হাওর বার্তা ডেস্কঃ দিনভর রঙিন ডানার নানান রঙের প্রজাপতি প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিত হলো প্রজাপতি মেলা-২০২৩। প্রজাপতির সংরক্ষণ ও প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে গণসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে প্রতিবছর এ মেলার আয়োজন করা হয়।
দিনব্যাপী এ মেলার আয়োজন শুরু হয় শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) সকাল ১০টায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনের সামনে বেলুন উড়িয়ে মেলার উদ্বোধন করেন জাবি উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম।
‘প্রজাপতি প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গীন পাখা’ বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম হয়তো প্রজাপতির বর্ণিল রঙিন গড়নে মুগ্ধ হয়ে এই গানটি রচনা করেছিলেন। প্রকৃতির একটি অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি এ প্রজাপতি।
রঙে আর বৈচিত্র্যে প্রজাপতির তুলনা প্রজাপতি নিজেই। নান্দনিকতার পাশাপাশি উদ্ভিদের পরাগায়নসহ প্রাকৃতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।
কিন্তু দিনে দিনে কমছে রঙিন ডানার এই পতঙ্গের পরিমাণ। তাই প্রজাপতি সংরক্ষণে গণসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) জাবিতে আয়োজন করা হয় প্রজাপতি মেলার।
‘উড়লে আকাশে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি’- স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের কীটতত্ত্ব শাখার আয়োজনে ১৩তম মেলার আয়োজন করা হয়।
প্রজাপতির বাহারি রঙিন আকৃতি যে কারও মনকে উৎফুল্ল করে তুলে। তাই তো শহরের যান্ত্রিকতা, কোলাহল থেকে থেকে একটুখানি হাফ ছেড়ে বাঁচতে পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু নিয়ে অনেকেই ছুটে এসেছেন প্রকৃতির কোলে রং ছড়ানো এই পতঙ্গটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
মেলা উপলক্ষে দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিশু, কিশোর, তরুণ-তরুণী, বয়োবৃদ্ধসহ হাজার হাজার দর্শনার্থী ভিড় করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত এ ক্যাম্পাসে।
মেলায় দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্যে ছিল শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণে প্রজাপতি বিষয়ক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। শিশু-কিশোররা তাদের রঙিন তুলিতে ফুটিয়ে তোলে প্রজাপতির বিভিন্ন অবয়ব। এতে বিভিন্ন বয়সী প্রায় একশ প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে।
এর আগে অনুষ্ঠিত কুইজ প্রতিযোগিতায় প্রজাপতি বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নে অংশগ্রহণ করে শিশু-কিশোররা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি চত্বরে আয়োজন করা হয় প্রজাপতির আলোকচিত্র প্রদর্শনী। এতে প্রজাপতি নিয়ে নির্বাচিত বেশ কয়েকটি ছবি স্থান পায়।
এছাড়া অন্যান্য আয়োজনের মধ্যে ছিল প্রজাপতির আদলে ঘুড়ি উড্ডয়ন, বারোয়ারি বিতর্ক প্রতিযোগিতা, প্রজাপতি চেনা প্রতিযোগিতা, প্রজাপতি বিষয়ক ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।
সকাল থেকেই কুয়াশার চাদরে মোড়ানো শীতের নিস্তব্ধতাকে উপেক্ষা করে বাড়তে থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়। নগর জীবনের ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পেতে একটুখানি প্রশান্তির আশায় সাভারের নবীনগর থেকে প্রজাপতি মেলা উপভোগ করতে এসেছেন ফজলে রাব্বি। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তার দুই মেয়ে সাবিহা ও রাইসাকে। মেলায় এসে মেয়েরা ভীষণ আনন্দিত। প্রজাপতির হাটে রঙ-বেরঙের প্রজাপতি দেখতে তারা ছোটাছুটি করছে এদিক-ওদিক। তিনি মেয়েদের বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।
ফজলে রাব্বি জানান, ‘ইট-পাথরের শহুরে জীবনে প্রজাপতির দেখা পাওয়া দুর্লভ। ফেসবুকে প্রজাপতি মেলার কথা জানতে পেরে মেয়েদের নিয়ে ছুটে এসেছি। মেয়েরাও পাপেট শো, গান, ছবি আঁকায় চমৎকার সময় পার করেছে।’
মেলার আয়োজনকে ঘিরে শিশু-কিশোরদের পাহাড় সমান আগ্রহ ছিলো চোখে পড়ার মতো। হরেক রকমের প্রজাপতির ওড়াউড়ি শিশু-কিশোরদের মনে সৃষ্টি করে গভীর আলোড়ন। বিচিত্র ও মনোমুগ্ধকর এসব প্রজাপতির পাখা যেন রঙ ছড়াচ্ছে তাদের মনে।
সাভার থেকে বাবার সঙ্গে মেলা দেখতে এসেছেন ছোট রাফসান। বিচিত্র রকমের প্রজাপতি দেখে সে খুবই খুশি। এছাড়াও ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পেরে এবং পাপেট শো দেখে খুবই উচ্ছ্বাসিত দেখা যায় তাকে।
দিনব্যাপী নানা আয়োজনে আমন্ত্রিত অতিথিরা বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন। এবারের আসরে পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলামকে বাটারফ্লাই অ্যাওয়ার্ড-২০২৩ প্রদান করা হয়। এছাড়া প্রজাপতি নিয়ে গবেষণার জন্য চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. জহির রায়হানকে বাটারফ্লাই ইয়াং ইনথুসিয়াস্ট অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়।
মেলা উপলক্ষে প্রজাপতি পার্ক ও গবেষণা কেন্দ্র জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিলো। দিনব্যাপী সেখানে জীবন্ত প্রজাপতি, প্রজাপতিবান্ধব বৃক্ষাদি ও প্রজনন ক্ষেত্রসহ উন্মুক্ত বাগান ঘুরে দেখেন দর্শনার্থীরা।
মেলার আহ্বায়ক এবং জাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জাবিতে একসময় ১১০ প্রজাতির প্রজাপতির দেখা পাওয়া যেত। কিন্তু নগরায়নের ফলে প্রজাপতি তার আবাসস্থল হারাচ্ছে। এখন ক্যাম্পাসে ৫৭ প্রজাতির দেখা মিলে। আমরা বৃক্ষরোপণের ফলে হয়তো বড় বড় গাছ লাগাই, কিন্তু নিচের ঝোঁপঝাড় হচ্ছে প্রজাপতির আবাসস্থল। সেটা একবার নষ্ট হয়ে গেলে আর লাগানো হয় না। ফলে দিন দিন কমছে প্রজাপতির পরিমাণ। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই প্রাণ-প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নূরুল আলম বলেন, ‘প্রজাপতি মেলা সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় আমরা দুটি মাস্টারপ্ল্যান করার চেষ্টা করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি রক্ষায় একটা বায়োডাইভারসিটি প্ল্যান এবং আরেকটি একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। মেলায় প্রজাপতির আদলে যে সব প্রদর্শনী হচ্ছে তা শিশুদের মনেও বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।’ উপাচার্য এসময় দর্শনার্থী, প্রজাপতি বিশেষজ্ঞসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রকৃতি সংরক্ষণে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
প্রজাপতির একেকটি ডানা যেন দক্ষ শিল্পীর তুলির পরশে আঁকা জীবন্ত ছবি। প্রজাপতি শুধু প্রকৃতির সুন্দরের প্রতীকই নয়, উদ্ভিদের পরাগায়ন এবং পরিবেশের মানদণ্ড সূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই আয়োজন থেকে পরিবেশে প্রজাপতি টিকে থাকার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়।