মস্কোয় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তলব করার মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশ নিয়ে রুশ-মার্কিন বিরোধ প্রকাশ্য এলো বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। এই বিরোধ সহজে শেষ হওয়ার নয় বলেও মনে করেন তারা।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান বিরোধ বুঝতে হলে পেছনে তাকাতে হবে। বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়াডে বাংলাদেশকে চায় দেশটি। কোয়াডকে বলা হয় ‘এশিয়ার ন্যাটো’ এবং এই জোটের অন্য দেশগুলো হলো ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় যে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) সেখানে বাংলাদেশ যোগদান করুক। একই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো এবং জাপানেরও। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড বাংলাদেশ সফরে এসে সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, হুমকি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র পাশে চায়।
অন্যদিকে, রাশিয়া ও চীন চায় বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে থাকুক এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়াড-আইপিএসে যোগ না দিক। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রকাশ্য বিতণ্ডায় জড়িয়েছিল চীন। ২০২১ সালের শেষদিকে তৎকালীন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং প্রকাশ্য বলেছিলেন বাংলাদেশ কোয়াডে যোগ দিলে চীনের সঙ্গে সম্পর্কে তা প্রভাব ফেলবে।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আগে নরমেটিভ ফরেন পলিসির পরিবর্তন করতে হবে।প্রিভেন্টিভ ডিপ্লোম্যাসিতে অনেক বেশি জোর দিতে হবে এখন। প্রচলিত কূটনীতি এখন আর নাই। আমরা তো ছোট দেশ। কাজেই আমাদের স্ট্র্যাটেজি হবে সংঘাত যেন আমাদের কাছে না আসে।
হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এতদিন ইউরোপে আমরা যে কোল্ড ওয়ার বা ঠাণ্ডা যুদ্ধ দেখেছি সেটা কিন্তু ভিন্ন ফর্মে এশিয়ার দিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা বলি অথবা সাম্প্রতিককালে ইউক্রেনের ঘটনাবলীর কথা বলা যায়। অর্থাৎ ভূরাজনীতিটা কিন্তু এখন আমাদের গায়ের ওপর এসে পরেছে। যেটা আগে দূরে ছিল।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এখন বাংলাদেশের জন্য যেটা চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে সেটা হলো এই ভূরাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে বাংলাদেশ নিজেকে কীভাবে রক্ষা করবে। বাধ্য হয়েই ভূরাজনৈতিক কূটনীতির মধ্যে ঢুকে পড়তে হচ্ছে। আমরা চাই বা না চাই।
হুমাযুন কবির বলেন, একটা বেসিক প্রিন্সিপাল কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে সেটি হলো কোনো একটি রাষ্ট্র আমার যা চাহিদা তার সবগুলো মিট করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে প্রায়োরিটিটা বুঝতে হবে যে আামি কার সঙ্গে কাজ করব। ওই দেশের ভেতরে কীভাবে রাজনীতি বা কূটনীতিটা হয় সেটা আমাদের বুঝতে হবে। সেই জায়গাগুলোতে আমাদের দক্ষতাকে আরেকটু শান দিতে হবে।
হুমায়ুন কবির আরও বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয় অনেক দেশই এই সমস্যায় পড়ছে। তাদের সঙ্গেও আমাদের সংযোগ বাড়াতে হবে। যাতে কোনো একটা ইস্যুতে তাদের অবস্থান বুঝে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়।
বাংলাদেশ নিয়ে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধ প্রথম প্রকাশ্যে আসে গত বছরের ডিসেম্বরে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ‘গুমের শিকার’ এক বিএনপি নেতার খিলগাঁওয়ের বাসায় যান। তখন ঢাকায় রাশিয়ার দূতাবাস টুইট করে অভিযোগ করে যে এই ঘটনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসও পাল্টা টুইট করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আনে।
এ বিষয়ে তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমরা চাই না যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া বা অন্য কেউ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলুক।
তারপর, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত রাশিয়ার কার্গো জাহাজ উরসা মেজর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম নিয়ে বাংলাদেশের উপকূলে ভিড়তে চাইলে মার্কিন আপত্তি করে। ফলে জাহাজটি ভারতের হলদিয়া বন্দরে নোঙর করলেও পণ্য খালাস করতে পারেনি। ৫৮দিন সাগরে ভেসে থাকে জাহাজটি।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ৯০টি জাহাজের তালিকা নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়েছে, কোনো বিদেশি জাহাজ বাংলাদেশের উপকূলে ভিড়তে চাইলে তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে। যদি এই তালিকার কোনো জাহাজ থাকে তাহলে সেটি উপকূলে ভিড়তে দেওয়া যাবে না।
তারপর থেকে রাশিয়ার কোনো জাহাজ রূপপুরের মালামাল নিয়ে বাংলাদেশের উপকূলে আসতে পারছিল না। সর্বশেষ, রুশ রাষ্ট্রায়াত্ত্ব জ্বালানি কোম্পানি রোসাটামের বরাত দিয়ে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাসের খবরে ১৪ ফেব্রুয়ারি বলা হয়, পণ্য পরিবহনে বিলম্বের কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কোনো প্রভাব পড়বে না। নির্ধারিত সময়ের বিষয়টি মাথায় রেখেই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ চলছে। এরই মধ্যে বিকল্প পথের খোঁজ মিলেছে। এখন সেই বিকল্প পথেই পণ্য পাঠানো হবে।
এই সংবাদের ঠিক ৭ দিন পর রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মস্কোয় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলব করে প্রতিবাদ জানানো হলো। তলবের বিষয়ে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এই পদক্ষেপ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বপূর্ণ চরিত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের সহযোগিতার সম্ভাবনার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।