ঢাকা ০৮:৩৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাইব্রিড ধানের দখলে হাওর, অস্তিত্ব নেই বোরোর

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৪৬:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ এপ্রিল ২০২৩
  • ১০৮ বার

হাওরের জেলা সুনামগঞ্জকে বলা হতো বোরো ধানের ভান্ডার। এ জেলায় ছোট-বড় শতাধিক হাওর রয়েছে। এসব হাওরের প্রধান ফসলও ছিল বোরো ধান। সময়ের পরিক্রমায় হাওর থেকে হারিয়ে গেছে বোরো ধানসহ দেশীয় জাতের অর্ধশতাধিক প্রজাতির ধান। এক সময় বোরো ধানের আধিপত্য থাকলেও বর্তমানে হাইব্রিড ও উফশী জাতীয় ধানের দখলে পুরো হাওর।

স্থানীয় কৃষি বিভাগ বলছে, দেশি ধানের ফলন কম হওয়ায় হাইব্রিড চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। হারিয়ে যাওয়া এসব সুস্বাদু ও সুঘ্রাণযুক্ত ধানের ফলন বৃদ্ধি করতে গবেষণা চলছে বলে জানিয়েছে জেলা পরমাণু কৃষি গবেষণা কেন্দ্র।

এক সময় বোরো, রাতা, টেপি, বিরুই, লালডিংগি, নাজিরশাইলসহ অর্ধশতাধিক দেশি প্রজাতির ধান চাষ হতো হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে। সময়ের পরিক্রমায় কৃষির আধুনিকায়নের ফলে হাওর থেকে হারিয়ে গেছে দেশি প্রজাতির এসব ধান। এসব ধানের চাল খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টিসমৃদ্ধ ছিল। এমনকি গাছ অধিক উচ্চতার হওয়ায় বন্যার পানিতে তলিয়েও যেত না। খুব একটা সারেরও প্রয়োজন হতো না। ধান নষ্ট হওয়ার শঙ্কাও থাকত কম। তবে দেশি ধানে ফলন কম হওয়ায় এসব ধান আর চাষ করছেন না কৃষকরা।

অন্যদিকে অধিক ফলন হওয়ায় হাওর ছেয়ে গেছে হাইব্রিড জাতীয় ধানে। বীজের অভাব থাকায় চাইলেও এখন দেশি ধান চাষাবাদ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। তবে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ দেশি প্রজাতির ধানগুলোকে গবেষণার মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল জাতে রূপান্তর করা গেলে আবারো দেশি ধান চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন বলে দাবি কৃষকদের।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজবাড়ি গ্রামের কৃষক ইব্রাহিম আলী বলেন, রাতা, টেপি, লাইলডিঙ্গিসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি ধান ছিল আমাদের হাওরে। এসব ধান এখন আর কেউ খুঁজেও পাবে না। চাষ না করতে করতে ধানের নামই ভুলে গেছি।

একই গ্রামের কৃষক আলতাব মিয়া বলেন, বেশিরভাগ দেশি ধানের স্বাদ ও ঘ্রাণ ছিল অন্যরকম। বড়লোকদের পছন্দের তালিকায় থাকায় খুঁজে খুঁজে এসব ধান নিতেন তারা। কিন্তু ফলন কম হওয়ায় এখন আর কেউ চাষ করেন না। এখন চাইলেও সম্ভব না, বীজই খুঁজে পাওয়া যাবে না।

দেখার হাওর পাড়ের মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের কৃষক শমশের আলী বলেন, আগের ধানগুলা ফলানো সহজ ছিল। কোনো সার, ওষুধ লাগতো না। যার কারণে স্বাদে ভালো ছিল। এখন হাওর হাইব্রিডে ভরে গেছে। সার, ওষুধ ছাড়া এসব ধান ফলানো সম্ভব হয় না।

 

লালপুর গ্রামের আব্দুল আলীম বলেন, বিদেশি ধান আসায় আমাদের দেশি ধান নাই হয়ে গেছে। আমরা যে ধান দেখেছি, খেয়েছি, তা আমাদের ছেলে মেয়েরা দেখতে পারছে না। নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে যদি আগের ধান ফিরিয়ে আনা যেত, তাহলে সবাই আবারও চাষ করতাম।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা কেন্দ্র সুনামগঞ্জের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান মানিক বলেন, এক সময় দেশে খাদ্য ঘাটতি থাকায় সবাইকে হাইব্রিড জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান চাষে উৎসাহ দেওয়া হতো। হাইব্রিড ধান চাষ করে বেশি উৎপাদন পাওয়ায় এখন খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ বাংলাদেশ। আবার সেই কম ফলনশীল ধান চাষ করলে দেশ খাদ্য ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। তবে পুনরায় পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ দেশি ধান উচ্চ ফলনশীল জাতে ফিরিয়ে আনার জন্য গবেষণা চলছে। একই সঙ্গে  পুরোনো সব জাতের ধান সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান চাষাবাদ হয়েছে। দিন দিন উফশী ও হাইব্রিড চাষাবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা সুগন্ধী চাল খেতে আগ্রহী, তারা কিছু কিছু স্থানীয় জাতের ধান চাষ করছেন। তবে ফলন কম হওয়ায় এসব জাতের ধানের চাষ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে ফলন বেশি পাওয়ার আশায় চাষিরা নতুন নতুন জাতের ধানের চাষাবাদ করছেন। যদি কোনো কৃষক স্থানীয় জাতের ধান চাষ করতে আগ্রহী হন, আমরা বীজ সংগ্রহে সার্বিক সহযোগিতা করব।

চলতি বছর বোরো মৌসুমে সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলায় দুই লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৯৫ হেক্টর বেশি। ধানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ লাখ ৫৩ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হাইব্রিড ধানের দখলে হাওর, অস্তিত্ব নেই বোরোর

আপডেট টাইম : ০৯:৪৬:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ এপ্রিল ২০২৩

হাওরের জেলা সুনামগঞ্জকে বলা হতো বোরো ধানের ভান্ডার। এ জেলায় ছোট-বড় শতাধিক হাওর রয়েছে। এসব হাওরের প্রধান ফসলও ছিল বোরো ধান। সময়ের পরিক্রমায় হাওর থেকে হারিয়ে গেছে বোরো ধানসহ দেশীয় জাতের অর্ধশতাধিক প্রজাতির ধান। এক সময় বোরো ধানের আধিপত্য থাকলেও বর্তমানে হাইব্রিড ও উফশী জাতীয় ধানের দখলে পুরো হাওর।

স্থানীয় কৃষি বিভাগ বলছে, দেশি ধানের ফলন কম হওয়ায় হাইব্রিড চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। হারিয়ে যাওয়া এসব সুস্বাদু ও সুঘ্রাণযুক্ত ধানের ফলন বৃদ্ধি করতে গবেষণা চলছে বলে জানিয়েছে জেলা পরমাণু কৃষি গবেষণা কেন্দ্র।

এক সময় বোরো, রাতা, টেপি, বিরুই, লালডিংগি, নাজিরশাইলসহ অর্ধশতাধিক দেশি প্রজাতির ধান চাষ হতো হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে। সময়ের পরিক্রমায় কৃষির আধুনিকায়নের ফলে হাওর থেকে হারিয়ে গেছে দেশি প্রজাতির এসব ধান। এসব ধানের চাল খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টিসমৃদ্ধ ছিল। এমনকি গাছ অধিক উচ্চতার হওয়ায় বন্যার পানিতে তলিয়েও যেত না। খুব একটা সারেরও প্রয়োজন হতো না। ধান নষ্ট হওয়ার শঙ্কাও থাকত কম। তবে দেশি ধানে ফলন কম হওয়ায় এসব ধান আর চাষ করছেন না কৃষকরা।

অন্যদিকে অধিক ফলন হওয়ায় হাওর ছেয়ে গেছে হাইব্রিড জাতীয় ধানে। বীজের অভাব থাকায় চাইলেও এখন দেশি ধান চাষাবাদ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। তবে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ দেশি প্রজাতির ধানগুলোকে গবেষণার মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল জাতে রূপান্তর করা গেলে আবারো দেশি ধান চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন বলে দাবি কৃষকদের।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজবাড়ি গ্রামের কৃষক ইব্রাহিম আলী বলেন, রাতা, টেপি, লাইলডিঙ্গিসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি ধান ছিল আমাদের হাওরে। এসব ধান এখন আর কেউ খুঁজেও পাবে না। চাষ না করতে করতে ধানের নামই ভুলে গেছি।

একই গ্রামের কৃষক আলতাব মিয়া বলেন, বেশিরভাগ দেশি ধানের স্বাদ ও ঘ্রাণ ছিল অন্যরকম। বড়লোকদের পছন্দের তালিকায় থাকায় খুঁজে খুঁজে এসব ধান নিতেন তারা। কিন্তু ফলন কম হওয়ায় এখন আর কেউ চাষ করেন না। এখন চাইলেও সম্ভব না, বীজই খুঁজে পাওয়া যাবে না।

দেখার হাওর পাড়ের মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের কৃষক শমশের আলী বলেন, আগের ধানগুলা ফলানো সহজ ছিল। কোনো সার, ওষুধ লাগতো না। যার কারণে স্বাদে ভালো ছিল। এখন হাওর হাইব্রিডে ভরে গেছে। সার, ওষুধ ছাড়া এসব ধান ফলানো সম্ভব হয় না।

 

লালপুর গ্রামের আব্দুল আলীম বলেন, বিদেশি ধান আসায় আমাদের দেশি ধান নাই হয়ে গেছে। আমরা যে ধান দেখেছি, খেয়েছি, তা আমাদের ছেলে মেয়েরা দেখতে পারছে না। নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে যদি আগের ধান ফিরিয়ে আনা যেত, তাহলে সবাই আবারও চাষ করতাম।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা কেন্দ্র সুনামগঞ্জের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান মানিক বলেন, এক সময় দেশে খাদ্য ঘাটতি থাকায় সবাইকে হাইব্রিড জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান চাষে উৎসাহ দেওয়া হতো। হাইব্রিড ধান চাষ করে বেশি উৎপাদন পাওয়ায় এখন খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ বাংলাদেশ। আবার সেই কম ফলনশীল ধান চাষ করলে দেশ খাদ্য ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। তবে পুনরায় পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ দেশি ধান উচ্চ ফলনশীল জাতে ফিরিয়ে আনার জন্য গবেষণা চলছে। একই সঙ্গে  পুরোনো সব জাতের ধান সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান চাষাবাদ হয়েছে। দিন দিন উফশী ও হাইব্রিড চাষাবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা সুগন্ধী চাল খেতে আগ্রহী, তারা কিছু কিছু স্থানীয় জাতের ধান চাষ করছেন। তবে ফলন কম হওয়ায় এসব জাতের ধানের চাষ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে ফলন বেশি পাওয়ার আশায় চাষিরা নতুন নতুন জাতের ধানের চাষাবাদ করছেন। যদি কোনো কৃষক স্থানীয় জাতের ধান চাষ করতে আগ্রহী হন, আমরা বীজ সংগ্রহে সার্বিক সহযোগিতা করব।

চলতি বছর বোরো মৌসুমে সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলায় দুই লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৯৫ হেক্টর বেশি। ধানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ লাখ ৫৩ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।