অমুকের মা তমুকের বউ – এই কি বাঙালি নারীর পরিচয়

গোলসান আরা বেগমঃ হাতে গুনা কিছু নারী ছাড়া প্রায় অধিকাংশ নারীর নিজস্ব আত্ম পরিচয় নেই। অমুকের বউ তমুকের মা এর আড়ালে চাপা পড়ে যায় শিশু বয়সে আদরের মা বাবা’র দেয়া নিজের নামটা। আদিকাল থেকেই এভাবে অভ্যস্থ হয়ে আসছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা।

আমার মা’কে ডাকতো বাবলুর মা।বাবলু আমার বড় ভাইের নাম।সাধারনত বড় সন্তানের নাম ধরেই মা’র নামকরণ করা হয়। মা’য়ের প্রকৃত নাম আমেনা বেগম।বাবা আদর করে ডাকতো আনারকলি।আমার বড় ছেলের নাম বাঁধন। আমিও হয়ে যাই বাঁধনের মা।

আজকাল বাংলাদেশের নারীরা কর্মে,ধর্মে,পেশায়,বুদ্ধি,মেধায়,মানানসই আড্ডায় এগিয়েছে বহুদুর।তৈরী করেছে নিজস্ব আত্ম পরিচয়ের ক্ষেত্র। ইট ভাঙ্গা থেকে শুরু করে কর্মের এমন কোন স্তর নেই যেখানে নারীর হাতের ছোঁয়া, বুদ্ধি, মেধা বা শ্রমের স্পর্শ নেই। যা ছিলো এক সময় অকল্পনীয়।

বৈজ্ঞানিক,দার্শনিক,রাষ্ট্রনায়ক,সচিব,উপাচার্য,রাষ্ট্রদূত,স্পিকার,বিচাপতি,পলিসিমেইকার,ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, লেখক,প্র্ধানমন্ত্রী, রাজনীতিবিদসহ বহু দূর্লভ, লোভনীয় উচ্চ পদস্থ কর্মক্ষেত্রে নারীরা সততা,দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। নারীরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অমুকের বউ,তমুকের মা হিসেবে পরিচিতি পেতে রাজী নয়।এমন কি, পুরুষের সাথে বিরোধীতা নয় বরং পাল্লা দিয়ে কাজ করে পারিবারিক, সামাজিক তথা জাতীয় উন্নয়নকে করছে বেগমান। নারীর কর্মকৌশল, চিন্তা চেতনার ঝাঁঝালো ঘ্রান অপ্রতিরোদ্ধ।

এক সময় নারীকে সুর্য্যের আড়ালে রেখে অন্ধকার কুটুরীতে গৃহপালিত জন্তুর ন্যায় জীবন যাপন করতে দেয়া হতো। বিবাহিত স্বামীর অবয়ব কেমন তাও দেখতে লজ্জা বা ভয় পেতো স্ত্রী। নীচু স্বরে কথা বলা,নরম পায়ে হাঁটা,রান্না ঘরের রাঁধিকা, শয়ন কক্ষে স্বামীর মনোরঞ্জনের সামগ্রী, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ইত্যাদি অঙ্গনে ছিলো নারীর স্বীকৃতি।

স্বর্গ প্রাপ্তির প্রলোভন দেখিয়ে জীবিত স্ত্রীকে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে দাহ করা হতো। মৃত স্বামীর লাশের মাথা জীবিত স্ত্রীর কোলে বসিয়ে দিয়ে মাটির গর্তে পুতে মারা হতো।নির্দয়, নিষ্টুর, অনৈতিক,ভয়াবহ সহমরণ ও সতিদাহ প্রথা মানব কল্যাণে বাতিল করা হয়েছে।

মাতৃতান্ত্রীত সমাজ ব্যবস্থা বিলুপ্তির পর পুরুষতান্ত্রীক সমাজ প্রতিষ্টিত হলে নারীর অধিকার সকল অঙ্গনেই খর্ব হতে থাকে। বাড়তে থাকে নারীর উপর জুলুম অত্যাচার, যা আজো রয়েছে অব্যাহত। নানা কৌশলে একদিকে নারীকে অত্যাচার,নির্যাতন করছে,অন্যদিকে নারী তার মেরুদন্ড সোজা করে শক্ত মাটির উপর দাঁড়াবার লড়াই করছে। নারীসমাজ যে ভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে আশা করা যায় অচিরেই সমাধিকারের বিজয় নিশান তাদের হাতে পত পত করে উড়বে।

আমাদের দেশের বৃহৎ অংকের মেযেরা নীরবে সহ্য করে নানা অবিচার,অত্যাচার,,অনাচার,নির্যাতন
।তারা নিজের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্টা করার জন্যও প্রতিবাদ দুরে থাক, মুখ খুলে কথাও বলে না। মাথা নিচু করে গাধার মতো কর্তব্যের বোঝা টানতে থাকে। কোন কোন নারী তার দায়িত্ব,কর্তব্য,মৌলিক অধিকার কি তা নিজেও জানে। তাই প্রতিটি নারীকে নিজে সচেতন হতে হবে, অন্যকে সচেতন করতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষায়, দীক্ষায়,কর্মতৎপরতায় এগিয়ে আসতে হবে।

আজকাল কর্মজীবি মহিলারা সন্তান লালন পালন, ঘরের দায়িত্ব সহ অফিসিয়াল কর্ম রুটিনের যত্ন করে দক্ষতার সঙ্গে। অফিস শেষে ঘরে এসে স্বামীর হাতে চা,সন্তানের মুখে দুধ ভাত তুলে দিচ্ছে। ফুলের টবে পানি, ড্রইং রুমের ধূলাবালি পরিস্কার করার পর রান্না ঘরের দেখবালও করছে।তারপরও নারীর কাজের মুল্যায়ন ও স্বীকৃতি নেই কেন?

কেউ কেউ মনে করে
পেছনমুখী ধ্যান ধারনা, অজ্ঞতা, কুসংস্কারতা পরিহার করে প্রগতির পাঠশালায় ওঠে আসতে হবে নারীকে। সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গি উদার ও অতিশয় মানবিক হতে হবে।গ্লোবাল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে অবশ্যই আধুনিক, বুদ্ধি বৃত্তিক, কর্মট,প্রগতিশীল হতে হবে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত গর্জে ওঠে বলতে হবে আমরা মেয়ে মানুষ নই সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। আমরাও পারি যুদ্ধ জয়, রাজ্য শাসন, নভেল জয়,হিমালয় বিজয় করতে।নারীর কাছে এখন আর কোন কিছুই দুর্বোদ্ধ নয়। নারীরা পারে না, পারবে না – এই দৃস্টি ভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

নারীর হাতে পায়ের হাজার হাজার বছরের ক্লান্তি ঝেরে ফেলে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় সংবিধানে নারী পুরুষে সমাধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।অত্যাচার নির্যাতনের হাত থেকে নারী সমাজকে রক্ষা করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে নারী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, তা বাস্তবায়িতও হচ্ছে নানা ক্ষেত্রে। মুক্ত বাতাসে বুক ভরে নারীরা নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাচ্ছে। পর্যাক্রমে হচ্ছে ঈর্ষনীয় ভাবে ক্ষমতায়িত।

বাঙালি নারীরা হাত পোড়ে ভাত রাঁধার পাশাপাশি জেগে ওঠার গান গাইছে। নিজেকে মেয়ে মানুষ নয়, মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের প্রচেষ্টায় প্রাণ পণ কাজ করে যাচ্ছে। তাঁরা নিজের নামের শেষে স্বামী বা বাবর নাম জুড়ে দিয়ে বৃত্ত বন্দি হতে নারাজ।

প্রতিটি নারীই কারো না কারো বোন, স্ত্রী,গর্ভধারনী মা। সে তার দু’হাত দিয়ে স্নেহ আদর বিলিয়ে দিয়ে পরিবার,সমাজ বির্নিমানে রাখছে স্বস্থির অবদান। সামাজিক প্রথা,জৈবিক ক্ষুধা পুরুণ, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে ও পেটে সন্তান ধারান করে।তাই বলে অমুকের স্ত্রী,তমুকের মা — এই প্রচলিত রীতি মানতে রাজী নয়।

জাতীয় উন্নয়নকে বেগমান করতে হলে নারী পুরুষের যৌত সহযোগিতার বিকল্প নেই।স্বহৃদয় পাঠক, আসুন আমরা দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠি নারী সমাজকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সমধিকারের আসনে দেই স্থান।

লেখকঃ উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য,বাংলাদেশ কৃষকলীগ, কেন্দ্রীয় কমিটি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর