ব্যাংক একীভূতকরণের প্রভাব: লুটের দায় পরিশোধ করবে গরিব মানুষ ও করদাতা

তড়িঘড়ি করে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংক লুটেরাদের দায় গরিব মানুষ ও করদাতাদের ওপর চাপানো হতে পারে বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, এতে প্রকৃত অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যাবেন।

শনিবার ‘বিপর্যস্ত ব্যাংকিং খাতে ব্যাংক একীভূতকরণের প্রভাব’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা।

ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ ওয়েবিনারের এই ওয়েবনিরের আয়োজন করে। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জার্মান ফেডারেল শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প গবেষক এবং অর্থনীতি গবেষক জিয়া হাসান।

সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে বক্তব্য রাখেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি পলিসি অ্যানালিসিস সেন্টারেরর অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক পরিচালক জ্যোতি রহমান, গ্লোবাল লেবার অর্গানাইজেশন (জিএলও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রধান ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ, গবেষক মাহমুদুল হাসান প্রমুখ।

মূল প্রবন্ধে ব্যাংক একীভূত নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনায় ৬ দুর্বলতাকে চিহ্নিত করলেন উন্নয়ন ও অর্থনীতি গবেষক অধ্যাপক জিয়া হাসান। একই সঙ্গে এর মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকের খারাপ সম্পদ বা মন্দ ঋণের দায় চূড়ান্তভাবে ট্যাক্স পেয়ার বা দরিদ্র জনগণের ওপরে চাপানো হতে পারে বলেও জানান এ অর্থনীতিবিদ।

জিয়া হাসান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংক একীভূতকরণের যে সিদ্ধান্ত সেটা ভালো। তবে উচিত ছিল দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের একীভূত করা। একইভাবে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে ভালো ব্যাংকের মার্জার করা। এখন দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করা হলে সেটার (ভালো) অবস্থাও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। খারাপ ব্যাংকের অনেক দায় রয়েছে।

পদ্মা ব্যাংকের খারাপ ঋণ রয়েছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। দুর্বল ব্যাংকের খারাপ সম্পদ বা মন্দ ঋণের দায় চূড়ান্তভাবে ট্যাক্স পেয়ার বা দরিদ্র জনগণের ওপরে চাপানো হতে পারে। মূল্যস্ফীতি ব্যতীত এত বড় অঙ্কের দায় অর্থনীতি নিতে পারবে না।

জিয়া হাসান মূল বক্তব্যে আরও বলেন, ব্যাংক খাতে খেলাপি কমানো ও সুশাসন ফেরাতে একটি পলিসি নিয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের প্রধান সংকট অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে খেলাপি ঋণ যে বেড়ে গেছে। তা নিরসনে রাজনৈতিকভাবে কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি।

যদিও বাহ্যিকভাবে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জোর করে ব্যাংক একীভূত করা হলে তার দায় ঘুরেফিরে গরীবের ওপরই চাপবে। খেলাপি ঋণ লুকানোর জন্য কৌশল নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন আবার মার্জার সামনে এলো, যা সন্দেহজনক।

তথ্য বলছে, খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ব্যাংকগুলোর মূল সংকট দুর্নীতি। সে কারণে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ২০২২-২৩ সালে ১৩ লাখ কোটি টাকা তারল্য সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এর কারণ খেলাপি ঋণ।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংক একীভ‚তকরণে ছয়টি দুর্বলতা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমত বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো প্রস্তুতি নেই, এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই নিজের আইন ভঙ্গ করেছে। ব্যাংকের সংখ্যা কমানো কার্যকর লক্ষ্য হতে পারে না, মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল কন্সোলিডেশান। দুর্বল ব্যাংকের খারাপ সম্পদ বা মন্দ ঋণের দায় চূড়ান্তভাবে দরিদ্র জনগণের ওপরে চাপানো হতে পারে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে। আবার একই ধরনের প্রডাক্ট পোর্টফলিও এবং ভৌগোলিক ডিফারেন্সিয়েশান না থাকা ব্যাংকগুলোর কোনো স্ট্র্যাটেজিক ভ্যালু নেই। কোনো ধরনের সিনারজি তৈরি হবে না।

উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক জিয়া হাসান আরও বলেন, পদ্মায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ রয়েছে। মূল্যস্ফীতি ব্যতীত এত বড় অঙ্কের দায় অর্থনীতি নিতে পারবে না। জিডিপির সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশে বাংক বেশি, এটা ঠিক। তার মানে এখন আবার ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনার প্রস্তাব যৌক্তি কারণ হতে পারে না।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকিং খাতে যে চলমান সংকট রয়েছে। তার মধ্যে তারল্য সংকট, মূলধন সংকট, দুর্বল সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংকট, ঋণের গুণগত মান ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ার একটা প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকিং খাতে সংস্কার করার চাহিদা অনেক তৈরি হয়েছে। এটা দেরি করার সুযোগ নেই। প্রতিটি দিনই দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।

বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক একীভূত করার একটা রোডম্যাপ তৈরি করেছে। এরই অংশ হিসেবে ১০টি দুর্বল ব্যাংক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভ‚ত করার কথা শোনা যাচ্ছে। তারই অংশ হিসাবে পদ্মা ও এক্সিম ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা জানতে পারছি, ভালো ব্যাংকগুলো চিন্তিত। কারণ ভালো ব্যাংক যারা আছে তারা তো নিয়মকানুন মেনে, কমপ্লায়েন্স মেনে, নানা ধরনের প্রতিকূলতা পার হয়ে তারা ভালো ব্যাংক হয়েছে। ভালো ব্যাংকের সঙ্গে কুখ্যাত ব্যাংকগুলো যে একীভ‚ত হবে এটা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। সেটা নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত।

তিনি বলেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর ঋণ খেলাপির অঙ্ক, ব্যবস্থাপনা ত্রুটিসহ সব সূচকের অবস্থা খারাপ। খেলাপি ঋণটাই তো সবচেয়ে চিন্তার বিষয়। ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ কত? যা প্রকাশ করা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি হবে-এটাই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রকৃত দুর্বল ব্যাংকের সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, প্রভাবশালীদের দুর্বল ব্যাংক এটার তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারে। ব্যাংক মার্জিনের ক্ষেত্রে তারল্য সংকট, প্রযুক্তি, আর্থিক ঝুঁকি, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, মানবসম্পদ এসব বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই বিষয়গুলো দুটো ব্যাংকের একরকম হয় না। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক, বাংলাদেশে শিল্প ঋণ সংস্থার সঙ্গে একীভূত হয়েছিল। একীভূত হয়ে বিডিপিএল হয়। নতুন সত্ত্বা পাওয়ার পরেও এই ব্যাংকটা এখন খারাপ ঋণের ভারে তলিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পদ্মা ব্যাংক আছে রেড জোনে আর এক্সিম ব্যাংক হলুদ জোনে। দুটি ব্যাংকই কম বেশি দুর্বল। দুটি খারাপ ব্যাংক একীভূত হয়ে ভালো ব্যাংক কীভাবে হবে। সে প্রশ্ন রয়ে গেছে।

জ্যোতি রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্জারের পরিকল্পনা বা পিসিএ পারফরমেন্স বেঞ্চের মূল সমস্যায় হাত দেওয়া হয়নি। দুর্বল ব্যাংকের খারাপ সম্পদের দায় কে নেবে। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর দায় নেয় তাহলে এর দায় জনগণের ওপরে পড়বে। এটা মারাত্মক ভুল হবে। আইএমএফসহ সবাই বলছে, মন্দ ঋণ ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে। সরকার ক্ষমতায় এসেই বেশ কয়েকটি ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছিল। ব্যাংক খাতে বিপর্যয় একদিনে আসেনি, দীর্ঘ সময় ধরে এসেছে।

ফারমার্স ব্যাংক থেকে পদ্মা। একদিকে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক ওবায়দুল করিমকে ৬৫০ কোটি টাকা অনিয়মের দায়ে বহু বছর আগে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আবার সরকারের বড় বড় প্রকল্পের কাজও করছেন তিনি। এর দায়ভারও জনগণের ওপরে আসে।

এ প্রসঙ্গে মনির হায়দার বলেন, ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিমকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেন তৎকালীন আদালত। কিন্তু তিনি কি ১৩ ঘণ্টাও জেলে ছিলেন? ছিলেন না।

মনির হায়দার আরও বলেন, মার্জার এর আগেও হয়েছিল। বিসিআই ব্যাংক এরশাদ আমলে হয়। এর পরে ব্যাংক খাতের অবস্থা দেখেছি। এখন ৮ ব্যাংক রেড জোনে, বর্তমানে পদ্মা ব্যাংকে একীভূত করার চুক্তি হয়েছে। এর আগে ফারমার্স ব্যাংক থেকে পদ্মা ব্যাংকে রূপান্তর হয়। পদ্মা ব্যাংককে ঘিরে মোস্তাকের মৃত্যু দেখলাম।

পদ্মা ব্যাংকের মার্জার প্রক্রিয়াটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার মতো মনে হচ্ছে। এর ফল কী হবে, ডুবে যাওয়া ব্যাংককে একীভ‚ত করলে লাভটা কী হবে। কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না।

তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংক ভালো ছিল। সে ভালো ব্যাংকটি থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার লুটপাট হলেও চেয়ারম্যানের কোনো কিছুই হয়নি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর