কেজিতে তিন টাকা দাম কমানোর পর বাজারে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মিলমালিকরা নানা সুবিধা নিলেও সিন্ডিকেট করে এখন চিনি আটকে রেখেছেন।
চিনির দাম কমানোর পর শনিবার (৮ এপ্রিল) থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু তারপর বাজারে কমানো দামে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকারি ব্যবসায়ী ও ডিলাররা বলছেন, মিলে কাগজ পৌঁছেনি। তাই কম দামের চিনি দিচ্ছে না।
খুচরা ব্যবসায়ীদেরও অভিযোগ পাইকারি বাজারে ও ডিলারের কাছে চিনি নেই। তাহলে আমরা কীভাবে পাব? তাদের অভিযোগ মিলমালিকরা সুবিধা নিলেও সিন্ডিকেট করে আটকে রেখেছে চিনি। এজন্য বাজারে চিনি নেই।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কোনো কোনো দোকানে চিনি পাওয়া যাচ্ছে সেটাও আগের দামেই। সরকার দাম কমানোর পরও তারা আগের দামই অর্থাৎ ১১৫ থেকে ১২০ টাকা কেজি রাখছেন।
অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) পরিশোধিত খোলা চিনির কেজিতে ৩ টাকা কমিয়ে ১০৪ টাকা এবং প্যাকেট চিনির দামও ৩ টাকা কমিয়ে ১০৯ টাকা নির্ধারণ করেছে। যা ৮ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।
কিন্তু গত শনিবার (৮ এপ্রিল) থেকে বিভিন্ন বাজার ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বাজারে কম দামের চিনি বিক্রি হতে দেখা যায়নি। পাইকারি থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা জানান, এখনো কম দামে চিনি পাইনি। তাই আগের মতোই ১১৫ থেকে ১২০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।
গত শনিবার থেকে মোহাম্মদপুর টাউনহলের বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোরের রবিউল এবং নিউ হক ভ্যারাইটি স্টোরের সোহেল, মনির স্টোরের আনোয়ারসহ বিভিন্ন খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে চিনি আছে, কত টাকা কেজি জিজ্ঞাসা করা মাত্র তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কীভাবে চিনি পাব? পাইকারি বাজারে চিনি নেই। আবার কিছু পাওয়া গেলে বেশি দামেই ১১২ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। তাহলে কীভাবে কিনব। কারণ, বেশি দাম নিলে জরিমানা খেতে হয়। তাদেরও অভিযোগ সরকার দাম কমানোর ঘোষণা দিলেও ভোক্তারা পাচ্ছে না।
কৃষিমার্কেটেও কম দামে পাওয়া যায় না চিনি। জানতে চাইলে সিটি এন্টারপ্রাইজের আবু তাহের বলেন, ৫ হাজার ৪৮০ টাকা বস্তা বা ১০৯.৬০ টাকা কেজি চিনি কিনেছি। বিক্রি করা হচ্ছে সামান্য লাভে। কম দামের চিনির ব্যাপারে তিনি বলেন, কই মার্কেটে তো পাই না। গতকালও ১০৯ টাকার বেশি দামে চিনি কিনেছি।
এদিকে, কারওয়ান বাজারেও আল্লাহর দান জেনারেল স্টোরের শাহ আলমসহ লক্ষীপুর স্টোর, আ. গনি স্টোরসহ অন্যান্য খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেন, শুধু শুনছি চিনির দাম কমেছে। কিন্তু কোম্পানি থেকে তো দিচ্ছে না, আমরা পাচ্ছি না। বিক্রিও করতে পারছি না। আবার কোথাও পাওয়া গেলেও ১১৫ থেকে ১২০ টাকার কম কেজি বিক্রি করা যাচ্ছে না।
তারা আরও বলেন, এই মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় ডিলার ও পাইকারি বাজার। সেখান থেকে আমরা এনে বিক্রি করি। কিন্তু তারাতো খোলা চিনি ১০৪ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি ১০৯ টাকা কেজি দিচ্ছে না।
তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চায়না কিচেন মার্কেটের দ্বিতীয় তলার মেঘনা গ্রুপের ডিলার জামান ট্রেডার্সের মালিক মো. জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ভাই আমরাও শুনেছি সরকার চিনির দাম কেজিতে ৩ টাকা কমিয়েছে। কিন্তু মিলে যোগাযোগ করা হলে অফিসাররা জানান, সরকার দাম কমানোর ঘোষণা দিলেও আমরা কিছু জানি না, এখনো কাগজ পাইনি। তাহলে কীভাবে ব্যবসা করব? কোন পথে যাব।’
সর্বশেষ কবে থেকে ডিও দিয়েছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অনেক দিন থেকে চিনি পাই না। আবার পেলেও বেশি দাম চাই। তাই রমজান মাসে চিনি কিনি না। কারণ, জরিমানা খেতে চাই না।
শুধু এই ডিলার নয়, চিনির পাইকারি বাজার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি মো. আবুল হাসেমও অভিযোগ করে বলেন, ‘না না কোনো চিনি পাচ্ছি না। সরকার ঘোষণা দিয়েছে গত শনিবার থেকে কেজিতে ৩ টাকা দাম কমানোর। অথচ মিলে যোগাযোগ করা হলে তারা বলছে এখনো দাম কমানোর কাগজ পাইনি। তাই কম দামে চিনি বিক্রি করতে পারব না। তবে আগের রেটে ১০৬ থেকে ১০৮ টাকা কেজি হলে দিচ্ছে। মিল থেকে নতুন করে কোনো ডিও নিচ্ছে না।’
বাজারে বেশি দাম কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুচরা ব্যবসায়ীরা বেশি লাভ করছে। এটা দেখার দায়িত্ব সরকারের। আবার মিল থেকে কম দামের চিনি দিচ্ছে না, সেটাও দেখা দরকার। কারণ, মিল থেকে সুবিধা নেবে আর ভোক্তাদের কাছে কম দামে চিনি বিক্রি করবে না। তা হতে পারে না।
এদিকে, কারওয়ান বাজারেও খুচরার মতো পাইকারি বাজারে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এই বাজারে সিটি গ্রুপের ডিলার এটি এন্টারপ্রাইজ ওমর ফারুক-কে বলেন, ‘চিনি নেই। কোম্পানি থেকে দেয় না। আগে ১১০ টাকা কেজি কেনা হয়েছিল। বিক্রি করা হয়েছে ১১১টাকা। কম দামের চিনি আসলে তখন বিক্রি করতে পারব।’
তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফার সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। পরে মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র উপদেষ্টা শফিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার ফোন বন্ধ থাকায় কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
তবে প্রতিষ্ঠানটির উপ-মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘সব জায়গায় প্যাকেট চিনি দেওয়া হচ্ছে। তার সবাই পাচ্ছে চিনি। যারা বলছে পাই না তারা মিথ্যে কথা বলছে। যদি তাদের চিনি না দিই তাহলে আমাদের চিনি যাচ্ছে কোথায়?’
এখনো বাজারে কম দামের চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘এটা কমন প্যাকটিস যে দাম কমলে বাজারে আসতে সময় লাগে। মিল থেকে বিভিন্ন অজুহাত দেখায়। কিন্তু দাম বাড়লে তাৎক্ষনিকভাবে তা কার্যকর হয়। ভোক্তাদের বেশি দামেই কিনতে হয়।’
তিন দিন চলে গেলেও ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভোক্তারা কম দামের চিনি পাচ্ছে না। এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা মিলমালিকদের উপর নির্ভর করছে।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বলছে, দেশে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসে লাগে প্রায় ৩ লাখ টন। অন্যান্য মাসে গড়ে দেড় লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। দেশে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন চিনি উৎপাদন হয়। বাকি চিনি আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়।