অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমঃ
শ্রদ্ধেয় মা বাবা তোমরা কোথায় আছ, কেমন আছ জানি না।আজকের ২৩শে নভেম্বর, এই দিনে ১৯৯৫ এ তোমাকে হারিয়েছি মা, বাবাকে আরো পাঁচ বছর আগে। আজকে তোমাদের দেখতে এসেছি ঢাকাস্থ বনানী গোড়স্থানে, বি ব্লক,১৮ নম্বর রোড়ে কবর নং১৮৩৮/৮২ ও ১৮৩৯/৮২ এ। তোমাদের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে করছি দোয়া, ক্ষমা ভিক্ষা। মা তোমার পানের ভাটা, জর্দার কৌটা অনেক যত্নে লুকিয়ে রেখেছি। খুললেই তোমার স্নেহ আদরের গন্ধ পাই। বাবা তুমি যে ডায়রীতে লিখতে মনের দুঃখ ব্যাথার কথা।আমার মনে অনেক কষ্ট, সে ডায়রীটা খুঁজে পাই না। ১৮৩৮/৮২ নং বাবার কবরেই আমাকে সমাহিত করার কথা।জানি না সেটা কখন কবে হবে। মহা অন্ধকারে যাওয়ার কথা মনে হলে হাত পা অবশ হয়ে আসে। তারপরও দিতে হবে অন্ধকার পথে পাড়ি। এই হলো বিচিত্র পৃথিবীর খেলা।
ফেইজবুক ফেইজে প্রদর্শিত ছবিতে বাবা মা’র কোলে বসে আছে আমার জঠর নিসৃত দুই ছেলে সন্তান। ২০২৩ সালের কথা বলছি – এখন তারা দুইজনেই ছেলে সন্তানের বাবা হয়েছে। বড় সন্তান কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা,ব্যাংকার । ছোট সন্তান করে সরকারের কামলা হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারিং চাকুরী গণপুর্ত বিভাগে। মা বাবার পর আমি,অতঃপর পরবর্তী প্রজন্ম নেবে চির বিদায়। এই ধারাবাহিকথা থাকবে চলমান। এটাই সৃস্টি ও ধ্বংসের অনিবার্য রীতি নীতি।
বনানি গোড়স্থানে রয়েছে বাঙালির ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত ইতিহাস গাঁথা। যা অন্তর ঝাঁঝরা করে রেখে গেছে ধানমন্ডি বত্রিশ নাম্বারের বুক। সে প্রসঙ্গে আলোকপাত করবো খানিক পরে। এই গোড়স্থানে শুয়ে আছে রতি মহারতি, নামী দামী পূজনীয়, দেশ বরেণ্য বহু জন। তাদের মধ্যে খ্যাত বিখ্যাত বহু জনের নাম ব্যাখ্যা করার ইচ্ছে থাকলেও পারছি না বলে দুঃখিত।
তবে যাদের নাম না বললেই নয়, যেমন প্রয়াত মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, তাঁর স্ত্রী বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামীলীগের প্রয়াত সভাপতি আইভি রহমান, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, মন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এই গোড়স্থানেই ঘুমিয়ে আছেন।তাঁরা তিন জনই ছিলেন কিশোরগঞ্জের মাটি ও গণ মানুষের দেশ বরেণ্য জননেতা। তাদের নাম ইতিহাসে স্বার্ণাক্ষরে লিখা আছে, থাকবে তাদের কৃতকর্ম মাইল ফলক হয়ে।
এখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবও কবরে আছেন শুয়ে। প্রধান ফটকের পাশে বাম পাশে রয়েছে একটি মসজিদ। মসজিদ পেরিয়ে শুরু হয়েছে সারি সারি কবর মালা। তিন বা চার রো এগিয়ে হাতের বাম পাশে রয়েছে আঠারটি কবর একটি দেয়াল ঘেরা বাউন্ডারির ভেতর। ওটা বহন করছে বাঙালির হৃদয় নিংড়ানো শোকের ক্ষত। বঙ্গমাতা আঁচল বিছিয়ে দিয়েছেন স্নেহ আদরের ১৭ টি লাশকে ঠাই।নিজের ৩ পুত্র সন্তান, দুই জন ছেলের বউ,১ জন প্রতিবন্ধি দেবর শেখ নাসের, তৎকালিন যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি,তাঁর স্ক্রী আরজু মণী, সাবেক বৃষকলীগের প্রতিষ্টাতা সভাপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাদসহ তাঁর পরিবারের ৫ সদস্য,আরো নাম না জানাসহ সর্বমোট ১৮ জন।
প্রতি বৎসর শেখ বঙ্গমাতা, শেখ রাসেল, শেখ কামাল ও শেখ জামালের জন্মদিবস উৎযাপন করতে ও ১৫ আগস্টে শোক দিবস পালন করতে, জাতীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ফুলের ডালা হাতে দলীয় নেতৃবৃন্দসহ ছুটে যাই বনানী গোড়স্থানে, জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে শুদ্ধা জানাতে। কেউ কেউ বুক ভিজিয়ে কাঁদে, ফেলে গরম নিঃশ্বাস।প্রশ্ন রেখে বলে- হায় ঘাতক তোরা এতো উন্মাদ ও নির্মম হলে কি করে? কিভাবে কেড়ে নিলে জাতির পিতা ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রাণ। একটুও হাত বা বুক কাঁপলো না।
আমরা জানি – মুসলমান রীতি অনুযায়ী লাশের গোড় দাফন করার পূর্বে লাশ ধুয়াতে হয় ধর্মীয় কায়দায়,সাদা কাপড়ে কাফন পড়ানোর পর আতর, লুবান, সুগন্ধি মাখতে হয়।জানাজা করার পর দোয়া করে কবরে শুয়াতে হয় লাশ শ্রদ্ধা জানিয়ে। দোয়া দরুদ পড়ে জানাতে হয় শেষ বিদায়।অত্যান্ত দুঃখের ও বেদনাময় তথ্য হলো, ঘাতকের বুলেটে নিহত ১৮ টা লাশই তাড়াহুড়া করে রক্তাক্ত জামা কাপড় গায়ে রেখেই মাটি খুড়ে পুতে রাখা হয় কবরে। এই অমার্জনীয় মানবতাহীন, দুঃখ ব্যথা ভুলবো কেমন করে। হায় শোকে গাঁথা মর্মব্যথা।
লেখক ঃ উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য,বাংলাদেশ কৃষকলীগ,কেন্দ্রীয় কমিটি।