হাওর বার্তা ডেস্কঃ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সৌরভ ছড়াচ্ছে নেদারল্যান্ডসের ১০ প্রজাতির টিউলিপ ফুল। যেন একখণ্ড নেদারল্যান্ডস হয়ে উঠেছে উত্তরের এ জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম দর্জিপাড়া। ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা আসছেন দর্জিপাড়া গ্রামে। জেলায় টিউলিপ চাষে পর্যটনে যুক্ত হয়েছে নতুনমাত্রা।
পর্যটকরা বলছেন, ফাল্গুন মাস সমাগত। বসন্ত রাঙাচ্ছে নেদারল্যান্ডসের ফুটন্ত টিউলিপ। যেন আমরা নেদারল্যান্ডসে আছি। বাহারি রঙের টিউলিপের সৌন্দর্য আমাদেরকে মোহিত করছে। দেশের মাটিতে এ রকম বাণিজ্যিকভাবে শীত প্রধান দেশের ফুল চাষ হবে ভাবাই যায় না। খুব ভালো লাগছে।
দুই একর জমিতে এক লক্ষাধিক গাছে ফুটেছে ১০ প্রজাতির রাজসিক টিউলিপ। অ্যান্টার্কটিকা হোয়াইট (সাদা), ডেনমার্ক (কমলা ছায়া), লালিবেলা (লাল), ডাচ সানরাইজ (হলুদ), স্টংগোল্ড (হলুদ), জান্টুপিংক (গোলাপী), হোয়াইট মার্ভেল (সাদা), মিস্টিকভ্যান ইজক (গোলাপী), হ্যাপি জেনারেশন (সাদা লাল ছায়া) এবং গোল্ডেন টিকিট (হলুদ) রঙের টিউলিপ মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে চারদিকে।
মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে প্রান্তিক সীমান্ত গ্রাম দর্জিপাড়ায় এ অঞ্চলে টিউলিপ পাইলট প্রকল্প নিয়ে জেলা-উপজেলায় কর্মরত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) পরিচালক (প্রশাসন) ড. সেলিমা আখতার।
সেলিমা আখতার বলেন, ভৌগলিক অবস্থানগত দিক থেকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া পর্যটনে অপার সম্ভাবনাময় এলাকা। তেঁতুলিয়ায় আমরা ইকো ট্যুরিজম গড়ে তুলতে ভিনদেশি টিউলিপ ফুল চাষের পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করেছি। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্টের (ইফাদ) সহযোগিতায় দেশের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) মাধ্যমে পাইলট প্রকল্পে চাষ করা হচ্ছে বিদেশি ফুল টিউলিপ।
তিনি বলেন, গত বছর আমরা পরীক্ষামূলকভাবে দর্জিপাড়া-শারিয়ালজোত দুটি গ্রামে আটজন প্রান্তিক নারী কৃষককে নিয়ে ৪০ হাজার টিউলিপ চাষ শুরু করি। প্রথমবারেই টিউলিপ ফুটিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন নারীরা। দ্বিতীয়বারের মতো বাণিজ্যিকভাবে ২০ জন নারী কৃষকের হাতে প্রস্ফুটিত হচ্ছে ভিনদেশি নেদারল্যান্ডসের উচ্চ মূল্যের ফুল। পর্যটন এলাকায় টিউলিপ ফুলের বাগান সৃষ্টি হওয়ায় পর্যটনের আকর্ষণও বেড়েছে। দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এসে বাহারি রঙের টিউলিপ ফুল দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। কেউ সেলফি তুলছেন। আবার কেউ ফুল কিনছেন।
টিউলিপ চাষে এবার ব্যয় হয়েছে ৮০ লাখ টাকা। বাল্ব বা চারার দাম, শেড নেট, ফেন্সিং নেট, রাসায়নিক সার, জৈবসার, কীটনাশক ও শ্রমের মূল্য ধরেই এই ব্যয় হয়েছে। গত ১০ জানুয়ারি এক লাখ টিউলিপ ফুলের বাল্ব (বীজ) রোপণ করা হয়। রোপণের ১৫-১৬ দিনে আসে চারা গজিয়ে কলি ফুটে। এখন প্রতিদিনই ফুটছে নতুন নতুন ফুল। এ ফুল ঘিরে নারী কৃষকদের আয়ের স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। এ ফুলের পর অন্য সময়টাতেও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ফুল চাষাবাদ করতে পারবেন তারা।
সেলিমা আখতার বলেন, টিউলিপ ফুল উৎপাদন করে ফুলের জগতে অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে উৎপাদিত প্রতিটি ফুল বাগান থেকে ৫০ টাকা দরে স্থানীয়ভাবে বিক্রি শুরু হয়েছে। ফুল বাগানে ক্ষুদ্র পরিসরে বিনোদন পার্ক তৈরি করে পর্যটক ও ফুলপ্রেমীদের জন্য প্রবেশ মূল্য চালু করা হয়েছে। এতে ফুল বিক্রি বাদেও তারা অতিরিক্ত টাকা আয় করতে পারবেন। সামনে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস রয়েছে। বিশেষ করে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস রাঙাবে আমাদের টিউলিপ। মুগ্ধ করবে পর্যটকদের।
টিউলিপ ঘিরে পর্যটকদের আকর্ষণে কিছু নতুন সংযোজন করা হয়েছে। সবুজ গমের চারার মাঝে টিউলিপ ফুটিয়ে জাতীয় পতাকার রূপ দেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকদের এখানে ঘুরতে এসে যাতে কোনো প্রকার অসুবিধা না হয় সেজন্য এখানেই ইকো ট্যুরিজমের মাধ্যমে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হিসেবে হোটেল দেওয়া হয়েছে। এখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মুর্শিদা খাতুন, মনোয়ারা খাতুন, আয়েশা সিদ্দিকাসহ কয়েকজন উদ্যোক্তা বলেন, প্রথমবারের মতো গতবার বছর আমরা প্রান্তিক ৮ জন নারী মিলে এ অঞ্চলে নেদারল্যান্ডসের রাজকীয় টিউলিপ ফুটিয়ে ছিলাম। এ অঞ্চলে টিউলিপ চাষ করে আমরা যেমন সফল হয়েছিলাম তেমনি আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছিলাম। এছাড়া টিউলিপ ফুল দেখতে এ অঞ্চলে প্রচুর পর্যটকের সমাগম ঘটেছিল। আশা করছি এবারও টিউলিপের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করবে।
তেঁতুলিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জাহঙ্গীর আলম বলেন, তেঁতুলিয়ার মাটিতে ভিনদেশি ফুল, সবজি ও ফল চাষ হচ্ছে। পিকেএসএফের সহযোগিতায় ইএসডিওর মাধ্যমে পাইলট প্রকল্পে বিদেশি ফুল টিউলিপ চাষ এ অঞ্চলের পর্যটনে নতুনমাত্রা তৈরি করেছে। সেই সঙ্গে টিউলিপ চাষ করে ২০ নারী চাষি স্বাবলম্বী হয়েছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সব সময় তাদের পাশে আছে। আগামীতে টিউলিপ চাষ আরও বড় আকারে করা হলে অর্থনীতি ও পর্যটনে সমৃদ্ধ আসবে।