মুসলমানদের বহু কাংখিত পবিত্র সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান। এই মহাপবিত্র মাসে বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোটি
কোটি ধর্মপ্রান মুসলমানগণ রোজা পালন করে থাকেন। অনেক অসুস্থ ব্যক্তিও রোজা পালন করেন। রোজাদারগণ যাতে সুস্থ থেকে
রোজা পালন করতে পারেন এবং ইফতার ও সাহরীতে স্বাস্থ্য সম্মত আহার করেন এসব বিষয়ে জেনে নিন .
অসুস্থ ব্যক্তিদের রোজা :
যারা অসুস্থ তার কি রোজা রাখবেন এবং যদি রাখেন তাদের পথ্য কিভাবে গ্রহণ করবেন। প্রসঙ্গত, ইসলামে রোজা ফরজ হওয়া তেকে কয়েক শ্রেণীর মানুষের জন্য ছাড় দেয়া হয়েছে। সূরা বাকারার ১৮৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “অত:পর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময় সে রোজা পূরণ করে নিতেহবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে। যে ব্যক্তি খুশীর সাথে সত্কর্ম করে ত তার জন্য কল্যঅণকর হয়। আর যদি রোজা রাখ, তবে তোমাদের জন্যে বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার।”
এজন্য কোরআন ও হাদীসের আলোকে ইসলামী বিধিবিধানের নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, রোজা রাখলে যদি জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায় অথবা চিকিত্সা গ্রহণে বাধার সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে রোজা রাখার আবশ্যকতা নেই। এছাড়া, ১৪ বছরের কম বয়সী ছেলে-মেয়ে, ভ্রমণরত ব্যক্তি, রজস্রাবরত নারী এবং যে সকল মা তাদের বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে তাদেরকেও রোজার বাধ্যবাধকতা থেকে শিথিল করা হয়েছে। তথাপি অনেক অসুস্থ মুসলিম ব্যক্তি রোজার ধর্মীয় গুরুত্বের উপলব্ধি থেকে রোজা রাখতে আগ্রহ পোষণ করেন এবং রোজা রাখেন। এ কারণে বিভিন্ন দেশে অসুস্থ ব্যক্তিদের অসুস্থতার উপর রোজার প্রভাব নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। পাশাপাশি যারা দীর্ঘ মেয়াদী লিভার প্রদাহ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানী ইত্যাদির মত দীর্ঘ মেয়াদী রোগে ভুগছেন তারা রোজা কখন রাখতে পারবেন, রোজার সময় কিভাবে থাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করবেন এবং কোন নিয়মে ওষুধ সেবন করবেন, সে বিষয়ে বিধি বিধান প্রণয়নের চেষ্টা চালাচ্ছেন। আলোচ্য প্রবন্ধটি মধ্য দিয়ে শরীরের উপর রোজার প্রভাব, রোজার উপকারিতা এবং রোগীদের ক্ষেত্রে রোজার সময় করণীয় নিয়ে আলোচনা করা হলো।
দেশে দেশে রোজা :
পৃথিবীর নিরক্ষ রেখা থেকে যত উত্তরে বা দক্ষিণে যাওয়া হয়, ঋতু ভেদে ততই দিন ও রাতের সময়কালের পার্থক্য হতে থাকে। ফলে, নিরক্ষ রেখা ও তার কাছাকাছি বসবাসরত মুসলিমদের রেজা রাখতে হয় ১২ থেকে ১৭ ঘন্টা। অন্যদিকে উত্তরে বা দক্ষিণে স্থানভেদে এবং ঋতুভেদে কোথাও ১৮ থেকে ২১ ঘন্টা রোজা রাখতে হয়। আবার কোথাও ৯ থেকে ১১ ঘন্টা রোজা রাখতে হয়। মজার বিষয় হলো সাধারণত: শীতপ্রধান দেশের মানুষদের দীর্ঘ সময় ধরে রোজা রাখতে হয়। ফলে দীর্ঘ সময় রোজা রাখার ফলে যে পানি শূন্যতার প্রবণতা থাকে তা থেকে শীতপ্রধান দেশের মুসলিমরা নিরাপদে থাকেন।
রোজার উপকারিত :
রোজা রাখার মাধ্যমে মানসিক ও শারীরিক উভয় দিক থেকেই উপকার সাধন হয়। যেহেতু রোজার মাধ্যমে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় স্বেচ্ছায় পানাহার থেকে বিরত থাকতে হয় এবং রিপু দমন করে রাখতে হয়, সেহেতু রোজার মধ্য দিয়ে নিজের ক্ষুধা ও রিপুর উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের প্রশিক্ষণ হয়ে যায়। ফলে, অতিরিক্ত খাওয়া এবং রিপুর তাড়না থেকে বিরত থাকা সহজ হয়। এছাড়া সমাজের গরীব মানুষ যারা তিন বেলা খেতে পারে না, ধনীদের পক্ষে তাদের মানসিক অবস্থা বুঝা এবং তাদের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল হওয়ার মানসিক পরিবর্তনও হয়। অনেক রোজাদারের জবানবন্দী থেকে জানা যায় যে, তারা রোজা রেখে এক ধরণের আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তি অনুভব করেন।
রোজার শারীরিক উপকারের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো: শরীরের মেদ কমা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠা। এর প্রধান কারণ হলো, ইসলামের রোজা রাখার পদ্ধতি। পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিতেও রোজা রাখার রীতি আছে। তাদের রোজা রাখার নিয়মও বিভিন্ন। রোজার নিয়ম যদি এমন হত যে ২৪ ঘন্টাই পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে, সেক্ষেত্রে শরীর অতিরিক্ত পানি হারাতো এবং রক্তে গ্লুকোজ মাত্রাতিরিক্ত কমে যেতো। ফলে মস্তিষ্ক নিস্তেজ হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিতো। এছাড়াও শরীরের অন্যান্য অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকত। কিন্তু মুসলিমদের রোজার একটি সুন্দর নিয়ম হলো, রাতের বেলায় সে যত ইচ্ছে পানাহার করতে পারবে। ফলে শরীর কখনও উক্ত অবস্থা পর্যন্ত অগ্রসর হয় না এবং আশংকাজনক হারে দুর্বল হয় না। এছড়াও যেতেহু ইফতার ও সাহরীর জন্য কোন নির্দিষ্ট ধরণর খাদ্য (যেমন: শুধু আমীষ, শুধু ফল ইত্যাদি) বেঁধে দেয়া হয়নি সেহেতু মুসলিমদের শরীরের প্রয়োজনীয় উপদানের ঘাটতির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা থাকে না।
আমেরিকান একদল বিজ্ঞানীর গবেষণায় দেখা গেছে যে, রোজার মাধ্যমে যে মানসিক পরিবর্তন আসে তাতে মস্তিষ্ক থেকে এক ধরণের নিউরোট্রিফিক ফ্যাক্টর নিসৃত হয় যা অধিক নিউরন তৈরীতে প্রভাবিত করে।
রজমান মাস ধূমপায়ীদের জন্য ধূমপান ত্যাগ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ। একজন রোজাদার যেহেতু সারাদিন ধূমপানের সুযোগ পাচ্ছে না, সেহেতু সে যদি রাতের বেলায়ও ধূমপান থেকে বিরত থাকতে পারে তাহলে এক মাসের এই সংযমের মধ্য দিয়ে সে ধূমপান ত্যাগ করতেও সক্ষম হবে। এছাড়াও অন্য কোন বদঅভ্যাস থাকলেও তা তেকে মুক্ত হওয়ার সময় হলো পবিত্র রোজা। যেহেতু পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে রোজা রাখেন, সেহেতু বদঅভ্যাস ত্যাগ করার প্রচেষ্টায় উত্সাহও তৈরী হয়। রোজার মধ্য দিয়ে রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে আসে। ফলে হূিপণ্ড ও রক্তনালীর উপকার সাধন হয়। এছাড়া রোজার মধ্য দিয়ে যেহেতু দীর্ঘ সময় ক্ষুধানিবারণ হচ্ছে না বরং ধীরে ধীরে ক্ষুধার প্রশিক্ষণ হচ্ছে, ফলে রমজান মাসে শেষে ক্ষুধার মাত্রাও কমে আসে। রোজায় পানাহার থেকে বিরত থাকার কারণে খাদ্যনালীর পরিপাক প্রক্রিয়া আরও কার্যকরী হয়ে ওঠে, ফলে খাদ্যদ্রব্য থেকে বেশী পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ সম্ভব হয়।