আজ থেকে ঠিক ৬০ বছর আগে, ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগে আমি শিক্ষকতা শুরু করি। ২০০৭-এ অবসরে গিয়েই দায়িত্ব নিতে হয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান পদে। মাঝে আশির দশকে চার বছর ব্যাংককে এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এআইটি) অধ্যাপনা করেছি। স্বভাবতই দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে দেশে ও বিদেশে বহু ছাত্রছাত্রীকে কাছ থেকে জানার সুযোগ হয়েছে। এদের কেউ কেউ ছিলেন অসাধারণ মেধাবী, তাদের রীতিমতো সমীহ করেই চলতে হতো, কেউ কেউ খুবই ব্যতিক্রমী, নিয়ম মেনে চলা তাদের স্বভাববিরুদ্ধ।
আমার একেবারে প্রথম ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে, প্রথমবর্ষ সম্মান ক্লাসের, একজন পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দীর্ঘ সময়ের জন্য ডাকসাইটে মন্ত্রী ছিলেন, তার দলের শীর্ষ নেতাও ছিলেন (আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কথা বলছি)। স্বাধীনতার পর প্রথম দিকের এক ছাত্র বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদ। দুজনেই আমার খুব প্রিয়। চৌকশ মেধাবীদের অনেকে দেশে-বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যাপনায় সুনাম অর্জন করেছেন। একাধিক ছাত্রছাত্রী উপাচার্য পদ অলংকৃত করেছেন। সচিবও হয়েছেন কয়েকজন। তাদের একজন, মো. আনিসুর রহমান, এখন নির্বাচন কমিশনার। কিন্তু ওই যে প্রথমেই বলেছি, একবারে অন্যরকম ছাত্রও দু-একজন ছিলেন। সেরকম একজন শাইখ সিরাজ। সত্তরের দশকের শেষদিকের ছাত্র ছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলে কথা, তার মতো ব্যতিক্রমী ছাত্রকেও তার প্রকৃত মেধা বিকাশে সুযোগ করে দিয়েছে। সিরাজ (আমি তাকে সবসময় এ নামেই ডেকেছি) তার ছাত্রকালীন সময় একাধারে ছিলেন বিজ্ঞান অনুষদের একজন ফুলটাইম ছাত্র, জনপ্রিয় খাবারের দোকানের উদ্যোক্তা-পরিচালক ও সাংবাদিক। নিজের মতো করে তিনি সবকিছু ম্যানেজ করেছেন। প্রসঙ্গত আমার মনে পড়ছে, আমি যখন ঢাকা কলেজে আইএসসির ছাত্র তখন (১৯৫৬-৫৮) গণিত (অতিরিক্ত) বিষয়ের ক্লাসে উপস্থিতি কম থাকায় আমি ২০০ নম্বরের পরীক্ষাই দিতে পারিনি (ভাগ্য ভালো, তা সত্ত্বেও প্রথম বিভাগ পেয়েছিলাম)।
সিরাজকে ভূগোল বিভাগের শিক্ষকরা, আমরা, এতটাই ভালোবাসতাম যে, তার ছাত্রত্ব বজায় রাখা খুব কঠিন হয়নি। পরে জেনেছি তার সতীর্থ বন্ধুরাও তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করত। পরীক্ষার আগে হলে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে তিনি গভীর রাত পর্যন্ত প্রস্তুতি নিতেন। অবশ্য তাদের জন্য নিজেদের দোকানের উপাদেয় পিঠা আনতে ভুলতেন না। তার প্রতি আমার মধ্যে পক্ষপাত ছিল, তবে তার অনিয়ম নিয়ে মাঝে মাঝে ক্লাসে তীর্যক মন্তব্য যে করিনি তা কিন্তু নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর কয়েক বছরের মধ্যেই ছাত্র সিরাজ আমার শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। তিনি যে আমার সরাসরি ছাত্র ছিলেন একথা বলতে অহংকার হয়। আমিও যে তার পছন্দের মানুষ, নানাভাবে তা উপলব্ধি করি। চ্যানেল আই টিভি শুরু থেকেই নানা অনুষ্ঠানে আমাকে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমি তাতে সাড়া দিয়েছি। সিরাজের এই যে এখন ৭০ বছরে পদার্পণ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সম্মাননা সংকলনের সম্পাদনার দায়িত্ব পালনে আমাকে আহ্বান করা হয়েছে, এটা অবশ্যই আমার প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধেরই পরিচায়ক। আমি আপ্লুত।
সিরাজ ও আমার দুজনেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীত বিষয় ছিল ভূগোল-অর্থাৎ পৃথিবীতে পরিবেশ ও মানুষের সহাবস্থান পর্যালোচনা করা-কীভাবে মানুষ পরিবেশকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগায়, আবার একইসঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশকে অক্ষত রাখে, তা বোঝার চেষ্টা করা। সিরাজ বেছে নিয়েছেন আমাদের জীবনের একেবারেই মৌলিক বিষয়-কৃষি, তথা খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যের নানা প্রসঙ্গ। শিল্পী এসএম সুলতান যেমন চিহ্নিত করেছিলেন আদি উৎপাদক কৃষককে-নারী ও পুরুষ উভয়কে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনও কৃষক, জেলে ও শ্রমিককে তার চিত্রকর্মে প্রধান বিষয় করেছিলেন। সাহিত্যিকদের অনেকেই এমনটি করেছেন।
সিরাজের মতো আমিও ভূগোলবিদ, তবে মূলত তাত্ত্বিক। আমার প্রধান আলোচ্য বিষয় মানুষের বাস্তু-সৃজন কলা, বিশেষত নগর কিংবা গ্রাম জনপদ বিন্যাস চর্চা। আমিও মাঠে ঘাটে যাই, অসংখ্যবার গিয়েছি; শহরের শ্রমজীবী মানুষ, বিশেষ করে বস্তিবাসী মানুষ কীভাবে জীবনযাপন করেন, বুঝতে চেয়েছি। বিশ্লেষণভিত্তিক জ্ঞান জাতীয় নীতিমালায় কাজে লাগিয়েছি। অবশ্যই সিরাজ আর আমার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। সিরাজ কৃষকের, বৃহৎ অর্থে মৌলিক উৎপাদকের একেবারে আপন মানুষ। আমি অনাত্মীয় বিশ্লেষক। অথচ আমারও জন্ম গ্রামীণ পরিবেশে, পিতামহ ছিলেন শিক্ষিত সম্পন্ন কৃষক। সিরাজ আর আমার জন্মস্থান মেঘনা নদীর ওপার ও এপার। সিরাজের জন্ম বর্তমান চাঁদপুরের হাইমচরে, মেঘনার পূর্ব পারে, আমার জন্ম মেঘনার পশ্চিম পার শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের চরাঞ্চলে।
হাজার ব্যস্ততার মাঝেও সিরাজ তার প্রথম জীবনের সাংবাদিকতার লিখিত মাধ্যমকে শক্তিশালী দক্ষতায় কাজে লাগান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সিরাজের আনুষ্ঠানিক নাম ছিল সিরাজুল ইসলাম, সাংবাদিক-লেখক পর্বের প্রথম দিক থেকেই কলম-নাম গ্রহণ করেন ‘শাইখ সিরাজ’। পরে এ নামেই তার খ্যাতি। সিরাজের গণমাধ্যমে ব্যবহৃত ভাষা অত্যন্ত পরিশীলিত, বাচনভঙ্গি আকর্ষণীয়। তার ‘করোনাকালে বহতা জীবন’ শীর্ষক ৩৬০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি এক অসাধারণ সাহিত্যকর্ম। বিটিভির ‘মাটি ও মানুষ’, আবার চ্যানেল আই’র ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’র শাইখ সিরাজ বস্তুতই এক ব্যতিক্রমী উন্নয়ন সাংবাদিক, এক অসাধারণ মানুষ ও কৃতী বাঙালি। সিরাজের আলোচিত কৃষক এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের নানা দেশের। কৃষির নানা দিক নিয়ে তার সৃজনশীল প্রতিবেদন। বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষি খাত আরও অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে, এমনটাই বলেন তিনি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রে যে বিস্ময়কর উন্নয়ন, তাতে এদেশের কৃষক, সরকার, কৃষি গবেষকদের অবদানের পাশাপাশি একজন শাইখ সিরাজের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য।
মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ‘একুশে পদক’ (১৯৯৫) লাভ এবং পরিণত পর্যায়ে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ (২০১৮) অর্জন শাইখ সিরাজের যথার্থ মূল্যায়ন বলেই আমি মনে করি। তবে এর চেয়ে বড় অর্জন নিশ্চয়ই তার প্রতি বাংলাদেশের কৃষক তথা খেটে খাওয়া মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আমি এক সময় সিরাজের শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক ছিলাম এ কথা মনে করে যথার্থই গর্ববোধ করি। আজ থেকে প্রায় এক দশক আগে আমার জীবনের ৭৫ বছরপূর্তি পালনে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম। সিরাজ শতবর্ষী হোন এই কামনা করি।
মাঝে মাঝে টিভিতে সংবাদ সম্মেলনে দেখি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাইখ সিরাজকে কী স্নেহ ও শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। বঙ্গবন্ধু এই শাইখকে পেলে যে বুকে জড়িয়ে ধরতেন, তা ভাবতেই পারি। তিনি এরকম একজন কৃষি প্রেমিককেই তো চাইতেন। ‘তোমরা খাদ্য উৎপাদন বাড়াও’, বারবার বলতেন বঙ্গবন্ধু। সে কাজে জোর সমর্থন ও প্রেরণা জোগাচ্ছেন শাইখ সিরাজ, উন্নয়ন সাংবাদিকতার এক অনন্য উদাহরণ। নোবেল পুরস্কার কমিটি সিরাজের প্রতি নজর রাখতেই পারে।
নজরুল ইসলাম : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান; নগরবিদ ও শিল্প সমালোচক