অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই ভালো নেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে বজায় আছে। ডলারের সংকটে আমদানি কমেছে। থামছে না বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের পতন। কেবল ডলারের কারণেই নড়বড়ে অর্থনীতির অনেক সূচক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ পদক্ষেপ বাড়িয়ে দিয়েছে ঋণের সুদ। এসব পদক্ষেপে বেড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে খরচ। ব্যাংক খাতের পরিস্থিতিও নাজুক। এমন এক পরিস্থিতিতে আসছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। তবে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগামী বাজেটে সরকারের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা।
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ‘কেমন বাজেট চাই’—এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতামত জানতে চেয়েছে ইত্তেফাক। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম ইত্তেফাককে বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশকে আরও জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ অর্থনীতি সঠিক গতিতে চললেই সরকার তার কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আহরণ করতে পারবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে একটি জনমুখী ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া বাজার মনিটরিং, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বৃদ্ধি, নতুন বাজার সম্প্রসারণ, ব্যাংক ঋণের সুদহার আর না বাড়ানো, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা আনা, ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বৃদ্ধি, রাজস্বনীতির সংস্কার এবং মুদ্রা ও রাজস্বনীতির মধ্যে সমন্বয় অর্থনীতিতে প্রধান চ্যালেঞ্জ।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার যেন না বাড়ে, সেদিকে নজর দিতে হবে। সুদের হার বাড়লে দেশে শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। ডলারের দাম নিয়ে ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তা এখনো কাটেনি। ডলারের নির্ধারিত দাম ১১৭ টাকা যেন সব ব্যাংক মেনে চলে, সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তদারক করতে হবে। এ ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে বাজেটে নির্দেশনা বা পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতি যাতে নতুন করে না বাড়ে, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। মাহবুবুল আলম বলেন, সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এবারও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে একটি জনমুখী ব্যবসাবান্ধব বাজেট হবে বলে আশা করি।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এসডিজি অর্জন, নির্বাচনি ইশতেহার, স্মার্ট বাংলাদেশ ও ভিশন ২০৪১ সামনে রেখে অর্থনৈতিক পলিসি সমন্বয় করতে হবে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ বিবেচনায় নিয়ে আগামী ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।
মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যাবসায়িক খরচ (কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস) কমিয়ে আনা, বিনিয়োগ সুরক্ষা, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সব ধরনের পরিবহন খরচ হ্রাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে স্থায়ী পরিকাঠামো উন্নয়নে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি কর আদায়ের ক্ষেত্রে হয়রানি ও জটিলতা দূর করে ব্যবসাবান্ধব কর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আগামী বাজেটে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সামষ্টিক অর্থনীতি বিষয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরে শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের সংস্কার করতে হবে। বিনিয়োগের স্বার্থেই সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ও অনুত্পাদনশীল প্রকল্প নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। অর্থ পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ, সহায়ক পলিসি সাপোর্ট, করের আওতা বৃদ্ধি, রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নগদ সহায়তার বিকল্প সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিকল্প সহায়তা হিসেবে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও পরিবহন খাতে প্রণোদনা বা বিশেষ সুবিধা প্রদান করতে হবে।
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বর্তমান মূল্যস্ফীতি এবং নিম্ন আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় বিবেচনায় নিয়ে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ১ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, সিনিয়র সিটিজেন ও নারীদের জন্য ৫ লাখ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেন তিনি। দেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি টিআইএনধারী রয়েছেন। এর মধ্যে আনুমানিক ৩৫ লাখ আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। যাদরে আয় করমুক্ত সীমার ওপরে আছে, তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিলের আওতায় আনতে হবে। এছাড়া শিল্প পরিচালনার ব্যয় কমানোর জন্য আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়করের (এআইটি) হার ধাপে ধাপে কমিয়ে আনতে হবে।