হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নের ধনপোতা গ্রামে ঘটেছে সবজি চাষের নিরব বিপ্লব। এ গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবার এখন সবজি চাষের সঙ্গে যুক্ত।
আর এতে হতদরিদ্র গ্রামবাসীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি অনেক যুবকের বেকারত্ব ঘুচেছে। ধনপোতা এলাকার রাসয়নিক সার ও কীটনাশক মুক্ত সবজি চাষ যেন অন্যান্য এলাকার কৃষকদের কাছে একটি রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
সবজি চাষে উজ্জল এ গ্রামটির মতো অর্গানিক সবজি চাষ পদ্ধতি এক সময় পুরো জেলাতেই ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা ব্যক্ত করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আজিজুর রহমান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নের ধনপোতা গ্রামে ঘেরের পাড়ের ৪০০ একর জমিতে অর্গানিক পদ্ধতিতে হচ্ছে সবজি চাষ। স্মলহোল্ডার এগ্রিকালচারাল কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্ট (এসএসিপি) প্রকল্পের আওতায় এ গ্রামের চারশ চাষিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব চাষিরা পতিত জমি, উচু জমি ও মৎস্য ঘেরের পাড়ে অর্গানিক পদ্ধতিতে মৌসুমি সবজি চাষ করে থাকেন। প্রতি বছর এই এক গ্রাম থেকে ১২ হাজার মেট্রিকটন সবজি উৎপাদন হয়। এসব সবজি থেকে চাষিদের প্রতি বছর অন্তত পাঁচ কোটি টাকার বেশি আয় হয়।
শুধু গেল দুই মাসেই এ গ্রামের চাষিরা সবজি বিক্রি করেছেন অন্তত আড়াই কোটি টাকার। আর চাষিদের এসব ক্ষেত নিয়মিত পরিদর্শণসহ বিভিন্ন কারিগরি পরামর্শ দিয়ে থাকেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকালে ধনপোতা গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে মাঠের পর মাঠ সবুজের সমারোহ। সবুজ গালিচার মাচায় ঝুলছে উচ্চ ফলনশীল চালকুমড়া, তরমুজ, মিষ্টিকুমড়া, শসা, কুসিসহ নানান ধরনের সবজি। এছাড়া ঘেরের পাড় ঘিরে লাগানো হয়েছে ঢেরস, পেপে ও কলা। ক্ষেত থেকে এসব সবজি তুলে চাষিরা সগেুলো নিয়ে আসেন নিকটস্থ কালেকশন পয়েন্টে (যেখান থেকে ব্যবসায়ীরা সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে সবজি ক্রয় করেন)। সেখান থেকে ট্রাক ভর্তি সবজি পদ্মা সেতু হয়ে চলে যায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়।
নিজগ্রামে বসেই সবজি বিক্রি করতে পারায় চাষিদের যেমন পরিবহন খরচ কমছে, তেমনি মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরত্ব কমেছে সবজি ব্যবসায়। এতে ন্যায্য মূল্য পেয়ে দ্বিগুন লাভবান হচ্ছেন চাষিরা।
সবজি চাষি রবিউল শেখ বলেন, ঘেরে মাছ চাষের পাশাপাশি পাড়ে আমরা সবজি চাষ করি। কোনো প্রকার রাসয়নিক সার বা কীটনাশক আমরা ব্যবহার করি না। পোকামাকড় দূর করতে শুধু নিম পাতার রস ও মেহগুনীর ফলের তৈরি তরল পদার্থ স্প্রে করা হয়। সার হিসেবে ব্যবহার করি ভার্মি কম্পোস্ট ও জৈব সার। এ কারণে সব জায়গাতেই আমাদের এলাকার সবজির খ্যাতি রয়েছে।
রহিমা বেগম নামে আরেক নারী সবজি চাষি বলেন, ক্ষেত থেকে তুলে রাস্তায় নিয়ে রাখলেই আমাদের কাজ শেষ। পাইকারি সবজি ব্যবসায়ীরা ন্যায্য মূল্যে আমাদের এসব সবজি কিনে নিয়ে যান। এ জন্য আমাদের কোনো হয়রানিতেও পড়তে হয় না।
স্বপন কৃত্যনিয়া নামের আরেক চাষি বলেন, সবজি চাষে প্রতি বছর অন্তত পাঁচ লাখ টাকার বেশি আয় করি। দুই বিঘার ঘেরে সবজি চাষ করতে আমার ব্যয় হয় সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকা। এই সবজি চাষ করেই আমি বাড়ি, মোটরসাইকেল ও গরু কিনেছি। শুধু আমি একাই না, ধনপোতা গ্রামের অনেক মানুষই সবজি চাষ করে স্বচ্ছলতা পেয়েছেন।
ফকিরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. নাছরুল মিল্লাত বলেন, এসএসিপি প্রকল্পের আওতায় আমরা চার শতাধিক চাষিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাদের সফলতা দেখে অন্যান্য চাষিরাও অর্গানিক এবং আধুনিক পদ্ধতিতে সবজি চাষের দিকে ঝুকছেন। এছাড়া এখানে উৎপাদিত সবজি সরাসরি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করার জন্য ধনপোতা এলাকায় কয়েকটি কালেকশন পয়েন্ট করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে সরাসরি সবজি বিক্রি করতে পেরে চাষিরা অনেক লাভবান হচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাগেরহাটের উপ-পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, ধনপোতা গ্রামে কৃষির একটি নিরব বিপ্লব ঘটেছে। অর্গানিক পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে চাষিরা যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি ভোক্তারাও উপকৃত হচ্ছেন। ভবিষ্যতে ধনপোতা গ্রামকে রোল মডেল করে পুরো জেলায় এ চাষ পদ্ধতি ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।