নিভা মণ্ডল চার বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন। একমাত্র ছেলেটি মারা গেছে তারও দুই বছর আগে। পুত্রবধূ আর নাতিকে নিয়ে তিনজনের সংসার চলত মৎস্য খামারের আয় দিয়ে। কিন্তু মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল খননের পলিমাটিতে ভরাট হয়ে গিয়ে তাঁর সেই আয়ের পথ এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আর সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর চলার পথও। শুধু নিভা মণ্ডল নন, বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার প্রায় দুই শ পরিবারের কাছে মংলা-ঘষিয়াখালী এখন এমনই দুঃসংবাদের নাম।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের খনন করা মাটি পড়ে রামপালের হুড়কা ইউনিয়নের ওই সব পরিবারের বাড়িঘর একাকার হয়ে গেছে। কুমারখালী নদের প্রায় আধা কিলোমিটার থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে হুড়কা ইউনিয়নের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের একাংশ ওই মাটিতে প্রায় ডুবে আছে। দরিদ্র ওই সব পরিবারের বাড়িঘর, পুকুর ও মৎস্য খামার- সবই খনন করা পানিমিশ্রিত পলিমাটিতে ঢাকা পড়ে গেছে। পুকুর বা জলাশয় মাটিতে ভরাট হয়ে এখন সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এ কারণে ক্ষতির শিকার হয়েছে হুড়কা মধ্য ও উত্তরপাড়া গ্রামের প্রায় দুই শ পরিবার। কাদামাটির ওপর দিয়ে এলাকাবাসী বাঁশের সাঁকো তৈরি করে চলাচল করছে।
নিভা মণ্ডল জানান, তাঁর দুই বিঘা জমি রয়েছে। পুকুরে কাঁকড়া আর এক বিঘার মৎস্য খামারে চিংড়ি চাষ করে যে অর্থ পান, তা দিয়েই তাঁর সংসার চলে। কিন্তু মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের খনন করা মাটিতে পুকুর ও মৎস্য খামার ভরাট হয়ে সমতল ভূমিতে পরিণত হওয়ায় এখন মহাবিপদে পড়েছেন।
প্রতিবেশী ঝুম্পা বিশ্বাস জানান, তাঁদের তিন বিঘার চিংড়ি ঘের ছিল, যা এখন মাটিতে ভরাট হয়ে গেছে। এ ছাড়া ঘরবাড়িসহ সব কিছু মাটিতে একাকার হয়ে গেছে। গোয়ালঘরটি মাটিচাপা পড়ায় গরু তিনটি দূরে এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন।
গ্রাম পুলিশ কালীপদ মণ্ডল জানান, এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে তাঁরা দিন পার করছেন। মৎস্য ঘের, ধানের জমিসহ সব কিছু মাটিচাপা পড়েছে। মৎস্য ঘের ভরাট হয়ে গেছে। কয়েক বছরের মধ্যে জমিতে ধান ফলানো যাবে না। কিভাবে সংসার চলবে, সারা দিন এ নিয়েই চিন্তা তাঁর। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী বাড়িঘর ফেলে পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
কিশোর ঘরামি, দেবব্রত কির্তনিয়া, বিকাশ কির্তনিয়া, নমিতা রানী কির্তনিয়া, জ্যোৎস্না কির্তনিয়াসহ ওই দুই গ্রামের কয়েকজন নারী-পুরুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাঁদের ভিটেমাটি এখন নদী খননের পলিমাটিতে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে পানির উৎস হারিয়ে গেছে। মাটি ভরাট হওয়ায় টয়লেটও ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
রামপালের হুড়কা ইউপি চেয়ারম্যান তপন কুমার গোলদার জানান, মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের খনন করা মাটিতে তাঁর ইউনিয়নের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের একাংশে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি ভরাট হয়ে গেছে। তাতে ওই দুই ওয়ার্ডের হুড়কা মধ্যপাড়া ও উত্তরপাড়া গ্রামের দুই শ পরিবার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। এলাকার মানুষ মাছ ও কাঁকড়া চাষের ওপর নির্ভরশীল। চ্যানেল খননের ওই মাটিতে স্থানীয় পুকুর ও মৎস্য খামারগুলো ভরাট হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে জায়গা নির্ধারণ করে খননের মাটি সেখানে ফেলার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ড্রেজিং বিভাগের (বিআইডাব্লিউটিএ) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ এইচ এম ফরহাদ উজ্জামান বলেন, গত ৯ ডিসেম্বর শ্যালা নদীতে তেলের জাহাজডুবির পর চ্যানেল খননের কাজ গতি পায়। খননকাজ দ্রুত করার স্বার্থে পলিমাটি নদীর পাশে সরকারি খাস জমিতে ফেলা হয়। এ সময় পানিযুক্ত মাটি ব্যক্তিমালিকানা জমিতে পড়ে কিছু ক্ষতি করেছে। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, এরপর ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হবে।
এ ব্যাপারে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল পুনর্খনন কাজের অগ্রগতির বিষয়ে গত সোমবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সুন্দরভাবে চ্যানেল খনন ও অপসারিত পলি যথাযথভাবে সংরক্ষণের বিষয়ে বেশকিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ নিয়ে পরবর্তী সভা আগামী সোমবার মংলা বন্দরে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। খনন করা পলিমাটি পাশের এলাকায় গিয়ে জনগণের যে সাময়িক অসুবিধা হচ্ছে, তা দূর করার বিষয়ে ওই সভায় সিদ্ধান্ত হবে। সরকারি খাসজমি ও কিছু নিচু জমি সংরক্ষণ করে খননকৃত পলিমাটি ডাম্পিংয়ের চেষ্টা চালানো হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা ওই প্রকল্প থেকে বিআইডাব্লিউটিএ দেবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি জুনের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত নৌ-প্রটোকলভুক্ত মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল নৌযান চলাচলের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়ার কথা রয়েছে। ৬ মে থেকে জোয়ারের সময় পরীক্ষামূলকভাবে ওই চ্যানেল দিয়ে নৌযান চলাচল করছে।