হাওর বার্তা ডেস্কঃ কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া সাধারণ এক মানুষ তিনি। জুতা পলিশ এবং ফেরি করে শৈশব কাটানো বালকটি স্টিলকারখানায় শ্রমিকের কাজও করেছেন। জীবন যুদ্ধে সংগ্রামী সেই বালক বড় হয়ে হয়েছিলেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট। দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে টেনে তুলে জনপ্রিয়তার শীর্ষেও ওঠেন। কিন্তু মিথ্যে অভিযোগে যেতে হয় কারাগারে। তবুও হাল ছাড়েননি, তৃতীয়বারের মতো আবারও লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।
তিনি আর কেউ নন, নাটকীয় জীবনের অধিকারি লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা। ব্রাজিলের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের পারনামবুকোর এক গরিব পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার। শুরুতে ছিলেন শ্রমিক। সেখান থেকে বামপন্থায় ঝুঁকে পড়া এবং শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া। এরপর ধাপে ধাপে দেশটির সর্বোচ্চ পদ প্রেসিডেন্টের আসনে বসা। পরবর্তী সময়ে লুলার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে যেতে হয় জেলে। তবুও দমে যাননি তিনি।
১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া লুলার মা-বাবা ছিলেন নিরক্ষর। ভাগ্যান্বেষণে তারা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে সাও পাওলোর শিল্পায়নে চলে আসেন। ১০ বছর বয়সে পড়তে শিখেছিলেন, ১৪ বছর বয়সে স্কুল ছেড়েছিলেন লুলা।
আট ভাইবোনের মধ্যে সপ্তম লুলার ছোটবেলা কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে প্রথমে সান্তোসে এবং পরে সাও পাওলোতে চলে আসেন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া লুলা প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। জুতা পলিশ এবং ফেরিওয়ালা হিসেবে কাজ করেছেন ছোটবেলায়।
পরে একটি স্টিলকারখানায় শ্রমিকের কাজ নেন। কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করার সময় বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন লুলা। সত্তর থেকে আশির দশকে সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী বড় বড় ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেন তিনি। আশির দশকে ট্রেড ইউনিয়ন সমর্থকদের নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি (পিটি) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
১৯৮৯ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে অল্প ভোটে পরাজিত হন লুলা। এরপর ১৯৯৪ ও ১৯৯৮ সালেও পরাজয় বরণ করতে হয় তাঁকে। এ সময় লুলার রাজনৈতিক জোটে ও তাঁর সমর্থনে ছিল কর্মজীবী, দরিদ্র ও বামপন্থী ভোটার, বামপন্থী ক্যাথলিক ভোটার এবং ব্রাজিলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী। প্রথম তিন নির্বাচনে ব্যর্থ হলেও তৃণমূলের ভোটারদের সমর্থন লুলার রাজনৈতিক দলকে আরও শক্তিশালী করে।
এ সময়ে ব্রাজিলে চলছিল তীব্র অর্থনৈতিক সংকট। মুদ্রাস্ফীতি এমন পর্যায়ে ছিল যে ১৯৮৬ সালের পর ৭ বছরে ৫ বার দেশের মুদ্রা পরিবর্তন করতে হয়েছে।
দেশের এমন পরিস্থিতিতে লুলার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ২০০২ সালের নির্বাচনে নতুন কৌশল গ্রহণ করেন লুলা। বেশ কয়েকজন রক্ষণশীল এবং ডানপন্থী রাজনীতিবিদকে দলে টেনে নেন লুলা। এর মাধ্যমে একদম দরিদ্র তৃণমূল থেকে ব্যবসায়ী পর্যায়ে সমর্থন চলে আসে লুলার।
২০০২ সালের নির্বাচনে জয় পান লুলা। তার প্রথম প্রেসিডেন্সিতে চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের সুবাদে ব্রাজিলের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন হয়। লুলা এই অর্থ জনকল্যাণে ব্যয় করেন। ‘বোলসা ফ্যামিলিয়া’ নামে একটি স্কিম চালু করেন যার মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষা ও ভ্যাকসিনের জন্য সরকার থেকে অর্থ সহায়তা দেওয়া হতো।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবার দায়িত্ব পালনের পর তার জনপ্রিয়তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ শতাংশে। ২০০৬ সালে লুলা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসেন। এবার ব্রাজিলের জিডিপি রেকর্ড পরিমাণ বাড়ে। সাথে সাথে বাড়ে লুলার জনপ্রিয়তা।
২০১৪ সালে দুর্নীতির অভিযোগে ওয়ার্কার্স পার্টির সমর্থিত প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ ক্ষমতাচ্যুত হন। লুলার জোট ওয়ার্কার্স পার্টি ভেঙে যায়। গ্রেপ্তার হন লুলা। পরে সুপ্রিম কোর্টে প্রমাণিত হন তিনি নির্দোষ।
দিলমা রুসেফের পর ব্রাজিলের ক্ষমতায় আসেন ডানপন্থী রাজনীতিবিদ বলসেনারো। তবে তাঁর সময় ব্রাজিলের জিডিপি কমে যায়। করোনায় মারা যায় অনেক মানুষ। মহামারি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হন তিনি। এরপর ২০২২ সালে নভেম্বরের নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসলেন লুলা।
লুলার এ ফিরে আসাটা ঐতিহাসিক। সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর আমলে ব্রাজিলে বেড়েছে দারিদ্র্য। মধ্যবিত্তের জীবনে কষ্ট বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভক্তি। আর সেটাই কাজে লাগিয়েছেন লুলা। ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন দেশে অর্থনৈতিক সংস্কার এনেছিলেন লুলা। মানুষের কষ্ট অনেকটাই লাঘব করেছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই সাধারণ মানুষ পরিবর্তনের আশায় আবারও লুলাকে বেছে নেয়। যদিও লুলা–বলসোনারোর ভোটের ব্যবধান ছিল সামান্যই।
এ বিভক্তির কথা লুলাও জানেন। তাই শপথ নিয়ে তিনি দেশে ঐক্য ফেরানোর কথা বলেছেন। লুলা বলেছেন, ‘আমি সব ব্রাজিলিয়ানের প্রেসিডেন্ট হতে চাই। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশ পুনর্গঠন করতে চাই।’ লুলার মন্তব্য, ‘এখানে দুটি ব্রাজিল নেই। আমাদের একটিই দেশ, আমরা একই মানুষ।’ দেশ থেকে দারিদ্র্য, বর্ণবাদ ও লৈঙ্গিক বিভাজন দূর করা এবং আমাজন বন ধ্বংস করা ঠেকানো অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে বলেও জানিয়েছেন লুলা। লুলার ভাষ্য, তিনি দেশকে আবারও বিশ্বের ‘শীর্ষ খাদ্য উৎপাদনকারী ও সবুজ জ্বালানির পরাশক্তি’ হিসেবে দেখতে চান।
লুলাকে জনতুষ্টিবাদী নেতা হিসেবে বর্ণনা করা ভুল হবে। তিনি একজন ধ্রুপদি রাজনীতিবিদ ও একজন সেরা কল্পনাশক্তিসম্পন্ন সামাজিক মধ্যস্থতাকারী। তাঁর বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতালব্ধ জীবন তাঁর প্রতি সবাইকে সহানুভূতিশীল করে তোলে। একটি গাড়ি কারখানায় একজন যন্ত্রকর্মী হিসেবে তিনি পেশাজীবন শুরু করেছিলেন এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও শ্রমিক ইউনিয়নের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন। সেই সময়ই তিনি স্বৈরাচারী শাসনের নির্যাতনকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন। ওই সময়ই তিনি ইউনিয়নগুলোকে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দেন।
আমাজন বন ধ্বংস, দেশে করোনার বিস্তার ঠেকাতে না পারা, অর্থনৈতিক শ্লথতা, দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিজ্ঞানের মতো প্রয়োজনীয় নানা বিষয়ে বরাদ্দ কমিয়ে আনায় তুমুল সমালোচিত ছিলেন ডানপন্থী বলসোনারো। সেখান থেকে দেশকে ঘুরে দাঁড় করাবেন, দেশবাসীকে এমন স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় বসেছেন লুলা। তাই তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জও এখন সীমাহীন। এখন দেখার বিষয় কতটা সফল হতে পারেন এই রাষ্ট্রনায়ক।