ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছে না এমন কথা চাউর হলেও এ ইস্যুতে কথা বলবে বাংলাদেশ। এখনই স্বাক্ষর করতে হবে এমন কোনো চাপ না থাকলেও সীমান্ত চুক্তির পর এটাই বাংলাদেশের প্রধান প্রত্যাশা। যদিও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিমধ্যেই বলেছেন, তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছে না। তারপরও দেশের স্বার্থ বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এ বিষয়টি উত্থাপন করবেন। আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পাশাপাশি দুই শীর্ষ নেতার একান্ত বৈঠকেও উঠে আসবে তিস্তা চুক্তি প্রসঙ্গ। আলোচনার মাধ্যমে এ ইস্যুতে নাটকীয় কিছু ঘটেও যেতে পারে। কারণ তিস্তা চুক্তির খসড়া এখন এমন অবস্থায় আছে, এটি যে কোনো মুহূর্তে স্বাক্ষর করা যেতে পারে।
দুই দিনের সফরে আগামীকাল বাংলাদেশে আসছেন মোদি। এদিন বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্ত আলোচনা এবং পরে তাদের নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসবে প্রতিবেশী দুই দেশ। আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে নিরাপত্তা, যোগাযোগ, উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য। এতে ৫১টি এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হবে। সফর শেষে রবিবার যে যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হবে তাতেও থাকবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত। জানা যায়, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরকালেই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করার প্রস্তুতি নিয়েছিল বাংলাদেশ। ওই সময়ে চুক্তি স্বাক্ষর না হওয়ায় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তার পানি ভাগাভাগির ফর্মুলা চূড়ান্ত করার পরও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। মমতা শেষ মুহূর্তে তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করে মনমোহনের সফরসঙ্গীর তালিকা থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন। এবার তিনি শর্তসাপেক্ষে সফরসঙ্গী হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে মোদির আনুষ্ঠানিক বৈঠককালে মমতা উপস্থিত থাকবেন। তিস্তা ইস্যু যাতে আলোচনার এজেন্ডায় না আসে সেটা তিনি নিজে উপস্থিত থেকে নিশ্চিত হতে চান। তবে ঢাকায় কূটনৈতিক সূত্র বলছে, বাংলাদেশ তিস্তা ইস্যু মমতার সামনেই মোদির কাছে উত্থাপন করবে। বাংলাদেশ মনে করে, তিস্তা ইস্যুর সঙ্গে যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার জড়িত, তাই বিষয়টি নিয়ে মোদি ও মমতার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার এটাই উপযুক্ত সময়। এ বিষয়ে দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেছেন, নিয়মিত সাক্ষাৎ ও আলোচনা সব সময়েই যে কোনো চুক্তি সম্পাদনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। আমরা এই অগ্রগতিকে (মোদির সফরকালে মমতার সফর) উষ্ণতার সঙ্গে স্বাগত জানাই। এটা সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে, প্রধানমন্ত্রী মোদি সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে সমঝোতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিলেন। আমরা আশা করি, তিস্তা ইস্যুর নিষ্পত্তি হবে। তবে এটা সম্ভবত এবারকার আলোচনায় হবে না, তবে আগামী আলোচনাগুলোতে হবে। এখন পর্যন্ত এ সফরে মমতা ব্যানার্জি যাচ্ছেন সীমান্ত চুক্তির অনুসমর্থন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু যেহেতু তিন নেতাই সেখানে থাকবেন, ফলে তিস্তাসহ অপরাপর ইস্যুতে আলোচনার জন্য এটা উপযুক্ত জায়গা হবে। সূত্রমতে, দুই দেশের বৈঠকে যেসব ইস্যুতে আলোচনা হবে তার মধ্যে রয়েছে- ভারতে লুকিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের গ্রেফতার, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, ঝুঁকিপূর্ণ পথে বেড়া নির্মাণ, বেনাপোল-পেট্রাপোলে যৌথ জরিপ ও সীমানা খুঁটি নির্দিষ্টকরণ, বন্দরে বিধিনিষেধ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, স্থলবন্দরে কর্মদিবসের সুসংগঠন, খোয়াইঘাট-বাল্লা সীমান্ত এলাকার স্থানান্তর করা, ইপিজেডে ভারতের বিনিয়োগের আগ্রহ, ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের এলওসি পর্যালোচনা এবং ২০০ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তা অনুমোদন নিয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত দেওয়া, ডিসি/ডিএম পর্যায়ের বৈঠক, যৌথ আইনি সহায়তা, এফটির অপহরণ করা ভারতীয় নাগরিকদের দেশে ফেরত, আসামিদের হস্তান্তর, ভারতে পলাতক আসামিদের ফেরত, মাদকদ্রব্য ও চোরাচালান বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ, মানব পাচার নিয়ে চুক্তি, জাল মুদ্রা বিষয়ক চুক্তি, বাংলাদেশ ও ভারতের কোস্টগার্ডের মধ্যে চুক্তি, সারদা পুলিশ একাডেমিতে আইটি ল্যাব স্থাপন, ভেড়ামারা-বাহরামপুর গ্রিড থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ হস্তান্তর, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি, পালটানা ফেজ-২ থেকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ, ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ত্রিপুরা থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এলাকা থেকে বিদ্যুৎ এবং নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আনয়ন, গ্যাস অনুসন্ধান, নুমালিগড় থেকে পাইপলাইনে ডিজেল ও পেট্রোলিয়াম সরবরাহ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ত্রি-জাতির গ্যাসের লাইন স্থাপন, পারমাণবিক জ্বালানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন বিষয়ক সহযোগিতা, বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠক, বিএসটিআইর পণ্য মানে ভারতের স্বীকৃতি না দেওয়া, আরও সীমান্ত হাট স্থাপন, তৈরি পোশাকের প্রবেশাধিকার, উন্নয়ন সমন্বয় বিষয়ক ডলার লাইন ক্রেডিট চুক্তি, পাট ও টেক্সটাইল খাতের সহযোগিতা, স্বাস্থ্য, পর্যটন, শিক্ষা, আইসিটি, মৎস্য ও কৃষি খাতে সহযোগিতা, যৌথ কর্মশালা, গবেষণা প্রকল্প, খাদ্য নিরাপত্তা, বায়ো-ইনফরমেটিক্স বিষয়ে প্রশিক্ষণ, চামড়া নিয়ে গবেষণা, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সহযোগিতা চুক্তি। অন্যান্য ইস্যুর মধ্যে রয়েছে- ই-যোগাযোগ ও উপ-আঞ্চলিক বিষয়ক সহযোগিতা, রেলওয়ে যোগাযোগ, সৈয়দপুর রেল ওয়ার্কসপের সংস্কার কাজের জন্য বাংলাদেশের অনুরোধ, মৈত্রী এক্সপ্রেসে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন সুবিধা সৃষ্টি, দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস চালু, বিরল-রাধিকাপুর রেল সংযোগ স্থাপন, রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ, শাহজাদপুর-মহিশ্মশান রেল সংযোগ, চিলাহাটি-চেংড়াবান্ধা রেল সংযোগ, আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ, ফেনী-বিলুনিয়া রেল যোগাযোগ স্থাপন, খুলনা-মংলা রেললাইন সংস্কার, বাংলাদেশ-ভারত কনটেইনার সার্ভিস নিয়ে আলোচনা হয়। যশোরের সিঙ্গিয়ায় কনটেইনার হ্যান্ডলিং, ঈশ্বরদী পিকিউআরএএস মাল্টিমডেল এক্সচেঞ্জ, ঢাকা-শিলং-গুহাটি বাস সার্ভিস, কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস বিবি আইএন মোটর যন্ত্রাংশ বিষয়ক চুক্তি, আশুগঞ্জ টু আখাউড়া চারলেন সড়ক, ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণ, শিপিং করপোরেশন, পায়রা সমুদ্র বন্দর, ত্রিপুরায় ২৫০০০ মেট্রিক টন খাদ্যপণ্য পরিবহন, আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালের (আইসিটি) উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়। সূত্র জানায়, সফরে কার্গো কনটেইনার স্থানান্তর, পিআইডব্লিউটিটির মাধ্যমে জাহাজে ও ক্রুসে যাত্রী পরিবহন চালু, মংলা বন্দরে ড্রেজিং, মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে প্রবেশাধিকার, আশুগঞ্জ নদীবন্দর উন্নয়নে ভারতের আগ্রহ, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ভারত সানচর নিগাম লিমিটেডের মধ্যে চুক্তি, পানি উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা, ৩৮তম জেআরসি মিটিং, গঙ্গা বাঁধ, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি চুক্তি, ফেনী নদীর পানির স্রোতে যৌথ পর্যবেক্ষণ, টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প অন্যান্য আন্তঃনদীর পানি ভাগাভাগি, নদীর সংযোগ, কহুয়া নদী তীর রক্ষার কাজ, শুভরম শহর রক্ষা, অন্যান্য নদী তীর রক্ষা, সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং ড্রেনেজ প্রকল্প, সুরমা-কুশিয়ারা বিলুনিয়া সংযোগ প্রকল্প, বন্যা পূর্বাভাস, মানুষে মানুষে যোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক বিনিময়, খুলনা ও সিলেটে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন স্থাপন, ভারতে বাংলাদেশি স্যাটেলাইট টিভির সম্প্রচার চালু, শান্তি নিকেতনে বাংলাদেশ ভবন স্থাপন, বাংলাদেশে ভারতের স্টেট অব দ্য আর্ট কালচারাল সেন্টার, ভারত কর্তৃক শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্র ভবন স্থাপন, উচ্চ প্রতিনিধিদের পরিদর্শন, ভারতীয় সৈন্যদের সম্মাননা, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার (জেএমআই) সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চুক্তি এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অশনোগ্রাফির সঙ্গে ঢাবির চুক্তি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া কেন্দ্র হস্তান্তর বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। এর মধ্যে প্রায় ২০টি ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি, সমঝোতা, স্মারক ও বিনিময়পত্র হস্তান্তর হবে।