ঢাকা ১২:৩৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জীবনবাজি যুদ্ধে বানভাসি মানুষ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৪৫:০৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জুন ২০২২
  • ১১৬ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সিলেট ও সুনামগঞ্জের ঘরে-বাইরে শুধুই থই থই পানি। বানের পানির তোড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। অনেকের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু নেই। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে বানভাসিদের। সব হারিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে তারা। গ্রামে গ্রামে পাকা ঘর ছাড়া কাঁচা কোনো ঘরের অস্তিত্ব নেই।

আধাপাকা ঘরগুলো দাঁড়িয়ে থাকলেও ঘরের বেড়া অথবা আসবাবপত্র বলতে কিছুই নেই। বানের পানিতে আসবাবপত্র, হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, মাছ ধরার জাল ভেসে গেছে। তিল তিল করে যে সংসার সাজিয়েছিল তারা তা এখন শুধুই অতীত।

সরকারি সহায়তা ছাড়া কারও কিছুই করার সামর্থ্য নেই। এদিকে বন্যাকবলিত সুনামগঞ্জ শহরের ৫০ শতাংশ এলাকায় চারদিন পর বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোতে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে।

হবিগঞ্জের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক স্থানে নেই বিদ্যুৎ। নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মৌলভীবাজারে মনু নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে।

এ কারণে নদী তীরের কয়েক লাখ মানুষ বন্যা ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া কুশিয়ারা ও ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সাত উপজেলার প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ সম্পর্কে ব্যুরো ও প্রতিনিধির পাঠানো খবর :

সিলেটের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে। সুরমা নদীর পানি ধীরে ধীরে কমলেও কুশিয়ারার পানি বাড়ছে। নগরীর নিম্নাঞ্চলের বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে আছে। উপশহরের প্রধান সড়কে হাঁটুসমান পানি। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নামলেও বাড়ছে দুর্ভোগ।

ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হলেও দুর্গন্ধের কারণে বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। খাদ্য সংকটের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার। মহাসড়কে খোলা আকাশের নিচে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে দিনযাপন করছেন। কেউ রাত কাটাচ্ছেন যানবাহনে।

সোমবার সকাল থেকে গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দীরগাঁও এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পানি। পাকা ঘর ছাড়া কাঁচা কোনো ঘরের অস্তিত্ব নেই। আধাপাকা ঘরগুলো দাঁড়িয়ে থাকলেও পানির তোড়ে নেই বেড়া কিংবা ঘরের আসবাবপত্র।

লামাপাড়া গ্রামের আলী হোসেন ও লায়লা দম্পতি চার সন্তান নিয়ে বাস করতেন টিনের একটি ঘরে। দরিদ্র হওয়ায় গ্রামবাসীরা চাঁদা তুলে ঘর করে দিয়েছিলেন তাদের। এবারের বন্যার দ্বিতীয় দিনে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন তারা। ঘর থেকে পানি নেমেছে জেনে বাড়ি ফিরেছেন সোমবার সকালে।

ঘরে ঢুকেই মাথায় হাত আলী হোসেনের। তিল তিল করে যে নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র জমিয়েছিলেন, তার ছিটেফোঁটাও নেই। পানির তোড়ে ঘরের টিনের বেড়া ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছে থালাবাসন, আসবাবপত্র আর কাপড়চোপড়।

লায়লা বেগম জানান, মানুষের সহায়তায় একটি ঘর পেয়েছিলেন। এবার গ্রামের সব মানুষেরই একই অবস্থা, কে কাকে সাহায্য করবে। চার সন্তান নিয়ে এখন কীভাবে থাকবেন এ ঘরে-এমন দুশ্চিন্তায় দিশেহারা তিনি।

একই অবস্থা দাড়িপাড়া গ্রামের সহদেবের, বন্যার পানির তোড়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনোরকমে গ্রামের একটি দোতলা বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পানি কমতে থাকায় নিজের ঘরের খোঁজ নিতে আসেন।

কিন্তু এসেই দেখেন এখনো তার ঘরের ওপর দিয়ে বইছে পানি। ঘরের ভেতরের আসবাবপত্র কী আছে, তাও দেখার সুযোগ নেই। তবে অনুমান করছেন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। একই গ্রামের ঘনই নমঃশূদ্র, নিজের নৌকা থাকায় পানি আসার পরই সব রেখে বাড়ি ছেড়েছিলেন, পানির তোড়ে তার ঘর এখন নিশ্চিহ্ন।

আসবাবপত্র তো দূরে থাক, ঘরের চালও নিয়ে গেছে বন্যার পানি। দুটি ছাগল ছিল, তাও মারা গেছে। তিনি জানান, এখন সরকারি সহায়তা ছাড়া তার আর ঘর তৈরির সামর্থ্য নেই। স্থানীয়রা জানান, গ্রামে টিনশেড ও কাঁচাঘরের আর অস্তিত্ব নেই।

এদিকে সরকারি ত্রাণ পর্যাপ্ত না হওয়ায় বন্যার্তদের পাশে বিভিন্ন সংগঠন দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসেও শঙ্কা রয়েছে। ঢাকা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, সিলেট বিভাগজুড়ে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে।

আসাম, মেঘালয়েও বন্যা হওয়ায় অতি ভারি বৃষ্টি মিলিয়ে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। সিলেটে জুনজুড়ে মাঝামাঝি ধরনের ভারি বৃষ্টি থেকে অতি ভারি বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১৮ সেন্টিমিটার ও সিলেট (নগরী) পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার কমেছে।

একই সময়ে কুশিয়ারা নদীর পানি শেরপুর পয়েন্টে কমলেও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার বেড়েছে। অবশ্য সারি ও লোভাছড়া নদীর পানি কমেছে। পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী একেএম নিলয় পাশা জানান, কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ার কারণে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কিছু এলাকা নতুন করে প্লাবিত হতে পারে।

এছাড়া গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, সদর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ থেকে পানি ধীরে ধীরে কমছে। দুর্গকুমার পাঠশালায় ছড়ারপাড় এলাকার বাসিন্দা লিটন মিয়া শুক্রবার আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন।

এদিন তাকে কিছু লোক রান্না করা খাবার দিয়ে যান। এরপর আর কোনো সহায়তা পাননি লিটন। তিনি বলেন, ‘একদিন কেবল খাবার পেয়েছিলাম। এরপর আর কিছু পাইনি। এখানে রান্নার সুযোগ নেই। তাই খুব কষ্টে আছি।’

একই এলাকার মোহাম্মদ আলী জানান, তিন দিনে তিনি কোনো সরকারি ত্রাণ পাননি। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে কয়েকজন রান্না করা খাবার দিয়েছেন।

শুধু এ আশ্রয়কেন্দ্র নয়, সিলেটের সব আশ্রয়কেন্দ্রের চিত্রই এমন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় ঠাঁই নেওয়া বানভাসি মানুষ ভুগছেন খাবারের তীব্র সংকটে। নগরীতে সরকারি উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়নি।

পানিবন্দি মানুষের মধ্যে চলছে খাবারের জন্য হাহাকার। এ অবস্থায় সরকারি ত্রাণের পাশাপাশি বানভাসি মানুষের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা প্রতিদিনই ছুটছেন দুর্গতদের পাশে।

ত্রাণ হিসাবে শুকনো ও রান্না করা খাবার দিচ্ছেন। আশ্রয়ের জন্য সিলেট নগরীর অনেকে নিজেদের বাসা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে নৌকা। ছোট নৌকা দিয়ে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ দিতে যাওয়া লোকজনকে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে।

সিলেটের প্রাচীন প্রতিষ্ঠান লতিফ ট্রাভেলস বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করছে। নগরীর সোবহানীঘাট, মৌবন ও যতরপুর এলাকার প্রায় এক হাজার মানুষের মধ্যে চিড়া, মুড়ি, গুড়, ব্রেড, বিস্কুট, মোমবাতি, দিয়াশলাইসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিতরণ করা হয়।

লতিফ ট্রাভেলসের পরিচালক জহিরুল কবীর চৌধুরী শিরু জানান, সোমবার বন্যার্তদের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বন্ধন সমাজকল্যাণ সংস্থা সিলেট সদর উপজেলার সাহেববাজার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাহেববাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা আশ্রয়কেন্দ্রের ৮০০ বন্যার্তের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করে।

নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য জেলা পুলিশের খাদ্য ও ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।

বন্যাকবলিত সুনামগঞ্জ শহরের ৫০ শতাংশ এলাকায় চার দিন পর বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা মশিউর জানান, গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোতে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে।

আরও এলাকায় দেওয়ার জন্য কাজ করা হচ্ছে। তবে যে এলাকা থেকে পানি নামবে না সেখানে বিদ্যুৎ দেওয়া হবে না। সোমবার বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে এসব এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, শহরের ৫০ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। বন্যার কারণে বৃহস্পতিবার থেকে সুনামগঞ্জের একের পর এক এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। সোমবার হাসপাতাল, কারাগার, ডিসি অফিস ও সদর থানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।

জগন্নাথপুর উপজেলার অধিকাংশ বাড়িঘরে হাঁটুপানি-কোমরপানি। রাস্তাঘাটে বুকসমান পানি, সাঁতার পানি। চারদিকে পানি আর পানি। ঘরে পানি ওঠায় মানুষ নৌকায় আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে।

তবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় ঠাঁই মিলছে না। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা। সিলেট বিভাগীয় শহরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান সড়ক জগন্নাথপুর-সিলেট সড়ক, জগন্নাথপুর-সুনামগঞ্জসহ জগন্নাথপুর উপজেলা সদরের সঙ্গে যাতায়াতের সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে।

গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। সোমবার পর্যন্ত জগন্নাথপুরের প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

সরেজমিন কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় ঠাঁই মিলছে না বানভাসি মানুষের। জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ ভবনে শত শত মানুষ আশ্রয় নিলেও সেখানে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। আলিয়া মাদ্রাসা, জগন্নাথপুর পৌরসভা ভবন, জগন্নাথপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ প্রতিটি কেন্দ্রে মানুষের উপচে পড়া ভিড়।

এসব কেন্দ্রে ত্রাণের জন্য আহাজারি চলছে। জগন্নাথপুর উপজেলা আবাসিক (বিদ্যুৎ) প্রকৌশলী আজিজুল ইসলাম জানান, সিলেটের বরইকান্দি বিদ্যুতের সাবস্টেশন পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করা হয়েছে। ওই সাবস্টেশন থেকে জগন্নাথপুরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

সুনামগঞ্জের ছাতকে ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা বন্যায় পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সুরমা ও বটের নদীর পানি ছাতকে বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ৫ দিন ধরে সারা দেশের সঙ্গে ছাতকের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। গাড়ির বদলে এখন নৌকা চলছে ছাতক সড়কে। সোমবার বন্যার পানি কমলেও এখনো সড়ক যোগাযোগ চালু হয়নি।

ছাতক ও সুনামগঞ্জ গ্রিড উপকেন্দ্র প্লাবিত হওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। তবে সোমবার সকাল থেকে উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় বিদ্যুৎ চালু হয়েছে। আংশিকভাবে ইন্টারনেটও চালু হয়েছে।

এদিকে ৬০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো সরকারিভাবে কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের বড়কাপন, মনবেগ এলাকা ও গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক রেললাইনের পাশের উঁচু জায়গায় তাঁবু টাঙিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বানভাসি মানুষ।

মদন ও খালিয়াজুরিতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। অন্য উপজেলাগুলোয় পানি অপরিবর্তিত আছে। ৩২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে দেড় লাখ মানুষ ঠাঁই নিয়েছে। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহনলাল সৈকত জানান, উব্দাখালি নদীর পানি কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে।

খালিয়াজুরির ধনু নদের পানি বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ভারি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও বারহাট্টায় বন্যার পানি কমতে শুরু করছে।

মদনের ইউএনও বুলবুল আহমেদ জানান, মদনে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গোবিন্দশ্রী, তিয়শ্রী, ফতেপুরসহ বেশ কিছু ইউনিয়নের প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা পানির নিচে। জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ৩২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে এক লাখের বেশি মানুষ ঠাঁই নিয়েছেন।

এছাড়া ১৫ হাজারের মতো গবাদিপশু নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে। কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হাসেম জানান, শনিবার রাত থেকে কলমাকান্দায় পানি কমছে। এখনো ৮০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে আছে।

দুর্গাপুরের ইউএনও রাজীব উল আহসান জানান, দুর্গাপুরে বন্যার পরিস্থিতি বেশ উন্নতির দিকে। পৌর শহরে এখন পানি নেই। তবে গাকান্দিয়া, চণ্ডীগড়, বিরিশিরিসহ কয়েকটি ইউনিয়নে পানি ধীর গতিতে নামছে। পানি কমলেও দুর্ভোগ এখনো কমেনি।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া পরিবারগুলো বিপাকে পড়েছে। অনেক স্থানে বিদ্যুৎ নেই। কুপিবাতির আলোই তাদের একমাত্র ভরসা। মানুষজনের হাতে কেরোসিন কেনার টাকাও নেই।

বুল্লা সিংহগ্রাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া পূর্ব বুল্লা গ্রামের কবির মিয়া জানান, ৪ দিন ধরে তিনি পরিবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু এখনো কোনো ত্রাণ পাননি।

কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে। লাখাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন জানান, পর্যায়ক্রমে সবাইকে ত্রাণ দেওয়া হবে। অতি দুর্গত এলাকাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। কাউকেই বাদ দেওয়া হবে না।

মনু নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে নদী তীরের কয়েক লাখ মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে। কুশিয়ারা ও ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাকালুকি, কাউয়াদিঘি, হাইল হাওড়সহ বিভিন্ন হাওড়ের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

সাত উপজেলার প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পৌর শহরের মাইজপাড়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৪৩টি ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। এখনকার বাসিন্দারা চরম বিপাকে পড়েছে।

নদী প্রতিরক্ষা বাঁধের বাইরে অপরিকল্পিতভাবে ঘরগুলো নির্মাণ করায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। জেলায় ৪২টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৪০ হাজার পরিবার। জেলাজুড়ে ১০১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

কমলগঞ্জ উপজেলায় পাহাড়ি ঢলে ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আতঙ্কিত গ্রামবাসী প্রতিরক্ষা বাঁধের কয়েকটি স্থানে স্বেচ্ছাশ্রমে গাছ ও মাটিভর্তি বস্তা ফেলে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেন। এলাকাবাসী নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।

রোববার রাতে পতনঊষার ইউনিয়নে লাঘাটা নদীর ঘোপীনগরে বাঁধ ভেঙে দুটি গ্রামের ৩০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কান্দিগাঁও এলাকার পানিবন্দি সাতির মিয়া জানান, লাঘাটা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি বাড়ি-ঘর ও রাস্তায় উঠে যায়। চেষ্টা করেও ভাঙন ঠেকানো যায়নি।

দেওয়ানগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চুকাইবাড়ী ইউনিয়নের গুজিমারী, বালুগ্রাম, কেল্লাকাটা, সাঁকোয়াপাড়া, রামপুরাসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

চুকাইবাড়ী গুচ্ছগ্রাম তলিয়ে যাওয়ায় গুচ্ছগ্রামবাসীকে দেওয়ানগঞ্জ রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সোমবার দেওয়ানগঞ্জ বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ২১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

জীবনবাজি যুদ্ধে বানভাসি মানুষ

আপডেট টাইম : ০৯:৪৫:০৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জুন ২০২২

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সিলেট ও সুনামগঞ্জের ঘরে-বাইরে শুধুই থই থই পানি। বানের পানির তোড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। অনেকের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু নেই। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে বানভাসিদের। সব হারিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে তারা। গ্রামে গ্রামে পাকা ঘর ছাড়া কাঁচা কোনো ঘরের অস্তিত্ব নেই।

আধাপাকা ঘরগুলো দাঁড়িয়ে থাকলেও ঘরের বেড়া অথবা আসবাবপত্র বলতে কিছুই নেই। বানের পানিতে আসবাবপত্র, হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, মাছ ধরার জাল ভেসে গেছে। তিল তিল করে যে সংসার সাজিয়েছিল তারা তা এখন শুধুই অতীত।

সরকারি সহায়তা ছাড়া কারও কিছুই করার সামর্থ্য নেই। এদিকে বন্যাকবলিত সুনামগঞ্জ শহরের ৫০ শতাংশ এলাকায় চারদিন পর বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোতে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে।

হবিগঞ্জের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক স্থানে নেই বিদ্যুৎ। নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মৌলভীবাজারে মনু নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে।

এ কারণে নদী তীরের কয়েক লাখ মানুষ বন্যা ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া কুশিয়ারা ও ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সাত উপজেলার প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ সম্পর্কে ব্যুরো ও প্রতিনিধির পাঠানো খবর :

সিলেটের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে। সুরমা নদীর পানি ধীরে ধীরে কমলেও কুশিয়ারার পানি বাড়ছে। নগরীর নিম্নাঞ্চলের বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে আছে। উপশহরের প্রধান সড়কে হাঁটুসমান পানি। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নামলেও বাড়ছে দুর্ভোগ।

ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হলেও দুর্গন্ধের কারণে বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। খাদ্য সংকটের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার। মহাসড়কে খোলা আকাশের নিচে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে দিনযাপন করছেন। কেউ রাত কাটাচ্ছেন যানবাহনে।

সোমবার সকাল থেকে গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দীরগাঁও এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পানি। পাকা ঘর ছাড়া কাঁচা কোনো ঘরের অস্তিত্ব নেই। আধাপাকা ঘরগুলো দাঁড়িয়ে থাকলেও পানির তোড়ে নেই বেড়া কিংবা ঘরের আসবাবপত্র।

লামাপাড়া গ্রামের আলী হোসেন ও লায়লা দম্পতি চার সন্তান নিয়ে বাস করতেন টিনের একটি ঘরে। দরিদ্র হওয়ায় গ্রামবাসীরা চাঁদা তুলে ঘর করে দিয়েছিলেন তাদের। এবারের বন্যার দ্বিতীয় দিনে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন তারা। ঘর থেকে পানি নেমেছে জেনে বাড়ি ফিরেছেন সোমবার সকালে।

ঘরে ঢুকেই মাথায় হাত আলী হোসেনের। তিল তিল করে যে নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র জমিয়েছিলেন, তার ছিটেফোঁটাও নেই। পানির তোড়ে ঘরের টিনের বেড়া ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছে থালাবাসন, আসবাবপত্র আর কাপড়চোপড়।

লায়লা বেগম জানান, মানুষের সহায়তায় একটি ঘর পেয়েছিলেন। এবার গ্রামের সব মানুষেরই একই অবস্থা, কে কাকে সাহায্য করবে। চার সন্তান নিয়ে এখন কীভাবে থাকবেন এ ঘরে-এমন দুশ্চিন্তায় দিশেহারা তিনি।

একই অবস্থা দাড়িপাড়া গ্রামের সহদেবের, বন্যার পানির তোড়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনোরকমে গ্রামের একটি দোতলা বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পানি কমতে থাকায় নিজের ঘরের খোঁজ নিতে আসেন।

কিন্তু এসেই দেখেন এখনো তার ঘরের ওপর দিয়ে বইছে পানি। ঘরের ভেতরের আসবাবপত্র কী আছে, তাও দেখার সুযোগ নেই। তবে অনুমান করছেন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। একই গ্রামের ঘনই নমঃশূদ্র, নিজের নৌকা থাকায় পানি আসার পরই সব রেখে বাড়ি ছেড়েছিলেন, পানির তোড়ে তার ঘর এখন নিশ্চিহ্ন।

আসবাবপত্র তো দূরে থাক, ঘরের চালও নিয়ে গেছে বন্যার পানি। দুটি ছাগল ছিল, তাও মারা গেছে। তিনি জানান, এখন সরকারি সহায়তা ছাড়া তার আর ঘর তৈরির সামর্থ্য নেই। স্থানীয়রা জানান, গ্রামে টিনশেড ও কাঁচাঘরের আর অস্তিত্ব নেই।

এদিকে সরকারি ত্রাণ পর্যাপ্ত না হওয়ায় বন্যার্তদের পাশে বিভিন্ন সংগঠন দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসেও শঙ্কা রয়েছে। ঢাকা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, সিলেট বিভাগজুড়ে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে।

আসাম, মেঘালয়েও বন্যা হওয়ায় অতি ভারি বৃষ্টি মিলিয়ে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। সিলেটে জুনজুড়ে মাঝামাঝি ধরনের ভারি বৃষ্টি থেকে অতি ভারি বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১৮ সেন্টিমিটার ও সিলেট (নগরী) পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার কমেছে।

একই সময়ে কুশিয়ারা নদীর পানি শেরপুর পয়েন্টে কমলেও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার বেড়েছে। অবশ্য সারি ও লোভাছড়া নদীর পানি কমেছে। পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী একেএম নিলয় পাশা জানান, কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ার কারণে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কিছু এলাকা নতুন করে প্লাবিত হতে পারে।

এছাড়া গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, সদর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ থেকে পানি ধীরে ধীরে কমছে। দুর্গকুমার পাঠশালায় ছড়ারপাড় এলাকার বাসিন্দা লিটন মিয়া শুক্রবার আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন।

এদিন তাকে কিছু লোক রান্না করা খাবার দিয়ে যান। এরপর আর কোনো সহায়তা পাননি লিটন। তিনি বলেন, ‘একদিন কেবল খাবার পেয়েছিলাম। এরপর আর কিছু পাইনি। এখানে রান্নার সুযোগ নেই। তাই খুব কষ্টে আছি।’

একই এলাকার মোহাম্মদ আলী জানান, তিন দিনে তিনি কোনো সরকারি ত্রাণ পাননি। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে কয়েকজন রান্না করা খাবার দিয়েছেন।

শুধু এ আশ্রয়কেন্দ্র নয়, সিলেটের সব আশ্রয়কেন্দ্রের চিত্রই এমন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় ঠাঁই নেওয়া বানভাসি মানুষ ভুগছেন খাবারের তীব্র সংকটে। নগরীতে সরকারি উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়নি।

পানিবন্দি মানুষের মধ্যে চলছে খাবারের জন্য হাহাকার। এ অবস্থায় সরকারি ত্রাণের পাশাপাশি বানভাসি মানুষের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা প্রতিদিনই ছুটছেন দুর্গতদের পাশে।

ত্রাণ হিসাবে শুকনো ও রান্না করা খাবার দিচ্ছেন। আশ্রয়ের জন্য সিলেট নগরীর অনেকে নিজেদের বাসা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে নৌকা। ছোট নৌকা দিয়ে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ দিতে যাওয়া লোকজনকে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে।

সিলেটের প্রাচীন প্রতিষ্ঠান লতিফ ট্রাভেলস বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করছে। নগরীর সোবহানীঘাট, মৌবন ও যতরপুর এলাকার প্রায় এক হাজার মানুষের মধ্যে চিড়া, মুড়ি, গুড়, ব্রেড, বিস্কুট, মোমবাতি, দিয়াশলাইসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিতরণ করা হয়।

লতিফ ট্রাভেলসের পরিচালক জহিরুল কবীর চৌধুরী শিরু জানান, সোমবার বন্যার্তদের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বন্ধন সমাজকল্যাণ সংস্থা সিলেট সদর উপজেলার সাহেববাজার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাহেববাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা আশ্রয়কেন্দ্রের ৮০০ বন্যার্তের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করে।

নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য জেলা পুলিশের খাদ্য ও ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।

বন্যাকবলিত সুনামগঞ্জ শহরের ৫০ শতাংশ এলাকায় চার দিন পর বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা মশিউর জানান, গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোতে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে।

আরও এলাকায় দেওয়ার জন্য কাজ করা হচ্ছে। তবে যে এলাকা থেকে পানি নামবে না সেখানে বিদ্যুৎ দেওয়া হবে না। সোমবার বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে এসব এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, শহরের ৫০ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। বন্যার কারণে বৃহস্পতিবার থেকে সুনামগঞ্জের একের পর এক এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। সোমবার হাসপাতাল, কারাগার, ডিসি অফিস ও সদর থানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।

জগন্নাথপুর উপজেলার অধিকাংশ বাড়িঘরে হাঁটুপানি-কোমরপানি। রাস্তাঘাটে বুকসমান পানি, সাঁতার পানি। চারদিকে পানি আর পানি। ঘরে পানি ওঠায় মানুষ নৌকায় আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে।

তবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় ঠাঁই মিলছে না। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা। সিলেট বিভাগীয় শহরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান সড়ক জগন্নাথপুর-সিলেট সড়ক, জগন্নাথপুর-সুনামগঞ্জসহ জগন্নাথপুর উপজেলা সদরের সঙ্গে যাতায়াতের সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে।

গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। সোমবার পর্যন্ত জগন্নাথপুরের প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

সরেজমিন কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় ঠাঁই মিলছে না বানভাসি মানুষের। জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ ভবনে শত শত মানুষ আশ্রয় নিলেও সেখানে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। আলিয়া মাদ্রাসা, জগন্নাথপুর পৌরসভা ভবন, জগন্নাথপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ প্রতিটি কেন্দ্রে মানুষের উপচে পড়া ভিড়।

এসব কেন্দ্রে ত্রাণের জন্য আহাজারি চলছে। জগন্নাথপুর উপজেলা আবাসিক (বিদ্যুৎ) প্রকৌশলী আজিজুল ইসলাম জানান, সিলেটের বরইকান্দি বিদ্যুতের সাবস্টেশন পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করা হয়েছে। ওই সাবস্টেশন থেকে জগন্নাথপুরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

সুনামগঞ্জের ছাতকে ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা বন্যায় পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সুরমা ও বটের নদীর পানি ছাতকে বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ৫ দিন ধরে সারা দেশের সঙ্গে ছাতকের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। গাড়ির বদলে এখন নৌকা চলছে ছাতক সড়কে। সোমবার বন্যার পানি কমলেও এখনো সড়ক যোগাযোগ চালু হয়নি।

ছাতক ও সুনামগঞ্জ গ্রিড উপকেন্দ্র প্লাবিত হওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। তবে সোমবার সকাল থেকে উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় বিদ্যুৎ চালু হয়েছে। আংশিকভাবে ইন্টারনেটও চালু হয়েছে।

এদিকে ৬০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো সরকারিভাবে কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের বড়কাপন, মনবেগ এলাকা ও গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক রেললাইনের পাশের উঁচু জায়গায় তাঁবু টাঙিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বানভাসি মানুষ।

মদন ও খালিয়াজুরিতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। অন্য উপজেলাগুলোয় পানি অপরিবর্তিত আছে। ৩২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে দেড় লাখ মানুষ ঠাঁই নিয়েছে। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহনলাল সৈকত জানান, উব্দাখালি নদীর পানি কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে।

খালিয়াজুরির ধনু নদের পানি বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ভারি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও বারহাট্টায় বন্যার পানি কমতে শুরু করছে।

মদনের ইউএনও বুলবুল আহমেদ জানান, মদনে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গোবিন্দশ্রী, তিয়শ্রী, ফতেপুরসহ বেশ কিছু ইউনিয়নের প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা পানির নিচে। জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ৩২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে এক লাখের বেশি মানুষ ঠাঁই নিয়েছেন।

এছাড়া ১৫ হাজারের মতো গবাদিপশু নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে। কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হাসেম জানান, শনিবার রাত থেকে কলমাকান্দায় পানি কমছে। এখনো ৮০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে আছে।

দুর্গাপুরের ইউএনও রাজীব উল আহসান জানান, দুর্গাপুরে বন্যার পরিস্থিতি বেশ উন্নতির দিকে। পৌর শহরে এখন পানি নেই। তবে গাকান্দিয়া, চণ্ডীগড়, বিরিশিরিসহ কয়েকটি ইউনিয়নে পানি ধীর গতিতে নামছে। পানি কমলেও দুর্ভোগ এখনো কমেনি।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া পরিবারগুলো বিপাকে পড়েছে। অনেক স্থানে বিদ্যুৎ নেই। কুপিবাতির আলোই তাদের একমাত্র ভরসা। মানুষজনের হাতে কেরোসিন কেনার টাকাও নেই।

বুল্লা সিংহগ্রাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া পূর্ব বুল্লা গ্রামের কবির মিয়া জানান, ৪ দিন ধরে তিনি পরিবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু এখনো কোনো ত্রাণ পাননি।

কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে। লাখাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন জানান, পর্যায়ক্রমে সবাইকে ত্রাণ দেওয়া হবে। অতি দুর্গত এলাকাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। কাউকেই বাদ দেওয়া হবে না।

মনু নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে নদী তীরের কয়েক লাখ মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে। কুশিয়ারা ও ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাকালুকি, কাউয়াদিঘি, হাইল হাওড়সহ বিভিন্ন হাওড়ের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

সাত উপজেলার প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পৌর শহরের মাইজপাড়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৪৩টি ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। এখনকার বাসিন্দারা চরম বিপাকে পড়েছে।

নদী প্রতিরক্ষা বাঁধের বাইরে অপরিকল্পিতভাবে ঘরগুলো নির্মাণ করায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। জেলায় ৪২টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৪০ হাজার পরিবার। জেলাজুড়ে ১০১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

কমলগঞ্জ উপজেলায় পাহাড়ি ঢলে ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আতঙ্কিত গ্রামবাসী প্রতিরক্ষা বাঁধের কয়েকটি স্থানে স্বেচ্ছাশ্রমে গাছ ও মাটিভর্তি বস্তা ফেলে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেন। এলাকাবাসী নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।

রোববার রাতে পতনঊষার ইউনিয়নে লাঘাটা নদীর ঘোপীনগরে বাঁধ ভেঙে দুটি গ্রামের ৩০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কান্দিগাঁও এলাকার পানিবন্দি সাতির মিয়া জানান, লাঘাটা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি বাড়ি-ঘর ও রাস্তায় উঠে যায়। চেষ্টা করেও ভাঙন ঠেকানো যায়নি।

দেওয়ানগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চুকাইবাড়ী ইউনিয়নের গুজিমারী, বালুগ্রাম, কেল্লাকাটা, সাঁকোয়াপাড়া, রামপুরাসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

চুকাইবাড়ী গুচ্ছগ্রাম তলিয়ে যাওয়ায় গুচ্ছগ্রামবাসীকে দেওয়ানগঞ্জ রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সোমবার দেওয়ানগঞ্জ বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ২১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।