ঢাকা ০৬:৩৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রকল্প কাজের প্রতি অনীহা, থাকতে চান মন্ত্রণালয়ে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৪৮:২২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৩
  • ৪৬ বার

মুজাইদুল ইসলাম সেলিম (ছদ্মনাম) উপসচিব হিসেবে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বে আছেন। সম্প্রতি তাকে উন্নয়ন প্রকল্পে পরিচালক (পিডি) হিসেবে সচিবালয়ের বাইরে বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি প্রকল্পের কাজে আগ্রহী নন, সেজন্য জোরালো তদবিরে পদায়নের আদেশ বাতিল করে মন্ত্রণালয়েই রয়ে গেছেন। শুধু সেলিম নয়, বহু কর্মকর্তা মন্ত্রণালয় ছেড়ে প্রকল্পের কাজে যেতে চান না। যার কারণে এক কর্মকর্তাকে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কাজের পাশাপাশি প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বহু প্রকল্পের কাজ চলছে ঢিমেতালে। এতে বছরের পর বছর প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ছে। প্রকল্পের তুলনায় কর্মকর্তার সংখ্যা কম হওয়ায় সমাধানের পথ বেরোয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান ও বাস্তবায়নাধীন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেগাপ্রকল্প দেশের টেকসই অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ভিত্তি মজবুত করে চলেছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী গভীর সমুন্দ্রবন্দর, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, এলিভেটেক এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল, বিমানবন্দরসহ আরো কয়েকটি বড় প্রকল্প দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। কিন্তু ছোট প্রকল্পগুলো কাজে গাফিলতি থাকায় সঠিক সময়ে সম্পন্ন হচ্ছে না। জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সরকারের প্রায় ১ হাজার ৮০০ প্রকল্প রয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের পরিচালকরা অন্য কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না। শুধু প্রকল্প পরিচালকের কাজই করবেন। উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো এবং মানসম্পন্ন বাস্তবায়নের স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কারণ সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকদের অন্য কাজের ব্যস্ততাকে দায়ী করা হয়ে থাকে। মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ থাকায় প্রকল্পে প্রয়োজনীয় সময় এবং মনোযোগ দিতে পারেন না অনেক প্রকল্প পরিচালক। প্রকল্প পরিচালনায় ক্যাডার কর্মকর্তাদের অনীহার থাকায় সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৩টি প্রকল্পের ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়নি। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ৫০ কোটি টাকার বেশি প্রকল্পের পূর্ণকালীন পিডি থাকতে হয়। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পে দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা নেই। আবার দুয়েকটি ক্ষেত্রে উপাচার্যরা আলাদা পিডি নিয়োগ না দিয়ে নিজেরাই প্রকল্প চালাতে চান। যার ফলে প্রকল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে চলতি বছরের ২১ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সই করা মন্ত্রণালয়ের এক সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতির সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম ২৩টি প্রকল্পে পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক না থাকা। অনেক বড় বড় প্রকল্পে পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন আশানুরূপ নয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্পের দায়িত্ব দিলে তিনি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তখন প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়। এতে প্রকল্পের খরচ বাড়ে। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজও শেষ হয় না। এ বিষয়ে গত বছরের ২৯ জুন রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান আক্ষেপ করে বলেন, প্রকল্প পরিচালকরা কর্মস্থলে না থেকে ঢাকায় অবস্থান করেন। পিডি প্রকল্পের জন্য খুবই অপরিহার্য, কিন্তু তাদের আমরা ম্যানেজ করতে পারছি না। প্রকল্প পঞ্চগড়ে অথচ পরিচালক বাস করেন ঢাকায়। সম্প্রতি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা। জাইকার অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর কর্মকাণ্ড এত ধীর যে জাইকার পক্ষে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বয় করতে সমস্যা হচ্ছে।

আইএমইডির ‘২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে সরকারের নেওয়া ২৩৬টি প্রকল্পে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এসব প্রকল্পের অফিস ব্যবস্থাপনা এবং ভাড়া করা গাড়ির খরচ জোগান দিয়ে পার করেছে পুরো অর্থবছর। আবার ৯৪টি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে কোনো টাকাই খরচ করতে পারেনি। এর বাইরেও ৫৫৪টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন যেটুকুই হয়েছে তাও সন্তোষজনক নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে দক্ষ, যোগ্য, দায়িত্বশীল কর্মকর্তার অভাব রয়েছে। এছাড়াও জেলা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কাজের পাশাপাশি অতিরিক্ত কাজ হিসেবে প্রকল্পের কাজ করছেন। এতে সুষ্ঠুভাবে কোনো কাজেই গতি ফিরছে না। বিশেষকরে- সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নেওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সারা দেশে প্রকল্পগুলোর একই দশা। এভাবে বাস্তবায়ন পিছিয়ে থাকলে প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে থাকবে। কেননা সম্প্রতি রড, সিমেন্টসহ সব পণ্যের দাম ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। সেই সঙ্গে প্রকল্প পরিচালকসহ সব জনবলের বেতনভাতাসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাড়ছে। যদিও এসব প্রকল্প কম গুরুত্বপূর্ণ।

৫০ কোটির বেশি টাকার কোনো প্রকল্পে একজন পূর্ণকালীন পিডি নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। একজন কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্পের পিডি না করার বিষয়টিও স্পষ্ট করে বলা আছে। সরকারি নিয়মে, একাধিক প্রকল্পে এক কর্মকর্তাকে পিডি নিয়োগের সুযোগ নেই। ২০০৯ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের ১৬(৩৬) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ৫০ কোটি টাকার বেশি প্রকল্পে একজন পূর্ণকালীন পিডি নিয়োগ করতে হবে। ১৬(৩৭) অনুচ্ছেদে বলা হয়, এক কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্পের পিডির দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। কিন্তু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশনা বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষিত হয়ে আসছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারের ১ হাজার ৭০০’র অধিক প্রকল্প চলমান। প্রকল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও ব্যুরো আছে। যেখানে পিডি, মহাপরিচালক ও চেয়ারম্যান পদগুলো যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিবের পদোমর্যার।

তিনি আরো বলেন, বড় প্রকল্পগুলোর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব দায়িত্বে আছেন। আবার কিছু ছোট ছোট প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক উপ-সচিব। তবে প্রকল্পে চ্যালেঞ্জ রয়েছে- যেখানে ঠিকাদার নিয়োগ, যন্ত্রপাতি কেনাকাটাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয়। সেখানে ইঞ্জিনিয়াররা প্রকল্পের কাজ করতে অভ্যস্ত, ফলে ক্যাডার কর্মকর্তারা প্রকল্পে যেতে চান না। পদোন্নতি কিংবা বদলির ক্ষেত্রে সচিবালয়ের ভেতরে এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয় থাকার চিন্তা-ভাবনা করেন। প্রকল্পের কাজে যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের অনীহা কেন? এ প্রশ্নে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব (এপিডি অনুবিভাগ) আব্দুস সবুর মন্ডল আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটা কর্মকর্তাদের নিজস্ব, কেউ সচিবালয়ে থাকতে চায়, কেউ থাকতে চায় না। অনেকে মাঠ প্রশাসনে রয়েছে। সুতরাং প্রকল্পে কেউ যেতে চায় না, তা নয়। কিছু কিছু কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত কারণে প্রকল্পে যেতে চায় না। একেক জন একেকভাবে ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করে’। তিনি আরো বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে জেলা-উপজেলায় হাজার হাজার কর্মকর্তা রয়েছে। আবার অনেক কর্মকর্তা মাঠ থেকে মন্ত্রণালয়ে আসতে চায় না। প্রকল্পগুলোয় যেতে বিশেষ অভিজ্ঞা ও প্রশিক্ষণ লাগে, অনেকের সেই অভিজ্ঞা নেই। সেজন্য যেতে চায় না। ইঞ্জিনিয়াররা প্রকল্পে যেতে বেশি আগ্রহী, কারণ তারা এটি ভালো বোঝে’।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রকল্প কাজের প্রতি অনীহা, থাকতে চান মন্ত্রণালয়ে

আপডেট টাইম : ১১:৪৮:২২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৩

মুজাইদুল ইসলাম সেলিম (ছদ্মনাম) উপসচিব হিসেবে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বে আছেন। সম্প্রতি তাকে উন্নয়ন প্রকল্পে পরিচালক (পিডি) হিসেবে সচিবালয়ের বাইরে বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি প্রকল্পের কাজে আগ্রহী নন, সেজন্য জোরালো তদবিরে পদায়নের আদেশ বাতিল করে মন্ত্রণালয়েই রয়ে গেছেন। শুধু সেলিম নয়, বহু কর্মকর্তা মন্ত্রণালয় ছেড়ে প্রকল্পের কাজে যেতে চান না। যার কারণে এক কর্মকর্তাকে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কাজের পাশাপাশি প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বহু প্রকল্পের কাজ চলছে ঢিমেতালে। এতে বছরের পর বছর প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ছে। প্রকল্পের তুলনায় কর্মকর্তার সংখ্যা কম হওয়ায় সমাধানের পথ বেরোয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান ও বাস্তবায়নাধীন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেগাপ্রকল্প দেশের টেকসই অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ভিত্তি মজবুত করে চলেছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী গভীর সমুন্দ্রবন্দর, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, এলিভেটেক এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল, বিমানবন্দরসহ আরো কয়েকটি বড় প্রকল্প দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। কিন্তু ছোট প্রকল্পগুলো কাজে গাফিলতি থাকায় সঠিক সময়ে সম্পন্ন হচ্ছে না। জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সরকারের প্রায় ১ হাজার ৮০০ প্রকল্প রয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের পরিচালকরা অন্য কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না। শুধু প্রকল্প পরিচালকের কাজই করবেন। উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো এবং মানসম্পন্ন বাস্তবায়নের স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কারণ সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকদের অন্য কাজের ব্যস্ততাকে দায়ী করা হয়ে থাকে। মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ থাকায় প্রকল্পে প্রয়োজনীয় সময় এবং মনোযোগ দিতে পারেন না অনেক প্রকল্প পরিচালক। প্রকল্প পরিচালনায় ক্যাডার কর্মকর্তাদের অনীহার থাকায় সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৩টি প্রকল্পের ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়নি। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ৫০ কোটি টাকার বেশি প্রকল্পের পূর্ণকালীন পিডি থাকতে হয়। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পে দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা নেই। আবার দুয়েকটি ক্ষেত্রে উপাচার্যরা আলাদা পিডি নিয়োগ না দিয়ে নিজেরাই প্রকল্প চালাতে চান। যার ফলে প্রকল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে চলতি বছরের ২১ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সই করা মন্ত্রণালয়ের এক সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতির সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম ২৩টি প্রকল্পে পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক না থাকা। অনেক বড় বড় প্রকল্পে পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন আশানুরূপ নয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্পের দায়িত্ব দিলে তিনি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তখন প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়। এতে প্রকল্পের খরচ বাড়ে। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজও শেষ হয় না। এ বিষয়ে গত বছরের ২৯ জুন রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান আক্ষেপ করে বলেন, প্রকল্প পরিচালকরা কর্মস্থলে না থেকে ঢাকায় অবস্থান করেন। পিডি প্রকল্পের জন্য খুবই অপরিহার্য, কিন্তু তাদের আমরা ম্যানেজ করতে পারছি না। প্রকল্প পঞ্চগড়ে অথচ পরিচালক বাস করেন ঢাকায়। সম্প্রতি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা। জাইকার অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর কর্মকাণ্ড এত ধীর যে জাইকার পক্ষে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বয় করতে সমস্যা হচ্ছে।

আইএমইডির ‘২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে সরকারের নেওয়া ২৩৬টি প্রকল্পে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এসব প্রকল্পের অফিস ব্যবস্থাপনা এবং ভাড়া করা গাড়ির খরচ জোগান দিয়ে পার করেছে পুরো অর্থবছর। আবার ৯৪টি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে কোনো টাকাই খরচ করতে পারেনি। এর বাইরেও ৫৫৪টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন যেটুকুই হয়েছে তাও সন্তোষজনক নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে দক্ষ, যোগ্য, দায়িত্বশীল কর্মকর্তার অভাব রয়েছে। এছাড়াও জেলা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কাজের পাশাপাশি অতিরিক্ত কাজ হিসেবে প্রকল্পের কাজ করছেন। এতে সুষ্ঠুভাবে কোনো কাজেই গতি ফিরছে না। বিশেষকরে- সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নেওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সারা দেশে প্রকল্পগুলোর একই দশা। এভাবে বাস্তবায়ন পিছিয়ে থাকলে প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে থাকবে। কেননা সম্প্রতি রড, সিমেন্টসহ সব পণ্যের দাম ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। সেই সঙ্গে প্রকল্প পরিচালকসহ সব জনবলের বেতনভাতাসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাড়ছে। যদিও এসব প্রকল্প কম গুরুত্বপূর্ণ।

৫০ কোটির বেশি টাকার কোনো প্রকল্পে একজন পূর্ণকালীন পিডি নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। একজন কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্পের পিডি না করার বিষয়টিও স্পষ্ট করে বলা আছে। সরকারি নিয়মে, একাধিক প্রকল্পে এক কর্মকর্তাকে পিডি নিয়োগের সুযোগ নেই। ২০০৯ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের ১৬(৩৬) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ৫০ কোটি টাকার বেশি প্রকল্পে একজন পূর্ণকালীন পিডি নিয়োগ করতে হবে। ১৬(৩৭) অনুচ্ছেদে বলা হয়, এক কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্পের পিডির দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। কিন্তু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশনা বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষিত হয়ে আসছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারের ১ হাজার ৭০০’র অধিক প্রকল্প চলমান। প্রকল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও ব্যুরো আছে। যেখানে পিডি, মহাপরিচালক ও চেয়ারম্যান পদগুলো যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিবের পদোমর্যার।

তিনি আরো বলেন, বড় প্রকল্পগুলোর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব দায়িত্বে আছেন। আবার কিছু ছোট ছোট প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক উপ-সচিব। তবে প্রকল্পে চ্যালেঞ্জ রয়েছে- যেখানে ঠিকাদার নিয়োগ, যন্ত্রপাতি কেনাকাটাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয়। সেখানে ইঞ্জিনিয়াররা প্রকল্পের কাজ করতে অভ্যস্ত, ফলে ক্যাডার কর্মকর্তারা প্রকল্পে যেতে চান না। পদোন্নতি কিংবা বদলির ক্ষেত্রে সচিবালয়ের ভেতরে এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয় থাকার চিন্তা-ভাবনা করেন। প্রকল্পের কাজে যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের অনীহা কেন? এ প্রশ্নে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব (এপিডি অনুবিভাগ) আব্দুস সবুর মন্ডল আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটা কর্মকর্তাদের নিজস্ব, কেউ সচিবালয়ে থাকতে চায়, কেউ থাকতে চায় না। অনেকে মাঠ প্রশাসনে রয়েছে। সুতরাং প্রকল্পে কেউ যেতে চায় না, তা নয়। কিছু কিছু কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত কারণে প্রকল্পে যেতে চায় না। একেক জন একেকভাবে ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করে’। তিনি আরো বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে জেলা-উপজেলায় হাজার হাজার কর্মকর্তা রয়েছে। আবার অনেক কর্মকর্তা মাঠ থেকে মন্ত্রণালয়ে আসতে চায় না। প্রকল্পগুলোয় যেতে বিশেষ অভিজ্ঞা ও প্রশিক্ষণ লাগে, অনেকের সেই অভিজ্ঞা নেই। সেজন্য যেতে চায় না। ইঞ্জিনিয়াররা প্রকল্পে যেতে বেশি আগ্রহী, কারণ তারা এটি ভালো বোঝে’।