এই সেই মেধা

ড. গোলসান আরা বেগমঃ অজ পারা গাঁয়ে লবণ লংকার পরিবারের সন্তান মেধা। মেয়েটি কথায় কাজে বেশ চমৎকার।স্থানীয় একটি স্কুলে পড়াশোনা করে। অশিক্ষিত বাবা মা’র এই সন্তানটি গায়ে পড়ে মানুষের নানা প্রকার উপকার করে বেড়ায়।
কারো অসুখ বিসুখ হলে নিয়ে যায় সদর হসপিটালে। কোন ডাক্তার দেখাবে,কি করতে হবে, সাধ্যমত বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে। মিনার  মা ছুটে আসে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে। তার মেয়ে পঞ্চগড়ে বাসা বাড়িতে কাজ করে। স্বামী পালিয়ে গেছে,সন্তানটি রেখে গেছে নানুর কাছে। সেই কাজের বুয়া মিনার সাথে সুখ দুঃখের কথা বলার সুযোগ করে দেয় মোবাইলে মিনার মাকে।
মেধার অলস সময় পাড় করতে ভালো লাগে না। সর্বদা এ কাজে ওকাজে ছুটাছুটি করে।ও দাদু ওদাদু বলতে বলতে পাশের ঘরে ছুটে যায়। দাদু তো কানে শোনে না,একা একা বিরাট বাড়িতে বসবাস করে।তার সন্তানরা থাকে দুরদুরান্তে। দাদুর হাত পায়ের নখ কেটে দেয়, খেয়েছে কিনা খোঁজ খবর নেয়।
চলে আসবে, এমন সময় হাতে গুঁজে দেয় কিছু টাকা।দাদু বলে — কোথায় রাখি মনে রাখতে পারি না। কেউ জানতে পারলে চুরি করে নিয়ে যায়।তোর কাছে রাখ।সময় হলে নিবো।
পাশের ঘরের  চাচি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।গরুর দুধ নামাতে পারছে না চাচা। মেধা বালতি হাতে ঢুকে যায় গোয়াল ঘরে। গাইয়ের ওলান টেনে গড় গড় করে দুধ নামিয়ে দেয়। চাচা সে দুধ হাটে বিক্রি করে নিত্য দিনের বাজার নিয়ে ঘরে ফিরে।
সকালে ঘুম থেকে ওঠেই চূলার ছাই পরিস্কার করে,ঘর ঝাড়ু দেয়,ছোট ভাইকে মক্তবে পাঠিয়ে নিজে পড়তে বসে। স্কুলে যাওয়ার সময় হলে পুকুরে গোসল সেরে গায়ের আলপথ ধরে স্কুলে রওণা করে। মাঝে মাঝে স্কুলে যেতে পারে না,রাস্তার তেমাথায় কিছু ছেলে পথ আগলে দাড়িয়ে থাকে। তারা ফ্লাইং কিস ছুড়ে মারে, প্রেম নিবেদন করে, তুলে নেয়ার ভয় দেখায়।
স্কুল কামাই করে বলে স্যাররা দমকা দমকি করে। কিন্তু ঠোট খুলে বলতে পারে না, তার ক্লাশের ছেলে বন্ধুরাই মেধাকে বিরক্ত করে, স্কুলে আসার পথে বাঁধা দেয়। ক্লাসে  উপস্তিতির হার কমে যাওয়ায় উপবৃত্তির টাকা বন্ধ করে দেয়।মেধার মুখ কালো হয়ে আসে।এবার যদি বাবা তার পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়, কি হবে তখন?
রাতে পড়তে বসে, ভাবতে থাকে স্মরনীয়,বরণীয়, বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিদের কথা। তাদের ত্যাগী,সৃজনশীল,সমাজ বির্নিমানের কলাকৌশল জানতে ইচ্ছে করে। জানবে কি করে। হাতের কাছে বই পত্র তো কিছুই নেই।স্মার্ট মোবাইল ফোন কেনার ক্ষমতা নেই।চাইলেই পারে না গুগলে ঢুকে পৃথিবী বোঝাই জ্ঞান মাথায় তুলে নিতে। পাশের বাজারের পাঠাগার থেকে বই সংগ্রহ করবে তারও উপায় নেই। ঐ পাঠাগারে বসে বই পড়তে হয়।গ্রাম্য পরিবেশে একটা মেয়ে পাঠাগারে গিয়ে বই পড়রে, সমলোচনার উর্ধ্বে ওঠে এ পরিবেশ এখনও তৈরী হয়নি।
গতকাল বাড়ীতে ঘটক এসেছিলো।মেধার মা বাবা কে ইনিয়ে বিনিয়ে বলছে মেয়ে বিয়ের কথা।মেয়েদের এতো বেশী পড়া লেখা করাতে নেই।তা হলে তারা সংসার জীবনে সুখী হতে পারে না। নানা গন্ধ খুঁজে বেড়ায়। তৈরী করে সংসারের হাড়ি পাতিলে ঝামেলা।
ছেলে কোরানে হাফেজ। বাবার একমাত্র সন্তান।ঝামেলা মুক্ত পরিবার।ছেলের বাবার বেশ অর্থ সম্পদ আছে। সব সময় ভালো ছেলে পাওয়া যায় না। বিয়েতে রাজী হয়ে যাও। একটা ভালো মসজিদে ইমামতি করে,টিউশানী করেও ভালো আয় রোজগার করে।স্বভাব চরিত্রও ভালো। আমাকে ৫/৬ দিনের মধ্য হা না উত্তর দিবা।ভালো ছেলে সব সময় হাতে পাওয়া যায় না।
পরদিন কৃষিকাজ করে মাঠ থেকে ক্লান্ত অবসন্ন মন নিয়ে বাড়িতে ফিরে মেধার বাবা। ঘরের দাওয়ায় বসে মেধার মাকে বলে — মেধার বিয়ের কথা কিছু ভাবছো? মানুষের কান কথা তো সহ্য করতে পারছি না। তা ছাড়া এতো পড়ে কি হবে। সে কি জজ ব্যারিষ্টার হতে পারবে।
গরু বিক্রি করে গত পরীক্ষার ফি দিয়েছি। এর পরের খরচ চালাবো কি করে। নিজে তো খাটাখাটি করতে করতে মরে গেলাম প্রায়।তা ছাড়া ছেলেটাকে পড়শোনা করানো বেশী দরকার। মেধার মা বলে — কি জানি কি বলবো, আমার মাথায় কুলায় না।
মেধা কুটির শিল্পের উপর প্রশিক্ষণ নেয় স্বর্ণা ম্যাডামের সহায়তায়।সে বুঝতে পারে নারী সমাজকে স্বাবলম্ভী করা দরকার। তাই প্রতিদিন ১০/১২ জন নারীকে নিজেই কুটির শিল্পের প্রশিক্ণ দেয়। বিভিন্ন এনজিও, সমাজসেবা অধিদপ্তরের অফিসে ঘুরে নারীদেরকে লোনের ব্যবস্থা করে দেয়।
নারীরা তো মহা খুশী।অল্প পুঁজিতে অল্প স্বল্প লাভ। হাতে খেটে পান পাতার খরচ যোগার করতে পারলেই হলো। বাচ্চাদের হাতে বা সংসারেও কিছু দিতে পারে।
নারীদের মুখ খুলে হাসতে বা কথা বলতে দেখে এলাকার ধান্দাবাজরা নাখুশ হয়।তারা নানা ফন্দি ফিকির খুঁজতে থাকে, বন্ধ করে দিতে মেধার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। প্রায় সময়েই চাদা দাবি করে হট্টগোল বাধাঁয়। হত দরিদ্র মেধার বাবা জক্কি ঝামেলা মাথায় না নিয়ে মেয়েকে সরে আসতে বলে।।
বিদেশি লোন দাতা সংস্থা বিষয়টি আমলে নিয়ে মেধার পাশে এসে দাড়ায়। তারা বুঝতে পারে এই মেয়েটিই পারবে এলাকার মেয়েদের  ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে।এর ফাঁকে   মেধার পড়াশোনা শেষ পর্যায়ে চলে আসে।
এবার নতুন চকে বেঁধে মেধার কৃটির শিল্পটিকে এগিয়ে দিতে থাকে সরকারী বেসরকারী সংস্থা। মেধার বাবা মা’র দৈন দশার ভাগ্যের অন্ধকার দুর হতে শুরু  করে। মেধার গ্রামটি উন্নয়নের রোল মডেলে পরিনত হয় অল্পদিনের মাথায়। বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে মেধা নিজের অভিঞ্জতাকে করে পাকা পোক্ত। ধান্দাবাজদের রক্ত চক্ষু ওঠে আসে কপালে। এখন আর যৌতুক নিয়ে নয়,,যৌতুক দিয়ে মেধাকে বিয়ে করতে চায়। তখনও বিয়ের ব্যাপারে মেধা থাকে নীরব অবস্থানে।
এবার হাতে নয়,ভাতে নয়,বিয়ে নয়, মারবে মেধাকে মানুসিক যন্ত্রণা দিয়ে। উড়ো চিঠি, হুমকি, দমকি,হয়রানি করতে থাকে বিভিন্ন ভাবে। মেধার বাবা,মা, নারী উদ্যোক্তা,কাছের,দুরের আত্মীয় স্বজনসহ সবাই বিরক্ত হয়ে যায় মেধার এক ঘুয়েমীপনার উপর। বিয়ে তো করতেই হবে, তা হলে আর দেরী কেন।এ চাপ্টারটা ঘুচিয়ে নিলেই হয়। বালামুসিবত কেটে যায়।
ইস্টি কুটুমের মিস্টি ডাকে নিশুতি রাতে মেধার ঘুম ভেঙ্গে যায়।  গাঢ় অন্ধকারে শোনশান নীরবতা ভেঙ্গ নেড়ি কুকুরগুলো একটু পরপর গলা বাড়িয়ে কান্না করছে।
মেধা ভাবতে থাকে –কি অদ্ভুত এই জীবন।
এই দুনিয়াতে কেউ কারো নয়
বিখ্যাত অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদি সুবর্ণাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো, তার প্রথম স্ত্রীকে একটি মেয়ে  সহ ডিভোর্স দিয়ে। কিন্তু কই
সে বিয়েও তো ঠিকলো না।
বৃটিশ রাজ সিংহাসনের অধিকারী চার্লস বিশ্ব সুন্দরী ডায়নাকে চোখ ধাঁধানো জম কালো উৎসব করে বিয়ে করেছিলো। দুই সন্তান জন্ম দেয়ার পর তাদের সংসারও মাটির থালার মতো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। এমন ঘর ভাঙ্গার ভুরি ভুরি উদাহরন রয়েছে।
এতো সব ক্রাইসিস দেখার বা জানার পরও আমাকে বিয়ে করা উচিৎ হবে।
তা ছাড়া আমার চার পাশে যারা সংসার করছে, তারা সবাই  নির্মম,কঠিন,  মানবেতর জীবন যাপন করছে। মেকি হাসি মুখে নিয়ে সংসারের ঘানি টানছে ও কষ্ট যনটত্রণায় ধুকে ধুকে বেঁচে আছে। এই তেজপাতা জীবনের কি প্রয়োজন?
 যৌবনের উত্তাপে,ছেলে সন্তানের মায়া মমতায়, সামাজিকতার চাপে কিছু কিছুটা মিহি সূঁতার বন্ধন থাকলেও, স্বামী স্ত্রী প্রকৃত অর্থে কেউ কাউকে ভালোবাসে না। করে পরোকীয়া, লাটাই ছ্যাড়া ঘুরি হাতে, চুড়াবালির ফাঁদে  লুকোচুরি খেলা খেলে।
মেধার বাবার মাথা প্রায় উল্টা পাল্টা হয়ে গেছে। মেয়ে বিয়ে করে না বলে, মাকে লাঠি পেটা করে, বাড়ী থেকে বেড় করে দেয়।এ কি নিষ্টুর আচরণ। মেধার এতো সব ভাবতে আর ভালো লাগে না।
একদিন মেধার কাছে একটি উড়ো চিঠি আসে।চিঠিতে রসালো অনেক কথার পর – – –
“প্লিজ মেধা, তুমি আমার ভালোবাসা গ্রহন কর।তোমার জন্য আমি পৃথিবীর সব কিছু উৎসর্গ করবো।এমন কি আমার কলিজাটাও কেটে তোমাকে দেবো। তোমাকে না পেলে আমি মরে যাবো।”
বাড়ির পাশে পুকুর ঘাটে গিয়ে মেধা বসে।টলমল জলে উড়ো চিঠির কল্পনার নায়ককে নিয়ে ছবি আঁকতে থাকে। সত্যি যদি সে ছেলেটির সাথে বিয়ে হয় — কেমন হবে? সে তো তার হৃদয় কেটে দিতেও প্রস্তুত। ক্ষতি কি বিয়ের পিঁড়িতে বসলে?
হঠাৎ করে বাতাসে উড়ে চিঠিটি পুকুরের পানিতে তলিয়ে যায়।মেধার তন্দ্র ভঙ্গ ঘটে।
Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর