছি বহেড়াতৈল। বহেড়াতৈল মুক্তিযুদ্ধের এক ঐতিহাসিক পবিত্র স্থান। জীবনে কখন প্রথম বাহেড়াতৈল এসেছিলাম ভালো করে মনে নেই। তবে বাবার হাতের আঙ্গুল ধরে যে এসেছিলাম তা কিছুটা মনে পড়ে। বহেড়াতৈল ফরেস্ট ডাকবাংলোর দক্ষিণে নকিল বিল। আগে শুনতাম ভরের লোক পাহাড়ে এলে ফেরার পথে কলসিতে নকিল বিলের পানি নিয়ে বাড়ি ফিরত। তাদের ধারণা নকিল বিলের পানি মিষ্টি। আগেরকার মানুষ সোজা সরল নির্বিবাদী ছিলেন। তারা পাহাড়ে এসে প্রচুর আমলকী খেতেন। আমলকী খেয়ে পানি খেলে তা সব সময়ই মিষ্টি লাগে। সারা দিন আমলকী খেয়ে যখন বাড়ি ফেরার সময় নকিল বিলের পরিষ্কার পানি মুখে দিতেন দারুণ স্বাদ পেতেন। তাই মিষ্টি পানি মনে করে তুলে নিতেন। বাড়ি গিয়ে আমলকী খেয়ে পানি খেলে হয়তো একই রকম লাগত। কিন্তু এমনিতে যারা খেত তারা পানির স্বাদই পেত, অন্য কিছু পেত না। এক রাতের প্রবল বর্ষণে টইটম্বুর পানিতে নকিল বিলের বিস্তীর্ণ এলাকা সয়লাব হয়ে গেছে। বড় সুন্দর সে মনোরম দৃশ্য। আরও ভালো লেগেছে প্রায় দুই মাস পর বড় মেয়ে কুঁড়ি, এক মাস পর ছোট মেয়ে কুশিসহ দীপ ও তার মাকে পেয়ে। অনেক দিন ওদের দেখিনি, মনটা বড় বেশি হাহাকার করে। কুঁড়ির মুখটা কিছুটা ফেকাসে হয়ে গেছে। অন্যদিকে কুশি আরও বড় হয়েছে, হালকা-পাতলা অসাধারণ। আল্লাহ ওদের সহি-সালামতে নিরাপদে রাখুন, এটাই কামনা করি।

রাতের দিকে ছেলেমেয়ে চলে গেলে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের অন্ধকার সময়গুলো কতবার বহেড়াতৈল এসেছি। কত অচেনা মানুষ চেনা হয়েছে, সাহায্য করেছে। আবার চেনারা জীবন সংহারের কারণ ঘটেছে। কী অমানসিক কষ্টের ভিতর দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিন্তু আজ মুক্তিযোদ্ধাদের কী দুরবস্থা। পদে পদে তারা লাঞ্ছিত-অপমানিত।

আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচার করছেন। প্রায় সব বিচার একই ধরনের। বাবা ছিলেন একজন আইনজ্ঞ। তাই আইন আদালত সম্পর্কে কথা বলতে সব সময় সাবধান থাকি। তবু যেটুকু না বললেই নয় সেটুকুই বলি। মানুষের বিচারের অধিকার একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর। তিনিই করবেন। তার পরও সামাজিক অপরাধের বা দুনিয়ার ভুলত্রুটি বিচারের জন্য মানুষ নিজেরা আদালত করেছে। দুনিয়ায় মানুষ বহু কাজ করেন। কিন্তু বিচারক মস্তবড় ব্যাপার। তাই তাদের ভেবেচিন্তে কাজ করা উচিত। কোনো প্রভাবে বা গোসসা করে কিছু করা উচিত নয়। পরকালে অথবা শেষ বিচারে যারা বিশ্বাস করে না তাদের নিয়ে কথা নেই। সবাই আশা করে আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচার করতে খুব বেশি এদিক-ওদিক যাবেন না, তাদের যে কাজ তাই তারা করবেন। এই তো সেদিন আদালত অবমাননার অভিযোগে একজন নিষ্কলুষ নিষ্কণ্টক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরীকে এক ঘণ্টার জেল এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই অবক্ষয়ের জমানায় অন্তত একজন সাহসী পুরুষ পাওয়া গেল যিনি কোর্টে তার বিবৃতির দায় অকপটে স্বীকার করেছেন এবং সে বিবৃতি জেনে-শুনে সজ্ঞানে দিয়েছেন বলে দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, মুক্তকণ্ঠে আমাদের মতামত ব্যক্ত করার জন্য। আমরা যেমন খেয়ে-পরে বাঁচতে চাই তেমনি আত্দারও খোরাক চাই, মনের বিকাশ চাই, স্বাধীনভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে চাই।

১৮৫৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে মণ্ডল পাণ্ডের মাধ্যমে সিপাহি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। কয়েক বছর নিষ্ঠুর অত্যাচার করে ইংরেজ সেই বিপ্লব দমন করেছিল। শত শত হাজারে হাজারে বিপ্লবীকে রাস্তাঘাটে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের রাস্তার পাশে শত শত বিপ্লবীকে বাবলা গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল। চারদিকে পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লেও ভারতবাসী ফাঁসিতে ঝোলানো তাদের আপনজনের লাশ নামিয়ে মুসলমানদের কবর, হিন্দুদের সৎকার করতে পারেনি। সেদিন ফাঁসিতে যাদের ঝোলানো হয়েছিল তাদের আজও শ্রদ্ধা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ মানুষ স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল তখন ইংল্যান্ডের নিরাপদ জীবন ছেড়ে ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী রণাঙ্গনে ছুটে এসে সাধ্যমতো চিকিৎসা করেছিলেন। ওভাবে চিকিৎসার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে না নিলে কত মুক্তিযোদ্ধা যে বিনা চিকিৎসায় পৃথিবী ছেড়ে চলে যেত তার হিসাব নেই। আমি না হয় রাজনীতি করি, সব সময় সরকারের পক্ষে থাকতে পারি না। বিবেকের তাড়নায় সরকারের জন্য জ্বালার কারণ হয়ে দাঁড়াই। তাই আমাকে না হয় অপমান-অপদস্থ-নাজেহাল করা হয়। কিন্তু ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী তো তেমন নন। তাকে আমাদের যতটা শ্রদ্ধা, সম্মান, গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, তার কানাকড়িও কি দিতে পেরেছি? পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র সখিপুরের বহেরাতৈল অবস্থান কর্মসূচির এক পর্যায়ে রাত কাটাতে গিয়ে শুধু ডা. জাফরউল্লাহর জন্য বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি। এ অবস্থান কর্মসূচিতে আর তেমন কোথাও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেনি। কিন্তু ডা. জাফরউল্লাহর জন্য বহেরাতৈল জীবনে প্রথম তাঁবুতে রাত কাটিয়েও বহেরাতৈলের কথা তেমন লেখা হলো না।

১৯৭১-এর ৯ জুন আমরা কোরআন, গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক স্পর্শ করে শপথ করেছিলাম, জীবন দেব কিন্তু বিনা প্রতিরোধে পাকিস্তানি হানাদারদের যেতে দেব না, দিইওনি। আমাদের সেদিনের শপথ বিফলে যায়নি। আল্লাহর মেহেরবানিতে আমরা জয়ী হয়েছিলাম। দুনিয়ার সবাই জানে লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততায় কাদেরিয়া বাহিনী নামে এক বিশাল বাহিনী গড়ে উঠেছিল। যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে এক লাখ চার হাজার অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম। সেই বহেরাতৈলকে স্মৃতিময় স্মরণীয় করে রাখতে স্মৃতিসৌধ করতে চেয়েছিলাম। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারপ্রধানের নাখোশের কারণে তিনি আসেননি বা আসতে পারেননি। তাই সেটি সেভাবেই পড়ে আছে। দুজন শহীদ যোদ্ধাকে বেতুয়ায় কবর দেওয়া হয়েছিল।

সেখান থেকে তাদের কবর বহেরাতৈল এনে একটি কেন্দ্রীয় কবরস্থান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তা-ও সফল হয়নি। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রকৃত সম্মানজনক কিছু হোক তা অনেকেই চায় না। মুক্তিযুদ্ধে নাম না জানা মানুষের ভূমিকা ছিল প্রবল। ক্ষমতাবান সম্পদশালীরা মুক্তিযুদ্ধে তেমন ভূমিকা রাখেনি বা রাখতে পারেনি। তাই সবাই মুখে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের কথা বললেও প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধের কোনো মহিমা স্থায়ী রূপ পাক তা অন্তর থেকে অনেকেই চায় না। তাই মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্থায়ী স্মৃতি থাকুক তা অনেকেরই কাম্য নয়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

আল্লাহ যেন আমাদের হেদায়েত করেন ?বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

আপডেট টাইম : ০৪:১৯:২৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ জুন ২০১৫

আর মাত্র দুই দিন বাকি মুসলিম বিশ্বের সব থেকে কাঙ্ক্ষিত পবিত্র মাস রমজান। প্রত্যেক মুসলমান মাহে রমজানের আশায় সারা বছর উন্মুখ হয়ে থাকে। চেষ্টা করে রমজানে নিজেকে ত্রুটিমুক্ত করতে। মুসলমানমাত্রেই বিশ্বাস করে পবিত্র রমজানে নিজেকে শুদ্ধ করতে না পারলে তার চেয়ে দুর্ভাগা আর কেউ নেই। তাই দয়াময় আল্লাহ যেন আমাদের হেদায়েত করেন, পাপমুক্ত করেন। গত দুই সপ্তাহ কিশোরগঞ্জে ছিলাম। বড় ভালো লেগেছে সেখানে। ভৈরব-কুলিয়ারচর-বাজিতপুর-কটিয়াদী-করিমগঞ্জ-ইটনা-মিঠামইন- কোথায় যাইনি? শেষে পাকুন্দিয়া-হোসেনপুর-গুপ্তবৃন্দাবন হয়ে সাগরদীঘিতে ছিলাম। গুপ্তবৃন্দাবন হিন্দুদের এক পবিত্র তীর্থস্থান। এখনো বলাবলি হয়, গুপ্তবৃন্দাবনের তমালতরু গাছে রাধা-কৃষ্ণ লীলা করেছেন। মানুষের বিশ্বাস উল্টাবে কে? কোথায় অযোধ্যায় কংসের কারাগার? বাসুদেব আর দেবকীর পুত্র শ্রীকৃষ্ণ গোয়ালিনী যশোদা মাইয়ার ঘরে গোকুলে পালিত হয়েছেন। তিনি কবে, কোনকালে ঘাটাইলের সাগরদীঘির গুপ্তবৃন্দাবন এলেন এবং রাধার সঙ্গে লীলা করলেন? মথুরার বৃন্দাবন আর গুপ্তবৃন্দাবন দুটো যে এক নয়, তা হয়তো অনেকেই বুঝতে চান না। তবু শত শত বছরের বিশ্বাস খণ্ডনের প্রয়োজন কী? দুই মাস আগে গুপ্তবৃন্দাবনের পাশে ফুলবাড়িয়ার সোয়াইতপুরে ছিলাম। কিশোরগঞ্জ থেকে ফেরার পথে ভেবেছিলাম গুপ্তবৃন্দাবনের তমালতরুর ছায়ায় কিছু সময় কাটিয়ে আসব। কিন্তু আমাদের দীর্ঘদিনের কর্মী আকরামের কথা গুপ্তবৃন্দাবন আর সোয়াইতপুর খুবই কাছাকাছি। তাই লোহানী সাগরদীঘি প্রাইমারি স্কুল মাঠে থাকলে ভালো হয়। তার কথায়ই সেখানে ছিলাম। রূপা শিকদারের ছেলে লালু, তার ভাতিজা ফজলু মাস্টার, মুক্তিযোদ্ধা আফাজ, ইঞ্জিনিয়ার জামাল, সোবান ও পাগল মোস্তফা কী যে যত্ন করেছে বলে শেষ করা যাবে না। সাগরদীঘিতে কেন যেন বার বার কাশেমের কথা মনে পড়ছিল। একসময়ের রসুলপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাশেম মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি গুলিবিদ্ধ হয়ে আমি যখন গুরুতর আহত হই তখন ডা. শাহাজাদা চৌধুরী, নুরুন্নবী এবং আবুল কাশেম মা ও ছোট ভাইবোনদের নারিন্দার ছারা খালার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। সে জন্য তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। জামাল ইঞ্জিনিয়ার কয়েকবার ফোন করেছিল কিন্তু ধরতে পারিনি। কিন্তু পরদিন সকালে কাশেম এসে যখন জড়িয়ে ধরে তখন এক অপার আনন্দ অনুভব করি। বৃষ্টির কারণে সাগরদীঘিতে খুব কষ্ট হলেও মানুষজনের স্বতঃস্ফূর্ততা বুক ভরিয়ে দিয়েছে। আমাদের দাবি একটাই, সোনার বাংলায় শান্তি চাই। মাঠভরা লোকের সামনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখানে কেউ কি আছেন যে শান্তি চায় না? একজন হাত তুলেছিল তাও আবার বুঝতে পেরে পরে নামিয়ে ফেলে। কে কে শান্তি চায় বললে মাঠশুদ্ধ সবাই হাত তোলে। সেখানে যে সবাই গামছার বা আমাদের সমর্থক ছিল তা নয়। বেশির ভাগই ছিল বড় দুই দলসহ অন্যান্য মত ও পথের। কিন্তু শান্তি সবাই চায়। সাগরদীঘি আসার আগে হোসেনপুর ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে রাত কাটাতে গিয়ে আশপাশের মানুষের যে সাড়া পেয়েছি তা ভোলার নয়। হোসেনপুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী দেখতে, কথা বলতে এসেছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভীষণ আপন করে নিয়েছিল। আমরা যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন শিক্ষিকা মোবাশ্বিরা আক্তার মুক্তার ছিল শুভ জন্মদিন। সে তার স্কুলের সব বাচ্চাকে চকলেট খাইয়েছে, আমাকেও দুটি উপহার দিয়েছে। আমি তো এমনিতেই সব সময় চকলেট বিলাই। তাই আমিও তাকে চকলেট দিয়েছি। হোসেনপুরে ব্রহ্মপুত্রের ওপর কয়েক বছর হলো সেতু হয়েছে। তাতে গফরগাঁও এবং কিশোরগঞ্জের দূরত্ব অনেকটাই কমে গেছে। তাই ভেবেছিলাম ওই রাস্তা দিয়ে ভালুকা হয়ে সাগরদীঘি আসব। কিন্তু সবাই বলছিল রাস্তা খুব খারাপ, যাতায়াতের অযোগ্য। হোসেনপুর থেকে গফরগাঁও ১২ কিলোমিটার, গফরগাঁও থেকে ভালুকা ২০-২১ কিলোমিটার। তাই শেষ পর্যন্ত সেই ভাঙা রাস্তায়ই ধরেছিলাম। রাস্তাটা অবশ্যই খারাপ কিন্তু লোকজন যতটা বলেছে ততটা নয়। দেশব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে কোনো দিনই সকালে ভাত খাইনি। কিন্তু হোসেনপুর থেকে যখন উঠি উঠি করছিলাম তখন পাশের সিংহবাড়ির পঙ্কজ সিংহ এসে আবদার করছিল, ডাল-ভাত রান্না করেছি, একটু মুখে দিয়ে যাবেন। মানুষের মন রাখতে কত কী যে করতে হয়। গিয়েছিলাম সিংহবাড়ি। নয় ভাইয়ের একান্নবর্তী পরিবার। সাতজন এখনো জীবিত। এক একর জায়গার ওপর বিশাল বাড়ি। ডাল-ভাতের কথা বললেও মাছ-ভাত খাওয়াতেও ভোলেনি। অসাধারণ এক সুস্বাদু খাবার। তাদের আতিথেয়তার কথা অনেক দিন মনে থাকবে। একনাগাড়ে প্রায় দুই সপ্তাহ কিশোরগঞ্জের নানা স্থানে ঘুরেফিরে সাগরদীঘিতে ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে কিশোরগঞ্জ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম তারেকের কথা বড় বেশি মনে পড়ছিল। তার ছেলে রিফাতুল ইসলাম দীপ সেই ২৮ জানুয়ারি থেকে আছে। মতিঝিলের ফুটপাথে প্রতিদিন সকালে উঠতেই দেখতাম দেশব্যাপী কর্মসূচিতেও ফজরের নামাজ শেষে তাঁবুর বাইরে প্রতিদিন দীপকে। দীপের মা আরিফা ইসলাম লাকী, বোন শেহরীন তামান্না জ্যোতি সবাই একাকার হয়ে আছে। এমএ পরীক্ষা দেওয়া পরীর মতো সুন্দর মেয়ে গ্রামে গিয়ে পরের ঘরে ঢুকে কারও হাঁড়ি থেকে খাবার আনে? দীপের বোন জ্যোতি শবেবরাতের রাতে তাই করেছে। ভাটগাঁও এক অচেনা বাড়িতে রান্নাঘরে ঢুকে নিজ হাতে হাঁড়ি থেকে যখন আমার জন্য ভাত আনছিল তখন বাড়ির লোকজন বলাবলি করছিল, মেয়েটা পাগল নাকি? সত্যিই কেউ পাগল না হলে অমন করতে পারে? জ্যোতি সত্যিই দেশে শান্তি স্থাপনের মহাসংগ্রামের এক পাগল।

কত হাওর-বাঁওর, পাহাড়-নদী, চর-ভর পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত সখিপুরে এসেছি। এর আগেও একবার পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে গজারিয়ার কীর্তনখোলায় তিন-চার দিন ছিলাম। এবার এসেছি বহেড়াতৈল। বহেড়াতৈল মুক্তিযুদ্ধের এক ঐতিহাসিক পবিত্র স্থান। জীবনে কখন প্রথম বাহেড়াতৈল এসেছিলাম ভালো করে মনে নেই। তবে বাবার হাতের আঙ্গুল ধরে যে এসেছিলাম তা কিছুটা মনে পড়ে। বহেড়াতৈল ফরেস্ট ডাকবাংলোর দক্ষিণে নকিল বিল। আগে শুনতাম ভরের লোক পাহাড়ে এলে ফেরার পথে কলসিতে নকিল বিলের পানি নিয়ে বাড়ি ফিরত। তাদের ধারণা নকিল বিলের পানি মিষ্টি। আগেরকার মানুষ সোজা সরল নির্বিবাদী ছিলেন। তারা পাহাড়ে এসে প্রচুর আমলকী খেতেন। আমলকী খেয়ে পানি খেলে তা সব সময়ই মিষ্টি লাগে। সারা দিন আমলকী খেয়ে যখন বাড়ি ফেরার সময় নকিল বিলের পরিষ্কার পানি মুখে দিতেন দারুণ স্বাদ পেতেন। তাই মিষ্টি পানি মনে করে তুলে নিতেন। বাড়ি গিয়ে আমলকী খেয়ে পানি খেলে হয়তো একই রকম লাগত। কিন্তু এমনিতে যারা খেত তারা পানির স্বাদই পেত, অন্য কিছু পেত না। এক রাতের প্রবল বর্ষণে টইটম্বুর পানিতে নকিল বিলের বিস্তীর্ণ এলাকা সয়লাব হয়ে গেছে। বড় সুন্দর সে মনোরম দৃশ্য। আরও ভালো লেগেছে প্রায় দুই মাস পর বড় মেয়ে কুঁড়ি, এক মাস পর ছোট মেয়ে কুশিসহ দীপ ও তার মাকে পেয়ে। অনেক দিন ওদের দেখিনি, মনটা বড় বেশি হাহাকার করে। কুঁড়ির মুখটা কিছুটা ফেকাসে হয়ে গেছে। অন্যদিকে কুশি আরও বড় হয়েছে, হালকা-পাতলা অসাধারণ। আল্লাহ ওদের সহি-সালামতে নিরাপদে রাখুন, এটাই কামনা করি।

রাতের দিকে ছেলেমেয়ে চলে গেলে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের অন্ধকার সময়গুলো কতবার বহেড়াতৈল এসেছি। কত অচেনা মানুষ চেনা হয়েছে, সাহায্য করেছে। আবার চেনারা জীবন সংহারের কারণ ঘটেছে। কী অমানসিক কষ্টের ভিতর দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিন্তু আজ মুক্তিযোদ্ধাদের কী দুরবস্থা। পদে পদে তারা লাঞ্ছিত-অপমানিত।

আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচার করছেন। প্রায় সব বিচার একই ধরনের। বাবা ছিলেন একজন আইনজ্ঞ। তাই আইন আদালত সম্পর্কে কথা বলতে সব সময় সাবধান থাকি। তবু যেটুকু না বললেই নয় সেটুকুই বলি। মানুষের বিচারের অধিকার একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর। তিনিই করবেন। তার পরও সামাজিক অপরাধের বা দুনিয়ার ভুলত্রুটি বিচারের জন্য মানুষ নিজেরা আদালত করেছে। দুনিয়ায় মানুষ বহু কাজ করেন। কিন্তু বিচারক মস্তবড় ব্যাপার। তাই তাদের ভেবেচিন্তে কাজ করা উচিত। কোনো প্রভাবে বা গোসসা করে কিছু করা উচিত নয়। পরকালে অথবা শেষ বিচারে যারা বিশ্বাস করে না তাদের নিয়ে কথা নেই। সবাই আশা করে আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচার করতে খুব বেশি এদিক-ওদিক যাবেন না, তাদের যে কাজ তাই তারা করবেন। এই তো সেদিন আদালত অবমাননার অভিযোগে একজন নিষ্কলুষ নিষ্কণ্টক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরীকে এক ঘণ্টার জেল এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই অবক্ষয়ের জমানায় অন্তত একজন সাহসী পুরুষ পাওয়া গেল যিনি কোর্টে তার বিবৃতির দায় অকপটে স্বীকার করেছেন এবং সে বিবৃতি জেনে-শুনে সজ্ঞানে দিয়েছেন বলে দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, মুক্তকণ্ঠে আমাদের মতামত ব্যক্ত করার জন্য। আমরা যেমন খেয়ে-পরে বাঁচতে চাই তেমনি আত্দারও খোরাক চাই, মনের বিকাশ চাই, স্বাধীনভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে চাই।

১৮৫৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে মণ্ডল পাণ্ডের মাধ্যমে সিপাহি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। কয়েক বছর নিষ্ঠুর অত্যাচার করে ইংরেজ সেই বিপ্লব দমন করেছিল। শত শত হাজারে হাজারে বিপ্লবীকে রাস্তাঘাটে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের রাস্তার পাশে শত শত বিপ্লবীকে বাবলা গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল। চারদিকে পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লেও ভারতবাসী ফাঁসিতে ঝোলানো তাদের আপনজনের লাশ নামিয়ে মুসলমানদের কবর, হিন্দুদের সৎকার করতে পারেনি। সেদিন ফাঁসিতে যাদের ঝোলানো হয়েছিল তাদের আজও শ্রদ্ধা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ মানুষ স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল তখন ইংল্যান্ডের নিরাপদ জীবন ছেড়ে ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী রণাঙ্গনে ছুটে এসে সাধ্যমতো চিকিৎসা করেছিলেন। ওভাবে চিকিৎসার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে না নিলে কত মুক্তিযোদ্ধা যে বিনা চিকিৎসায় পৃথিবী ছেড়ে চলে যেত তার হিসাব নেই। আমি না হয় রাজনীতি করি, সব সময় সরকারের পক্ষে থাকতে পারি না। বিবেকের তাড়নায় সরকারের জন্য জ্বালার কারণ হয়ে দাঁড়াই। তাই আমাকে না হয় অপমান-অপদস্থ-নাজেহাল করা হয়। কিন্তু ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী তো তেমন নন। তাকে আমাদের যতটা শ্রদ্ধা, সম্মান, গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, তার কানাকড়িও কি দিতে পেরেছি? পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র সখিপুরের বহেরাতৈল অবস্থান কর্মসূচির এক পর্যায়ে রাত কাটাতে গিয়ে শুধু ডা. জাফরউল্লাহর জন্য বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি। এ অবস্থান কর্মসূচিতে আর তেমন কোথাও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেনি। কিন্তু ডা. জাফরউল্লাহর জন্য বহেরাতৈল জীবনে প্রথম তাঁবুতে রাত কাটিয়েও বহেরাতৈলের কথা তেমন লেখা হলো না।

১৯৭১-এর ৯ জুন আমরা কোরআন, গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক স্পর্শ করে শপথ করেছিলাম, জীবন দেব কিন্তু বিনা প্রতিরোধে পাকিস্তানি হানাদারদের যেতে দেব না, দিইওনি। আমাদের সেদিনের শপথ বিফলে যায়নি। আল্লাহর মেহেরবানিতে আমরা জয়ী হয়েছিলাম। দুনিয়ার সবাই জানে লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততায় কাদেরিয়া বাহিনী নামে এক বিশাল বাহিনী গড়ে উঠেছিল। যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে এক লাখ চার হাজার অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম। সেই বহেরাতৈলকে স্মৃতিময় স্মরণীয় করে রাখতে স্মৃতিসৌধ করতে চেয়েছিলাম। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারপ্রধানের নাখোশের কারণে তিনি আসেননি বা আসতে পারেননি। তাই সেটি সেভাবেই পড়ে আছে। দুজন শহীদ যোদ্ধাকে বেতুয়ায় কবর দেওয়া হয়েছিল।

সেখান থেকে তাদের কবর বহেরাতৈল এনে একটি কেন্দ্রীয় কবরস্থান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তা-ও সফল হয়নি। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রকৃত সম্মানজনক কিছু হোক তা অনেকেই চায় না। মুক্তিযুদ্ধে নাম না জানা মানুষের ভূমিকা ছিল প্রবল। ক্ষমতাবান সম্পদশালীরা মুক্তিযুদ্ধে তেমন ভূমিকা রাখেনি বা রাখতে পারেনি। তাই সবাই মুখে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের কথা বললেও প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধের কোনো মহিমা স্থায়ী রূপ পাক তা অন্তর থেকে অনেকেই চায় না। তাই মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্থায়ী স্মৃতি থাকুক তা অনেকেরই কাম্য নয়।