ঢাকা ১২:৫২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ২৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অষ্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী আশুরা পালন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০২:৪৪:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ জুন ২০১৬
  • ৪১৯ বার

কিশোরগঞ্জে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পবিত্র আশুরা পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় নানা কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়। জেলার হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামে ব্যাতিক্রমধর্মী আশুরা পালিত হয় অনেক আগে থেকে। তবে প্রতিবারের মতো এবারও ঐতিহ্যবাহী মহরম পালন করেছেন অষ্টগ্রামবাসী।

আশুরা উপলক্ষে এই এলাকার মানুষ মহরমের ১ম দিন থেকেই রোজা রাখা শুরু করে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ১০ মহরম সন্ধ্যায় তাবু পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে এর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। এই বিজ্ঞানের যুগে যখন গ্রামীন সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে তখন ঐতিহ্য হিসেবে নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে দিনটি পালনে ভুল হয়না অষ্টগ্রামবাসীর। যুগ যুগ ধরে দিনটিকে ঘিরে সহজ-সরল এই হাওরবাসীর যেন উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি নেই কোথাও। হাওরের এই মানুষগুলো সাংস্কৃতিক আবহে ধর্মীয় এ অনুষ্ঠানটি পালনের জন্য ব্যাপক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

পহেলা মহররম থেকে ১২ মহররম পর্যন্ত অষ্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপকভাবে যেসব আচার অনুষ্ঠান ও শোক পালন করা হয় তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত মহররম অনুষ্ঠানের মতো নয়। এটি শিয়াদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও অষ্টগ্রামে যারা এ অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত তারা সবাই সুন্নী মুসলমান। কিন্তু তাদের আচার আচরণে শিয়াদের মতই। তাছাড়া হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও এতে অংশ নেয়। প্রতি বছরের মতো এ বছরও সাড়ম্বরে মহররম উৎসব উদযাপিত হয়েছে।
অষ্টগ্রাম সদর উপজেলার দেওয়ানবাড়ি বা আঞ্চলিক উচারণে হাবিলী বাড়িকে কেন্দ্র করেই মহররম অনুষ্ঠানটি উদযাপন করা হয়। রীতি অনুযায়ী মহররমের চাঁদ দেখার আগের রাত থেকেই হাবেলী বাড়ির ইমামবারাকে রঙ-বেরঙের কাগজ ও কাপড়ের ছোট বড় অসংখ্য পতাকায় সাজানো হয়।

চাঁদ দেখার পরদিন থেকে আশুরার আগের দিন পর্যন্ত সমগ্র অষ্টগ্রামে চলে জারি গান, শিরনী তৈরি ও বিতরণ, দরগায় তাবু তৈরি, বাড়ি বাড়ি তাজিয়া তৈরি আর বাদ্য বাজনা সহযোগে মাতম জারি পরিবেশন। অপরদিকে পাল ও মালাকার সম্প্রদায় দুলদুল বা মাটির ঘোড়া ও কাগজের বোরাক ইত্যাদি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে ৯ই মহররম পর্যন্ত সমগ্র অষ্টগ্রামে চলতে থাকে প্রস্তুতিপর্ব। ১০ই মহররম উদযাপিত হয় মূল অনুষ্ঠান। অষ্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি মহল্লাতেই একটি করে মহররমের স্থায়ী দরগা দেখা যায়। দরগাগুলো সাধারণত উঁচু স্থানে মাটি ভরাট করে অনেকটা বেদীর মতো তৈরি করা হয়। অষ্টগ্রামের পূর্ব প্রান্তে হাটখোলা নামক স্থানে রয়েছে উঁচু একটি মাঠ। এ মাঠটিই কারবালা নামে পরিচিত। আশুরার রাত থেকেই পরদিন রাত ৮টা পর্যন্ত প্রতিটি দরগার সামনে চলে শোক ও মাতম জারি।

প্রতিটি পরিবারেই তৈরি করা হয় মহররমের বিশেষ শিরনী। জারিয়াল দল বড় বড় দা, লাঠি, বল্লম, লেজা, তরবারি, বর্শা, ঢাল ও বিশেষ পোশাকে সজ্জিত হয়ে ঢাক, ঢোল, কাঁসি, সানাই ইত্যাদি বাদ্য বাজনাসহ শোক ও মাতম জারি গাইতে গাইতে মহল্লা প্রদক্ষিণ করে। মহল্লা প্রধানের নেতৃত্বে এ দলগুলো মিছিল সহকারে যায় হাবেলী বাড়িতে। সেখানে প্রতিটি দল ইমামবারায় ও স্থানীয় মাজারটি একবার প্রদক্ষিণ করে নির্ধারিত স্থানে গিয়ে জারি গান গায়। পরদিন দুপুরের পর থেকে শুরু হয় তাবু ও দুলদুল মিছিল, ল্য কারবালা ময়দান। সন্ধ্যায় শোক, মাতম ও জারি গান হয়। সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে সবাই সেখানে জমায়েত হয় এবং রাত ৮ টা পর্যন্ত চলে তাবু, দুলদুল, তাজিয়া উৎসর্গ এবং মাতম জারি গান। ১০ মহররমের পরে ১১ মহররম সকাল ৯টা থেকে মহিলা জারিয়াল দল ও গ্রামের সাধারণ মহিলাদের সমাবেশে কারবালা ময়দানটি জমজমাট হয়ে উঠে। ১২ মহররম সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে সম্মিলিত মাতম ও জারি। পরে ২২শে মহরম বাঁশ-বেত ও কাগজের তৈরী তাবুগুলোর অবশিষ্ট অংশগুলোকে জ্বালানী করে পোড়াঁনো হয়। এই দিন হাটখোলা মাঠে (কারবালার মাঠ) একটি ওরশ মোবারক অনুষ্ঠিত হয়। এই ওরশকে বলা হয় ২২শে মহরমের ওরশ, আঞ্চলিকভাবে বলা “বাইশ্যা মহরম”। এই ওরশের মাধ্যমেই শেষ হয় অষ্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আশুরা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

অষ্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী আশুরা পালন

আপডেট টাইম : ০২:৪৪:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ জুন ২০১৬

কিশোরগঞ্জে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পবিত্র আশুরা পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় নানা কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়। জেলার হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামে ব্যাতিক্রমধর্মী আশুরা পালিত হয় অনেক আগে থেকে। তবে প্রতিবারের মতো এবারও ঐতিহ্যবাহী মহরম পালন করেছেন অষ্টগ্রামবাসী।

আশুরা উপলক্ষে এই এলাকার মানুষ মহরমের ১ম দিন থেকেই রোজা রাখা শুরু করে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ১০ মহরম সন্ধ্যায় তাবু পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে এর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। এই বিজ্ঞানের যুগে যখন গ্রামীন সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে তখন ঐতিহ্য হিসেবে নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে দিনটি পালনে ভুল হয়না অষ্টগ্রামবাসীর। যুগ যুগ ধরে দিনটিকে ঘিরে সহজ-সরল এই হাওরবাসীর যেন উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি নেই কোথাও। হাওরের এই মানুষগুলো সাংস্কৃতিক আবহে ধর্মীয় এ অনুষ্ঠানটি পালনের জন্য ব্যাপক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

পহেলা মহররম থেকে ১২ মহররম পর্যন্ত অষ্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপকভাবে যেসব আচার অনুষ্ঠান ও শোক পালন করা হয় তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত মহররম অনুষ্ঠানের মতো নয়। এটি শিয়াদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও অষ্টগ্রামে যারা এ অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত তারা সবাই সুন্নী মুসলমান। কিন্তু তাদের আচার আচরণে শিয়াদের মতই। তাছাড়া হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও এতে অংশ নেয়। প্রতি বছরের মতো এ বছরও সাড়ম্বরে মহররম উৎসব উদযাপিত হয়েছে।
অষ্টগ্রাম সদর উপজেলার দেওয়ানবাড়ি বা আঞ্চলিক উচারণে হাবিলী বাড়িকে কেন্দ্র করেই মহররম অনুষ্ঠানটি উদযাপন করা হয়। রীতি অনুযায়ী মহররমের চাঁদ দেখার আগের রাত থেকেই হাবেলী বাড়ির ইমামবারাকে রঙ-বেরঙের কাগজ ও কাপড়ের ছোট বড় অসংখ্য পতাকায় সাজানো হয়।

চাঁদ দেখার পরদিন থেকে আশুরার আগের দিন পর্যন্ত সমগ্র অষ্টগ্রামে চলে জারি গান, শিরনী তৈরি ও বিতরণ, দরগায় তাবু তৈরি, বাড়ি বাড়ি তাজিয়া তৈরি আর বাদ্য বাজনা সহযোগে মাতম জারি পরিবেশন। অপরদিকে পাল ও মালাকার সম্প্রদায় দুলদুল বা মাটির ঘোড়া ও কাগজের বোরাক ইত্যাদি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে ৯ই মহররম পর্যন্ত সমগ্র অষ্টগ্রামে চলতে থাকে প্রস্তুতিপর্ব। ১০ই মহররম উদযাপিত হয় মূল অনুষ্ঠান। অষ্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি মহল্লাতেই একটি করে মহররমের স্থায়ী দরগা দেখা যায়। দরগাগুলো সাধারণত উঁচু স্থানে মাটি ভরাট করে অনেকটা বেদীর মতো তৈরি করা হয়। অষ্টগ্রামের পূর্ব প্রান্তে হাটখোলা নামক স্থানে রয়েছে উঁচু একটি মাঠ। এ মাঠটিই কারবালা নামে পরিচিত। আশুরার রাত থেকেই পরদিন রাত ৮টা পর্যন্ত প্রতিটি দরগার সামনে চলে শোক ও মাতম জারি।

প্রতিটি পরিবারেই তৈরি করা হয় মহররমের বিশেষ শিরনী। জারিয়াল দল বড় বড় দা, লাঠি, বল্লম, লেজা, তরবারি, বর্শা, ঢাল ও বিশেষ পোশাকে সজ্জিত হয়ে ঢাক, ঢোল, কাঁসি, সানাই ইত্যাদি বাদ্য বাজনাসহ শোক ও মাতম জারি গাইতে গাইতে মহল্লা প্রদক্ষিণ করে। মহল্লা প্রধানের নেতৃত্বে এ দলগুলো মিছিল সহকারে যায় হাবেলী বাড়িতে। সেখানে প্রতিটি দল ইমামবারায় ও স্থানীয় মাজারটি একবার প্রদক্ষিণ করে নির্ধারিত স্থানে গিয়ে জারি গান গায়। পরদিন দুপুরের পর থেকে শুরু হয় তাবু ও দুলদুল মিছিল, ল্য কারবালা ময়দান। সন্ধ্যায় শোক, মাতম ও জারি গান হয়। সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে সবাই সেখানে জমায়েত হয় এবং রাত ৮ টা পর্যন্ত চলে তাবু, দুলদুল, তাজিয়া উৎসর্গ এবং মাতম জারি গান। ১০ মহররমের পরে ১১ মহররম সকাল ৯টা থেকে মহিলা জারিয়াল দল ও গ্রামের সাধারণ মহিলাদের সমাবেশে কারবালা ময়দানটি জমজমাট হয়ে উঠে। ১২ মহররম সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে সম্মিলিত মাতম ও জারি। পরে ২২শে মহরম বাঁশ-বেত ও কাগজের তৈরী তাবুগুলোর অবশিষ্ট অংশগুলোকে জ্বালানী করে পোড়াঁনো হয়। এই দিন হাটখোলা মাঠে (কারবালার মাঠ) একটি ওরশ মোবারক অনুষ্ঠিত হয়। এই ওরশকে বলা হয় ২২শে মহরমের ওরশ, আঞ্চলিকভাবে বলা “বাইশ্যা মহরম”। এই ওরশের মাধ্যমেই শেষ হয় অষ্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আশুরা।