গোলসান আরা বেগমঃ কত না রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭৭ এ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়ে রেখেছিলাম পা।পেছনে ফেলে এসেছি প্রাইমারী, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রাণপ্রিয় বহু বন্ধু,বান্ধব। জীবনের ৬৪+ বয়সে এসে দাড়িঁয়ে খুজঁছি সহপাঠিরা কে কোথায় কেমন আছে। অনেকেই পাড়ি জমিয়েছে ইতিমধ্যে পরপাড়ে। কারো কারো মৃত্যু হয়েছে অনাকাক্ষ্ঙত নিদারু একসিডেন্টে।যা ভাবলেও মনটা খুকড়ে যায়। ঙ নামক বন্ধুটি বাসায় কাছেই বাস একসিডেন্টে মরে পরেছিলো।কেউ জানতে পারলো না।বহু খুঁজাখুজির পর ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে উদ্ধার করা হয়।
আরো জানা যায় ক নামক বান্ধবীটি গ্যাসের আগুনে দগ্ধ হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে। রাতে রান্নার চূলা থেকে গ্যাস বেরিয়ে ঘরটি বোজাই হয়ে ছিলো।সকালে রান্না ঘরে ঢুকে চূলায় আগুন ধরাতেই,সেই আগুনে পোড়ে নিজে ভষ্স হয়ে গেল।কেউ জীবন রক্ষা করতে এগিয়ে আসারও সুযোগ পেলো না। হায় জীবন।
খ নামক বান্ধবীটি অভিমানে গলায় ফাঁস দিয়ে জীবন যুদ্ধকে সেলুট জানালো। কি ছিলো তাঁর ব্যথা বেদনা কিছুই জানতে পারলাম না। প্রেমিক জুটি গ ও ঘ সাজিয়েছিলো সুখের সংসার।আমাদের চোখে ধুলি দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তারা করতো প্রেমালাম,ঘুরাঘুরি,রঙিন স্বপ্নে হাবুডুবু খেলা।এই নিয়ে কতই না হাসা হাসি, মসকড়া করতাম অন্যরা। গ বন্ধুটি অসময়ে ঘ কে একটি মেয়ে সন্তান উপহার দিয়ে হারিয়ে গেলো। প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে চির প্রতিদ্ধন্দি বান্ধবীটি শুনেছি কোন এক গাঁও গেরামে বসবাস করছে। ছেলে সন্তানের আশায় সাতটি মেয়ে সন্তান নিয়ে বিধবা সংসারে অথৈ সাগরের ঢেউ গুনছে। ঙ বান্ধবিটি চ্যাগা খেয়েছে কি না, জানি না, নিজে ডাক্তার হয়েও বিয়ের পিঁড়িতে বসার সাহস হলো না। জীবন তো শেষ অধ্যায়ের দ্বার প্রান্তে, কবরের মাটি ছুঁই ছুঁই করছে।কখন আর বিয়ে করবে।
এই তো সে দিন প্রথিত যশা বন্ধু প্রফেসর ড. আফসার আহমেদ হৃদযস্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে যায়। মাথায় টিউমার নিয়ে যন্থণায় চটফট করতে করতে সহপাঠি পাশাও হারিয়ে যায়। উপজাতীয় সহপাঠী কোহিমা দাড়িং কি রুগে শোকে হারিয়েছে জানতে পারলাম না। হারাতে হারাতে সহপাঠিদের সংখ্যা তলানিতে দাঁড়িয়েছে। আমরা যারা বেঁচে আছি কেউ প্রবাসে,পাড়া গাঁয়ে,বাগান বাড়িতে,ঢাকা শহরে বসবাস করছি।ফেইজ বুক নামক যোগাযোগ মাধ্যমটি আদান প্রধান করছে আমাদের প্রানের খবরা খবর।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তম ব্যাচের সহপাঠিরা টিএসসির সামনে সপ্তমছায়া মঞ্চ নামে একটি স্মৃতিচত্তর তাদের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মান করেছে।একটি বট গাছে চারিদিকে কারুকার্য খচিত বেদী তৈরী করেছে বসে আড্ডা দেয়ার জন্য। পেছনে রয়েছে তখনকার পাঁচ ডিপার্টমেন্টের সহপাঠিদের নাম ফলক। আমি রসায়ন বিভাগের ছাত্রী ছিলাম।২০২০ এ নাটক ও নাট্যতত্ব বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছি।এরপর জীবনযুদ্ধে জিকজাক পথে হাঁটতে হাঁটতে বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছি।অপেক্ষা করছি- আঁতর লোবান মেখে নওশার সাজে, না ফেরার দেশে যাত্রার খাটিয়ায় ওঠার জন্য। হায় কি চরম বাস্তবতা।
প্রতি বছর ২ ফ্রেরুয়ারী সহপাঠিদের আসর বসে সপ্তম ছায়ামঞ্চে,সঙ্গে থাকে নাতি,পুতিসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এমনকি প্রবাস থেকেও ছুটে আসে বন্ধুরা।উপাচার্য,প্রোউপাচার্য,
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও আমন্ত্রিত হয়ে থাকেন আমাদের আসরে।সারাদিন চলে বিরতিহীন ম্যারাথন আড্ডাবাজি,গালগপ্প,খুনসুটি, টিপ্পুটিও বাদ পরে না। ফাটা হাসি, লম্বা হাসিতে গড়িয়ে পড়ি একে অপরের উপর,হাস্যরসে সিক্ত করি মনের ভিটা। গল্পের রিল টানা শেষ হতে চায় না।নায়ক নায়িকার পোজে ক্লিক ক্লিক প্লাসে ছবি তুলি সারাক্ষন।ইচ্ছে না করলেও বিরতি টেনে বাড়ী ফিরতে হয় ভালো লাগার উঞ্চতা নিয়ে। মাথায় একটি রেকর্ড বাজতে থাকে– আবার হবে তো দেখা,এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো?
সহপাঠিদের তালিকা রয়েছে স্বনাম ধন্য শিক্ষক,গবেষক,বুদ্ধিজীবি,ব্যবসায়ি,রাজনীতিবিদ,সাংবাদিক, লেখক,মানবাধিকার কর্মি,আমলা, কামলা। এমন কি জাতীয় পর্যায়ের নৃত্যশিল্পী শিবলি মোহাম্দদও আমাদের সহপাঠি। কামলা বন্ধুটি যখন চোখের সামনে দিয়ে গোবরের টুকরি মাথায় ও গরু নিয়ে গ্রামের আলপথ দিয়ে মাঠে যায়,তখন আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে।সে ছিলো মেধাবী ও স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান।যতদুর জেনেছি প্রেমের ফাঁদে পরে মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি।
ছুটির দিনে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সাবেক শিক্ষার্থীরা এই ছায়ামঞ্চে পিকনিক করে বা মিলন মেলার আসর বসায়।আমরা পিঠা উৎসব,ফল উৎসব করি অমলিন আনন্দ করে। মাঝে মাঝে প্রাণের প্রতিষ্ঠান জাবিতে গেলে সপ্তম ছায়ামঞ্চে চোখ বুলিয়ে আসতে ভুল করি না। পাশে দাঁড়িয়ে থাকি স্মৃতি রোমন্থন করে। খুজিঁ নরম তুল তুলে হারানো ব্যথা বেদনা ভালোবাসা,ফাগুনের আগুন ঝরা যৌবনের উচ্ছলতা।
শুনাম, পদবী,জীবনের হৈ চৈ বাদ দিয়ে কেউবা কিছুটা হলেও ঝিমিয়ে পড়েছে। কেউ কেউ জপছে ইয়ানাফসি ইয়ানাফছি। কেউবা জনসেবায় করছে মনোনিবেশ। পরবর্তি প্রজন্মের জন্য পৃথিবীতে বেটার পরিবেশ বেখে যাওয়ার জন্য কেউ করছে ক্লান্তিহীন সাধনা।যে যাই করুক নাকের ডগায়, কানের কাছে ঘুরাঘুরি করছে মরন বাণী,তার কাছে সবাইকে ধরাশায়ি হতে হবে। পৃথিবীকে জানাতে হবে বিদায় অভিবাদন। স্মৃতির স্পন্দন ভেসে বেড়াবে আকাশে বাতাসে।
লেখকঃ ৭ব্যাচের শিক্ষার্থী,রসায়ন বিভাগ।জাবি।