দৃশ্যত সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর প্রকৃতি গরম থাকলেও বিএনপিতে তীব্র ঠাণ্ডা অবস্থা বিরাজ করছে।
একই সঙ্গে তিন তিন বার রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই দলকে ঘিরে নানা কানাঘুষা চলছে।বিএনপি নেতারাও এক রকম গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে।দলীয় বৈঠকও হচ্ছে না।শোনা যাচ্ছে দলকে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে।তবে দলকে ঠেলে সাজানোর জন্য যে নড়াচড়া দরকার তার ছিটেফোটাও দেখা যাচ্ছে না।
মাঝখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে খালেদার সাক্ষাৎ হবে কি হবে না তা নিয়ে কিছুদিন পরিবেশে উত্তাপ ছড়ালেও মোদির যাওয়ার পর বিএনপি যেন আরও চুপসে গেছে।
কোনো কোন নেতার চেহারা মাঝে মধ্যে মিডিয়ার বদৌলতে দেখা গেলেও আবার লম্বা সময়ের জন্য তারা যেন হারিয়ে যাচ্ছেন।অনেকে দলের গুরুত্বপূর্ন পদ দখল করে থাকলেও এরা এখন
দলের মধ্যে ‘বসন্তের কোকিল’ বলে পরিচিত। পরিস্থিতি বুঝে তারা প্রকাশ্যে আসেন আবার হারিয়ে যান। তবে ‘মাঠে না থেকেও’ এসব নেতার বিরুদ্ধে মামলার কমতি নেই।
ওইসব নেতার সমর্থকদের দাবি, প্রকাশ্যে এলে এদের ‘ক্রসফায়ার’ দেয়া হবে। না হয় গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নির্যাতন করা হবে। এজন্যই তারা আত্মগোপনে আছেন। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা আবারও প্রকাশ্যে আসবেন। আগের মতো দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয় হবেন।
হঠাৎ উদয় আবার হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার তালিকায় বিএনপির স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে নিচের সারির নেতারাও আছেন। বাদ যাননি অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। শোনা যায়, এদের নিয়েই নাকি নেতাকর্মীদের মধ্যে বেশি আতঙ্ক।
স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগের আন্দোলনে যশোরে বেশ সক্রিয় থাকলেও গত তিন মাসে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। যদিও শারীরিকভাবে অসুস্থ এই নেতার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে বেশ কয়েকটি মামলাও হয়েছে।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে আসেন এই প্রবীণ রাজনীতিক। রবিবার হোটেল সোনারগাঁওয়ে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তরিকুল। তবে বৈঠক শেষে তিনি ওইদিন রাতেই যশোর চলে যান। এরপর থেকে বন্ধ রয়েছে তার ব্যক্তিগত মোবাইলফোনটি।
আরেক প্রভাবশালী নেতা মির্জা আব্বাস। ঢাকা মহানগর বিএনপির এই আহ্বায়ক আন্দোলন শুরু হওয়ার পরই আত্মগোপনে গিয়েছিলেন। পরে তিন মাস পর গত ১৩ এপ্রিল জামিন নিতে প্রকাশ্যে আসেন। এরপর আবার হারিয়ে গেছেন। ঢাকায় থাকলেও কোথায় অবস্থান করছেন সে বিষয়ে ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কেউ জানেন না। এর আগে আত্মগোপনে থেকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেন আব্বাস। গত ২৪ মে আগাম জামিনের শুনানিতে অংশ নিতে তার আদালতে যাওয়ার কথা থাকলেও তিনি যাননি।
স্থায়ী কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে নজরুল ইসলাম খানেরও একই অবস্থা। তার ব্যাপারে গুঞ্জন আছে, পরিস্থিতি খারাপ হলে তিনি নির্ধারিত একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। এবারও তার ব্যক্তিক্রম হয়নি।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নজরুল ইসলাম খানের কণ্ঠনালীর ওপরে টিউমারের মতো কিছু একটা ধরা পড়ে। সেখানে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছিল। সোমবার তার অস্ত্রোপচার হয়েছে।
তবে প্রবীণদের চেয়ে আত্মগোপনে এগিয়ে আছেন বিএনপির তরুণ নেতারা। সাবেক ছাত্রনেতাদের মধ্যে খালেদা জিয়া যাদের প্রতি বেশি ভরসা রাখেন তাদেরকে প্রকাশ্যে দেখা যায় না। এমনকি বেশিরভাগই গত আন্দোলনে মাঠে ছিলেন না। তবে দুই একজনকে দলের অনুষ্ঠানে এক ঝলক দেখা গেলেও কারও আবার দেখাই মেলেনি।
যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকলেও সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে প্রকাশ্যে এসেছেন। নিয়মিত দলের কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন। দু্ই দফা আন্দোলনে সেইভাবে মাঠে না থাকলেও এই নেতার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ১১০।
আর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল হঠাৎ এসে হঠাৎ উধাও হয়ে যাচ্ছেন। নাসির উদ্দিন পিন্টুর মৃত্যুর পর তার জানাজা ও দোয়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেও পরক্ষণে তিনি হারিয়ে যান।
আবার কয়েকদিন আত্মগোপনে থেকে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীর দিন অর্থাৎ ৩০ মে তিনি প্রকাশ্যে আসেন। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা সংগঠনের সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপুসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের যান জিয়ার সমাধিতে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পুরোদিন দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণে খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন সোহেল। বর্তমানে আবারও আত্মগোপনে আছেন সাবেক এই ছাত্রনেতা।
সোহেলের বিরুদ্ধে মামলা আছে ১০০। আর সপুর বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ১০৫।
সাবেক ছাত্রদল সভাপতি ও বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী। আন্দোলনের আগে পড়ে দেখা না গেলেও জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে তাকে প্রকাশ্যে দেখা গেছে। ৪০ মামলার আসামি এ্যানীকে ওইদিনের পর আর কোথাও দেখা যায়নি।
এ্যানীর সঙ্গে ওইদিন আরেক ছাত্র নেতা সুলতান সালাহ উদ্দিন টুকুকে দেখা গেলেও এখন আর তার দেখা মিলছে না।
ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে ইদানীং প্রকাশ্যে দেখা গেলেও সাংগঠনিক সম্পাদক প্রকাশ্যে আসা যাওয়ার মধ্যে আছেন। বলা হয়ে থাকে সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়েছে।
তবে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন ১৭৮ মামলার আসামি যুবদল সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরব। আন্দোলনের আগে পড়ে তো দূরের কথা গত ছয় মাসে তাকে কোথাও দেখা যায়নি। অনেকে বলাবলি করেন, তিনি নামে যেমন ‘নীরব’ আন্দোলনেও নীরব।
নীরব সমর্থকদের দাবি, প্রকাশ্যে এলে তাকে তাকে মেরে ফেলা হবে। তাই জীবনহানীর আশঙ্কায় তিনি প্রকাশ্যে আসছেন না।
তবে বিধি বাম। নেতাকর্মীরা খুঁজে না পেলেও সম্প্রতি তাকে ঢাকার রাস্তায় গাড়িতে করে ঘুরতে দেখা গেছে। গত মঙ্গলবার দুপুরের দিকে নীরবকে সাদা রঙের ঢাকা মেট্রো-গ ২৯৭৬৮৫ সিরিয়ালের একটি প্রিমিও গাড়িতে দেখা গেছে। তিনি মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ের সামনে গাড়িতে বসেছিলেন। পাশের গাড়িতে এই প্রতিবেদকসহ বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী ছিলেন। পরে নীরবের সঙ্গে হাই-হ্যালোও হয়। সিগন্যাল ছেড়ে দিলে নীরবের গাড়িটি হারিয়ে যায়।
তবে মজার বিষয় যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের কাছে নীরবের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, “ভাইকে কোথাও পেলে তাকে মেরে ফেলা হবে। তিনি একটু সেইভে আছেন। তাকে পাওয়া যাবে না। প্রকাশ্যে আসেন না।” ওই নেতা তার (নীরব) অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
মূল দল ও অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের এমন লুকোচুরি খেলার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, “আত্মগোপনে যাওয়াটা সন্মানজনক না হলেও নেতারা বাধ্য হচ্ছেন। তবে এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করে।”
আর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, “সবার বিরুদ্ধে মামলা আছে। এদের কেউ আবার সরকারের টার্গেটে আছেন। যাদের প্রতি টার্গেট কম তারা হয়তো মাঝে মাঝে প্রকাশ্যে আসছেন। আর যাদের প্রতি বেশি টার্গেট তারা জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছেন। সেজন্যই তারা প্রকাশ্যে আসছেন না।”