চট্টগ্রামের আলোচিত মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার সাক্ষী ও বাবুল আক্তারের বাসার দারোয়ান আবদুস ছাত্তার মোল্লা আদালতে বলেছেন, পলাতক আসামি কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল স্যারের বাসায় মাঝে মাঝে বাজার নিয়ে আসতেন। কখনও বাসায় বাজার পৌঁছে দিতেন, কখনও বাসার গৃহপরিচারিকা ফাতেমাকে ফোনে ডেকে নিয়ে তার মাধ্যমে বাসায় বাজার পৌঁছে দিতেন। পিবিআই চট্টগ্রাম অফিসের কাউন্টারে আমাকে মুছার ছবি দেখালে আমি তাকে শনাক্ত করি।
সোমবার (২৬ জুন) চট্টগ্রাম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জসিম উদ্দিনের আদালতে বাবুল আক্তারের বাসার দারোয়ান সাক্ষ্যে এসব তথ্য তুলে ধরেন।
আদালতকে আবদুস ছাত্তার মোল্লা বলেন, সেনাবাহিনী থেকে ১৯৮৯ সালে অবসর গ্রহণ করে ন্যাচারেল সিকিউরিটি সার্ভিস লিমিটেডে গার্ড হিসেবে ছয় থেকে সাত বছর ধরে কর্মরত আছি। ২০১৬ সালের জুন মাসে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের সময় আমি কোম্পানির গার্ড হিসেবে ওআর নিজাম রোড আবাসিক এলাকার ১ নম্বর বাড়ি ইকুইটি সেন্ট্রিয়াম এ দায়িত্বে ছিলাম। এ সময় কোম্পানির আরও চারজন গার্ড ছিল। ওই বিল্ডিংয়ে প্রায় দুই বছর দায়িত্ব পালন করেছিলাম। বাবুল আক্তার স্যারের বাসায় কাজের মেয়ে ছিল ফাতেমা। সাদ্দাম নামে একজন পুলিশ সদস্য স্যারের বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেওয়াসহ বিভিন্ন কাজ করতেন। স্যারের বাসায় মেহমান আসলে আমরা ফোনে অনুমতি নিয়ে বাসায় পাঠাতাম। ম্যাডাম (মিতু) মারা যাওয়ার পর একজন পুলিশ সদস্য এসে রেজিস্ট্রারটি নিয়ে যান। তারপর থেকে রেজিস্ট্রার খাতা কোথায় আছে তা আমি জানিনা। বাবুল আক্তারের ছেলে মাহিরকে সবসময় স্কুলের বাসে দিয়ে আসতে যেতো কনস্টেবল সাদ্দাম। নিয়েও আসতো সে। কিন্তু ঘটনার দিন সাদ্দাম আসেনি। তাই বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু ম্যাডাম মাহিরকে নিয়ে সকাল সাড়ে ছয়টার বাসে তুলে দিতে যান। আমি তখন দায়িত্বে থাকা অন্য সিকিউরিটি গার্ড তারেককে দায়িত্ব দিয়ে চা আনতে ফ্লাস্ক নিয়ে বের হই। বিল্ডিং থেকে বের হয়ে শেষ মাথার ডানদিকে গিয়ে দেখি ম্যাডাম রাস্তার ওপর পড়ে আছেন আর মাহির চোখ মুছে মুছে কান্না করছে। আমি তখন দৌঁড়ে গিয়ে মাহিরকে কোলে নিয়ে বিল্ডিংয়ের নিচে চলে যাই। এরপর বিল্ডিংয়ের সব বাসায় কল দিয়ে ঘটনা জানাই। বাবুল স্যারের বাসায় কল দিয়ে তাদের বাসার কাজের মেয়ে ফাতেমাকে বলি একটি চাদর নিয়ে আসার জন্য। এরপর আমি চাদর দিয়ে ম্যাডামের মরদেহকে ঢেকে দেই। পরে পুলিশ এসে মরদেহ নিয়ে যায়।
সাক্ষ্যগ্রহণের সময় আদালতের হাজতে থাকা বাবুল আক্তারকে শনাক্ত করেন আবদুস সাত্তার। এরপর তাকে জেরা করেন বাবুল আক্তারের আইনজীবী কফিল উদ্দিন।
জেরার সময় তিনি বলেন, বাবুল আক্তার যে বিল্ডিংয়ে থাকতেন সেটাতে আমি দুই বছর চাকরি করেছি। তবে, কোন সাল থেকে কোন সাল পর্যন্ত সেটা আমার মনে নেই। বাবুল স্যার কোন বছর থেকে থাকেন বা কত বছর ছিলেন সেটাও আমি জানি না। স্যারের বাসায় যাওয়ার জন্য যে রেজিস্ট্রি খাতা ছিল সেটা কখন, কোন তারিখ বা কে নিয়ে গেছে সেটা আমি জানি না। তবে, আরেকজন যে ডিউটিতে ছিলেন তারেক তার কাছ থেকে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমি নিয়ে যেতে দেখিনি। তারেকের কাছ থেকে শুনেছি। খাতাটি শুধু বাবুল আক্তার স্যারের পারসোনাল ছিল। ফ্ল্যাট মালিক সমিতির চেয়ারম্যান বিষয়টি জানতেন। বাবুল স্যার ওই বিল্ডিংয়ের ভাড়াটিয়া ছিলেন। তার ফ্ল্যাট নম্বর ছিল ডি-৭। বিল্ডিং ও এর আশপাশ এবং রাস্তাঘাট সিসি ক্যামেরার আওতাধীন ছিল। যারা ওখানে আসত তাদের ছবি সিসি ক্যামেরায় উঠত। আমি ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে একই জবানবন্দি দিয়েছি। মুছা ঘটনার পাঁচ থেকে ছয় দিন আগে সকাল ১০ থেকে ১১টার দিকে বাজার নিয়ে এসেছিল। মুসা ওদের কাজের লোক ছিল কি না সেটা আমি জানি না। বাজার করতে কে বলতো সেটাও আমি জানি না।
জেরা শেষে বাবুল আক্তারের আইনজীবী কফিল উদ্দিন দাবি করেন, তারেক নামে কোনো সিকিউরিটি গার্ড ওই বিল্ডিংয়ে ছিল না। তার কাছ থেকে খাতা নিয়ে যাওয়া, মুসা নামের কেউ বাবুলের বাসায় বাজার করে দেওয়া সব মিথ্যা ও বানোয়াট। সাক্ষী মুছা নামের একজনকে বাজার নিয়ে বাবুল আক্তারের বাসায় আসতেন বললেও তার কোনো প্রমাণ তারা আদালতে উপস্থাপন করতে পারেননি। বাবুলের বাসায় কেউ আসলে যে রেজিস্ট্রারে নাম এন্ট্রি করা হতো তা অজ্ঞাতনামা পুলিশ সদস্য নিয়ে গেছে বলা হলেও তা জব্দ তালিকায় নেই। মুছা আসার কোনো সিসিটিভি ফুটেজও আদালতে উপস্থাপন করতে পারেননি। বাবুলকে ফাঁসাতে মুছা নামের একজন বাসায় বাজার নিয়ে যেতেন বলে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, মিতু হত্যার পরদিন সাত্তার ন্যাচারাল জবানবন্দি দিয়েছিলেন। কিন্তু, ঘটনার পাঁচ বছর পর তিনি পুলিশকে অন্যরকম জবানবন্দি দেন। পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটকে তিনি যে জবানবন্দি দিয়েছেন সেটা ১০০ শতাংশ মিল।
চট্টগ্রাম মহানগর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুর রশীদ বলেন, সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় তাদের বাসার দারোয়ান আবদুস সাত্তার মোল্লার সাক্ষ্যগ্রহণ ও আসামিপক্ষের জেরা সম্পন্ন হয়েছে। মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১৭ জুলাই দিন ধার্য করেছেন আদালত।
আলোচিত মিতু হত্যা মামলায় আসামিরা হলেন-বাবুল আক্তার, মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, এহতেশামুল হক ভোলা, শাহজাহান মিয়া, কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা ও খায়রুল ইসলাম। এ সাত আসামির মধ্যে চারজন কারাবন্দি। ভোলা জামিনে এবং মুছা নিখোঁজ রয়েছেন।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, গত ২০ ফেব্রুয়ারি আসামিদের আদালতে হাজির না করায় অভিযোগ গঠন পিছিয়েছিল। এর আগে, গত ৩১ জানুয়ারি মিতু হত্যায় চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. জেবুন্নেছা বেগমের আদালত বিচার শুরুর নির্দেশনা দিয়ে তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে নথি পাঠানোর নির্দেশ দেন।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার একটু দূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তরে তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পিবিআই সাতজনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেন। ১৩ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। ৯ এপ্রিল থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষী দেন মিতুর বাবা মামলার বাদী মোশাররফ হোসেন।