আগামী ৫ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশন শুরু হবে। আর ৬ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বাজেট উপস্থাপন করবেন।
নতুন অর্থবছরে বাজেটের শিরোনাম নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার।’
মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আসন্ন বাজেটের আকার আট লাখ কোটি টাকার মধ্যে রাখা হবে। এ কারণে বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে
সূত্র জানায়, আগামী ৬ জুন যে বাজেট উপস্থাপন করা হবে তাতে চাল ডাল আটা চিনি ডিম মুরগি ও মাছের মতো অত্যাবশ্যকীয় ১৭টি নিত্যপণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ থাকবে। কৃষিজাত পণ্য বিশেষ করে পোল্ট্রি, গবাদি পশু ও মাছের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং আমদানিকৃত পণ্যে শুল্ককর ও ভ্যাট ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব থাকবে।
সূত্র জানায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে সরকারের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বৈশ্বিক সংকটের কথা বিবেচনায় নিয়ে নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়া দ্রব্যমূল্য কমিয়ে নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। এ কারণে বাজেট প্রণয়নে নিত্যপণ্যের দাম কমানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে।
বাজেটে অত্যাবশ্যকীয় ১৭ নিত্যপণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ প্রসঙ্গে সূত্র জানায়,অত্যাবশ্যকীয় ১৭টি পণ্যের বেশির ভাগই আমদানিনির্ভর। অন্যদিকে এসব পণ্যের দেশীয় উৎপাদনেও বীজ, সার, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে বেশ কয়েক বছর ধরেই অত্যাবশ্যকীয় ১৭ ভোগ্যপণ্য সামগ্রী যেমন-চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলা, বুট, ডাল, হলুদ, মরিচ, ভুট্টা, আটা, ময়দা, লবণ, ভোজ্যতেল, চিনি ও সব ধরনের ফল ইত্যাদির সরবরাহ পর্যায়ে উৎসে কর ২ শতাংশ হারে কর্তনে বিধান বাতিল করার প্রস্তাব করে আসছে। এটা করা হলে বাজেট ঘোষণার পরও নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকবে বলে মনে করে এফবিসিসিআই। দেশের বিদ্যমান খাদ্য মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করে ইতোমধ্যে খাদ্য, কৃষি সংশ্লিষ্ট পণ্য ও সারের ওপর কর না বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-কে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এবার বাজেট সামনে রেখে কর ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না করা হলেও নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে কর পুরোপুরি বাতিল করা হতে পারে কিংবা এটি ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এবারের বাজেটে কর ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না হলেও নিত্যপণ্য আমদানিতে বিশেষ ছাড় দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কর ও ভ্যাট কমানোর মতো সুযোগ রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দ্রব্যমূল্য কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। আর এ কারণে কিছু জায়গায় এনবিআর ছাড় দিলে ভোগ্যপণ্যের দাম কমবে সে বিষয়ে চুলচেড়া বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ থাকবে বাজেটে।
এদিকে, আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ কারণে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করে ভোগ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার কৌশল রয়েছে আগামী বাজেটে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সম্প্রতি সচিবালয়ে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এটি বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন সামনে রেখেই বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। আগামী বাজেটে মানুষের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে।
জানা গেছে, নিত্যপণ্য পেঁয়াজের দাম ও আমদানির লাগাম টানতে দেশেই এ পণ্যটির উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে গত দুই বছর ধরে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও এই ধারা বহাল রাখা হবে। এছাড়া ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানিতে শুল্ককর ও ভ্যাট ছাড়ের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে এনবিআর। কৃষির উপ খাত হিসেবে বিশেষ সুবিধা পাবে পোল্ট্রি, মৎস্য ও গবাদি পশুপালন খাত। এ খাতের উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা দেওয়ার মতো কর্মসূচি নেওয়া হবে। এছাড়া সার, বীজ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং আরও কতিপয় শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ এবং ডলার সংকটের কারণে বিশ্বজুড়েই ভোগ্যপণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে বেশিরভাগ ভোগ্যও নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এতে করে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়। আয়ের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে খাদ্যপণ্য কিনতে। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের আগ্রহ-বাজেট খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে কি পদক্ষেপ থাকছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যমতে, গত এপ্রিল মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয় ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা বেশ কঠিন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি
তিনি বলেন, খাদ্যপণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ধান, চাল, পেঁয়াজ, মাছ, পোল্ট্রি ও গবাদি পশু উৎপাদন ও লালন-পালনে সরকারের ভর্তুকি ও প্রণোদনা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে কৃষকদের স্বার্থে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
জানা গেছে, সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে খাদ্যবান্ধক কর্মসূচি অব্যাহত রাখা, খোলা বাজারে চাল-আটা (ওএমএস) বিক্রি কার্যক্রম জোরদার এবং টিসিবির উপকারভোগী বাড়ানো মতো কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে প্রস্তাবিত বাজেটে। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায়ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ থাকছে। একই সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী সার, বীজ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং আরও কতিপয় শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হতে পারে। বিশেষ করে সার, বীজ, কীটনাশক ও নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান প্রধান খাদ্যদ্রব্যের আমদানিতে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখা এবং অন্যান্য নিত্যপণ্যের আমদানিতে প্রযোজ্য শুল্ক-করভার স্থিতাবস্থায় রাখার প্রস্তাব করা হবে।
প্রাণীজ শিল্পের উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং ভোক্তাদের স্বল্পমূল্যে আমিষের সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাঁচামালের আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে আরও কমানো হতে পারে। গো-খাদ্য উৎপাদনে সুগারকেইন মোলাসেস এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গো-খাদ্যের উৎপাদন ব্যয় কমাতে পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে আরও কমিয়ে আনার ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী। এতে পোল্ট্রির খাতের মুরগি ও গবাদি পশু পালন উৎপাদন বাড়বে। এছাড়া মৎস্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতের টেকসই উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে উক্ত খাতের খাদ্যসামগ্রী ও নানাবিধ উপকরণ আমদানিতে বিগত সময়ে প্রদত্ত শূন্য শুল্কহার এবং অন্যান্য হারে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য এবং খাদ্যশস্যের সরবরাহের ওপর কর কমানো উচিত। সিপিডি উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে এ ধরনের কর হ্রাসের পক্ষে অনেক আগে থেকেই কথা বলে আসছে। এর ফলে নিত্যপণ্যের দামে স্বস্তি ফিরে আসবে।
এছাড়া এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে করহার কমানোর জন্য অনুরোধ করছি। এ উদ্যোগ খাদ্য মূল্যস্ফীতি রোধে সহায়ক হবে। আসন্ন বাজেটে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে বিশেষ কিছু জায়গায় কর ও ভ্যাটে ছাড় থাকলেও এবার রাজস্ব আদায়ের আওতা আরও বাড়ানো হচ্ছে।