হাওর বার্তা ডেস্কঃ এক সময় পল্টন ময়দান ছিল রাজনেতিক সভাসমাবেশের জন্য উন্মুক্ত স্থান। সবার কাছে এক নামে পরিচিত ছিল খোলা ময়দানটি। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সংলগ্ন ময়দানটি এখন অনেকে চিনতেই পারেন না। গত এক দশকে খেলাধুলার অবকাঠামোতে খোলা ময়দানটি এখন চতুর্দিকে ঘেরা এক আবদ্ধ জায়গা।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, এ ময়দানে ৭০ এর দশকে মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা ১৯৯০ ও ২০০০ সালের পরে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা সমাবেশ করেছেন। রাজনৈতিক অধিকারের কথা বলেছেন।
স্টেডিয়াম সংলগ্ন একটি রেস্তোরাঁর কর্মচারী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন জানিয়েছেন, তিনি ১৯৯১ সাল থেকে এ এলাকায় আছেন। তিনি প্রথমদিক ময়দানটি প্রায়ই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশ এমনকি দাঙ্গা-হাঙ্গামায় মুখর দেখতেন। ২০১০ সালেও এ ময়দানের পাশে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম, মোহাম্মদ আলী বক্সিং ফেডারেশন ও একটি ছোট মসজিদ ছাড়া তেমন কোনও স্থাপনাই ছিল না। গুলিস্তান থেকে কোনও প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সরাসরি এ ময়দান প্রবেশ করা যেত।
একই কথা জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বয়স্ক কর্মকর্তা কর্মচারীরা। তারা জানিয়েছেন, এটি ৮০ এর দশকে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের আওতায় ছিল। পরবর্তীতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে হস্তান্তর করা হয়।
এলাকাটি ঘুরে দেখা যায়, ছোট যে ময়দানটি ডিআইটি সড়কের পাশে দেখা যায়, তার পশ্চিম পাশে গড়ে উঠেছে শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্স। এটি ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করা হয়। উত্তর পাশে রয়েছে হ্যান্ডবল স্টেডিয়াম উদ্ধোধন হয় ২০১০ সালের ৩০ অক্টোবর। দক্ষিণ পাশে শহীদ তাজউদ্দীন ইনডোর স্টেডিয়াম, এখানে আছে বাংলাদেশ টেবিল টেনিস ও ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন ও জিমনেসিয়াম।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এখানে কিছু সভা-সমাবেশ হতে দেখা গেলেও আগের মতো প্রাণ ফেরাতে পারেনি। ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এক আদেশে মুক্তাঙ্গনে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ওই সময় হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কয়েকটি ইসলামি সংগঠন মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ ডাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় ডিএমপি এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কোনও সংগঠনকে সেখানে সভার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
এছাড়া সচিবালয়ের পাশে মুক্তাঙ্গন পার্কও দখল করা হয়েছে অবকাঠামো নির্মাণ করে। এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও সর্বশেষ ২০১৩ সালে হেফাজত ইসলাম সমাবেশ করে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মুক্তাঙ্গনের রাজনৈতিক সমাবেশের জায়গায় নির্মাণ করে ময়লা স্থানান্তর কেন্দ্র ও গণশৌচাগার। বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করেও দখল করা হয়েছে জায়গাটি। বর্তমানে বেড়া দিয়ে পুরো এলাকা ঘিরে রেখে জনগণের প্রবেশাধিকার বাধাপ্রাপ্ত করা হয়েছে।
এছাড়াও ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও গণশৌচাগার, খাবার দোকান, কংক্রিটের হাঁটার পথ ও নানা অবকাঠামো দিয়ে জায়গাটি দখল চলছে।
এখন গুলিস্তানের আওয়ামী লীগ কার্যালয়, বিএনপির নয়া পল্টনের কার্যালয় কিংবা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করলেই যানজটের সৃষ্টি হয়।
ফলে রাজনৈতিক সমাবেশের জন্য তেমন কোনও জায়গায়ই অবশিষ্ট নেই যেখানে রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠন তাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সমাগত হতে পারে। সমাবেশের জায়গা হারিয়েও এ বিষয়ে কোনও রাজনৈতিক বা অধিকার নিয়ে কর্মরত সংগঠনই প্রশ্ন তোলেনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, ‘আসলে ময়লা রাখার জন্য শহরের মধ্যে কেউ জায়গা দিতে চায় না। তাই এখানে একটি এসটিএস নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি শিশুদের জন্য খেলাধুলার জায়গা রাখা হয়েছে। বাকি জায়গা গণপরিসর হিসেবে রাখা হয়েছে। জনগণ এখানে প্রবেশ করতে পারবে।’
তিনি জানান, জায়গাটিতে দীর্ঘদিন মানুষের ব্যবহার না থাকায় রেন্ট এ কারের ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গিয়েছিল।
সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে, ঢাকা মহানগর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১৬-৩৫ প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয়। এ পরিকল্পনায়ও রাজনৈতিক সমাবেশের জন্য খোলা জায়গা বা উদ্যান রাখা হয়নি।
এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে এ পরিকল্পনার প্রকল্প পরিচালক ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘না, এভাবে রাজতৈনিক সমাবেশের জন্য আলাদা কোনও জায়গা বরাদ্দ রাখা হয়নি।’ পল্টন ময়দান পরিকল্পনায় কেন সংরক্ষণ করা হয়নি জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা খোলা জায়গা ছিল। এটা রাজনৈতিক সমাবেশের জন্য আলাদাভাবে চিহ্নিত করা ছিল না। এখানে সমাবেশ হতো। কিন্তু এটি একটি স্পোর্টস জোন।’
এ ধরনের সমাবেশের স্থান সংরক্ষণ করা জরুরি কিনা জিজ্ঞেস করা হলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘পৃথিবীর বহু দেশে মুক্তমত চর্চার স্কয়ার পার্ক আছে। বাংলাদেশে থাকা দরকার ছিল। এখনও পরিকল্পনা করে করার সুযোগ আছে। কিন্তু আমাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো জায়গায় অবকাঠামো নির্মাণ করে খোলা জায়গা কমিয়ে ফেলা হচ্ছে।’
তিনি জানান, ‘ঢাকা মহানগর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১৬-৩৫ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মতামত নেওয়া হলেও রাজনীতিবদদের মতামত নেওয়া হয়নি। কিংবা তারাও দাবি দাওয়া পেশ করেননি।’