সম্প্রতি মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় মারা যাওয়া এক ব্যক্তির কোন আত্মীয়-স্বজন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। লাশ দাফন নিয়ে জটিলতায় পড়েছিল কিছু সেচ্ছাসেবী লোকজন। বৃদ্ধাশ্রমে থাকার পর মারা যাওয়া এই ব্যক্তিটিকে নিয়ে জনৈক আরিফুর রহমান শিহাব এ নিয়ে ফেসবুকে একটি আবেগঘন পোস্ট দিয়েছেন। পাঠকের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
বাবা মারা গেছেন- এই খবর জানাতে মেয়েকে ফোন করে দেখি, তিনি আমাদের নাম্বার ব্লক করে দিয়েছে। আমাদের অপরাধ, মেয়েকে একবারের জন্যে দেখতে চেয়েছিলেন অসুস্থ বাবা। সেটা জানিয়ে উনাকে তখন আমরা কল দিয়েছিলাম।
দেখতে আসলে যদি দায়িত্ব নিতে হয় এই ভয়ে হয়তো দেখতে আসেনি। এখন তো মারাই গেছে আর দায়িত্ব নেয়ার ভয় পাবেনা। এটা চিন্তা করে মৃত বাবার পরিচিত একজনকে কল করে তার ছেলে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রীকে জানাতে বললাম। বিশেষ করে তার একমাত্র ছেলে ইমনকে জানানোর কথা বলেছি কারণ মারা যাওয়ার আগের দিন ইমনকে অনেক ডাকছিল।
প্রায় ৪৫ মিনিট পরে সেই পরিচিত জানালো তারা কেউ আসবে না। আমি তাকে আবার বললাম ভাই ওনাদেরকে আরেক বার কল দেন। ওনাদের কোন খরচ বহন করতে হবেনা। আমরাই সকল খরচ বহন করবো। তার পরিবারের কেউ না আসলে এই বৃদ্ধ বাবার লাশটি কোন পরিচয় ছাড়াই বেওয়ারিশভাবে দাফন করতে হবে।
রাত তখন প্রায় ২টা। আমরা মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশ নিয়ে অপেক্ষা করছি রাত ৮ থেকে। অন্তত এই বৃদ্ধ বাবাকে যেন বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করতে না হয়। এদিকে হাসপাতাল থেকে আমাদেরকে দ্রুত লাশ নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। আমরা যদি সেই মুহূর্তে লাশ গ্রহণ করতাম তখন তার ডেড সার্টিফিকেট তৈরি হতো বেওয়ারিশ হিসাবে। কারণ আমরা তার আইনগত কোন অভিভাবক না। আবার তার সেই পরিচিত লোককে ফোন দিলে সে বলল, তার পরিবারের কেউ আর ফোন ধরছে না।
আমরা যখন এই অবস্থায় কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন ফোন করে বলল, সে মৃত ব্যক্তির ভাই এবং তিনি হাসপাতালে আসতেছেন। আমাদের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চারণ হলো। তিনি অবশেষে হাসপাতালে এলেন। আমরা তার জাতীয় পরিচয়পত্র মিলিয়ে দেখলাম, তারা আপন ভাই। তবে সে তার ভাইয়ের লাশ নিয়ে যেতে চাচ্ছেন না!
এরপর আমরা তার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ওইদিন সকাল ১১টার সময় আজিমপুর কবরস্থানে দাফনের কাজ সম্পন্ন করি। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া শেষ পর্যন্ত তাকে বেওয়ারিশভাবে নয়, নাম পরিচয়সহ দাফন করতে পেরেছি। তবে এই অমানবিক ঘটনার স্বাক্ষী হওয়ার পর থেকে আমাদের নিজেদেরকে মানুষ বলে দাবি করতে লজ্জা হচ্ছে। কারণ একটা পশুও যদি মারা যায়, তখন অন্য পশুরা তাকে দেখতে আসে।
এই বৃদ্ধ বাবা করোনার আগে একটি দোকান করে তার সংসার চালাতো। এরপর সে অসুস্থ হওয়ার কারণে সংসারে আর কোন টাকা দিতে পারতেন না। টাকা না দিতে পারার কারণে তাকে আর তার পরিবারের কেউ দেখতে পারতেন না। এরপর থেকেই তার জীবন কাটাতে হয় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে। এই বৃদ্ধ বাবা আমাদের ‘ভালো কাজের হোটেল’ এর কমলাপুর শাখায় প্রতিদিন খাবার খেতেন আর থাকতেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। অসুস্থতার জন্য তার রাস্তাঘাটে থাকতে কষ্ট হওয়ায় তিনি গত ৬ মাস যাবত আমাদের বৃদ্ধাশ্রম ‘আপন ঘর’ এ ছিলেন। তার মত এরকমের আরও প্রায় ৩০ জন বৃদ্ধ মা-বাবা আছেন এখানে। তাদের ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে আল্লাহই জানেন।
(লেখাটি আরিফুর রহমান শিহাব নামক জনৈক ফেসবুক ব্যবহারকারীর পোস্ট থেকে সংগৃহিত)।