হাওর বার্তা ডেস্কঃ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেছেন, দেশজুড়ে ১০ জেলার ৬৪টি উপজেলা বন্যার কবলে রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। ১২২ বছরের ইতিহাসে সিলেট ও সুনামগঞ্জে এমন বন্যা হয়নি। শনিবার (১৮ জুন) বিকেলে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কিত ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।
এ সময় তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশের সব সংস্থা একসঙ্গে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী না ঘুমিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম তদারকি করছেন। যথেষ্ট পরিমাণ ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম চলমান। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে। উদ্ধার কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনী কার্যক্রম চালাবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, গতকাল পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়, লাখ-লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে যায়। উদ্ধারের জন্য সিভিল প্রশাসন জলযান নিয়ে মাঠে নামে। সিলেট এবং সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জানিয়েছিলেন, পানিবন্দির তুলনায় জলযান অপ্রতুল। তারা আরও সাহায্য চায়।
বিষয়টি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানানো হয় উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিক আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনকে নির্দেশ দেন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডকে মোতায়েন করার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী গতকাল দুপুরে ৩১টি স্পিডবোডসহ সেনাবাহিনী উদ্ধার কাজে নামে। রাতের দিকে নৌবাহিনী ৩০ জন ডুবরিসহ তাদের নৌযান নিয়ে উদ্ধার কাজ চালায়। আজ দুপুরে কোস্টগার্ড সেখানে পৌঁছে। সবাই সম্মিলিতভাবে সিলেটে প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে সাড়ে চারশ আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর করে।
তিনি বলেন, সুনামগঞ্জে দুশটি আশ্রয়কেন্দ্রে ৬৫ হাজার মানুষকে তারা উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে রান্না করা খিচুড়ি, মুড়ি, চিড়া, গুড়, পানি এবং পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হচ্ছে। এরইমধ্যে আমরা দুই জেলাতে ৮০ লাখ টাকা করে নগদ দিয়েছি। রেডিমেড খাবার বিতরণের জন্য এসব টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
প্রায় ৩২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে বলেও জানান ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী। তিনি জানান, দুই জেলায় মোট দেড় হাজার টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
পাহাড়ি ঢল এবং দেশের অভ্যন্তরে টানা ভারী বর্ষণে বৃহত্তর সিলেট এলাকা ভাসছে ভয়াবহ আকস্মিক বন্যায়। ইতিমধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম ও কিশোরগঞ্জ বন্যাক্রান্ত। প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন অঞ্চল-জেলা। দেশের ৩৫-৪০ ভাগ অঞ্চল বন্যা কবলিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১০টি নদীর পানি ১৩টি পয়েন্টে বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গতকাল সন্ধ্যায় বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি আগামী সোমবার পর্যন্ত আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতিও দ্রুত খারাপ হতে পারে। দুই-তিন দিন পর বৃষ্টিপাত কমলেও বন্যার প্রলয়ংকরী রূপ অব্যাহত থাকবে কয়েক দিন।
এদিকে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের (আইএমডি) বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের চেরাপুঞ্জি বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা জুন মাসে ১২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত তিন দিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এটিও গত ২৭ বছরের মধ্যে তিন দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, চেরাপুঞ্জিতে আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরো ৫৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। এ বৃষ্টির পানি সিলেট এবং সুনামগঞ্জের ওপর দিয়ে দ্রুত নেমে আসায় সেখানে এ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্রের উজানে আসামে গুয়াহাটিতে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। ঐ দুই এলাকার ভাটি এলাকা হিসেবে বাংলাদেশের সিলেট ও কুড়িগ্রামে ঐ পানি নামা শুরু করবে।
কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল (পলাশ) ইত্তেফাককে বলেন, আপাতত সুরমা মেঘনা যমুনার পানি বাড়লেও পদ্মার পানি আগামী ১৫ দিনে ভয়াবহ মাত্রায় বিপত্সীমা অতিক্রম করবে না। দেশে বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছর যে অস্থায়ী বন্যা হয় তাতে ২০-৩০ ভাগ অঞ্চল প্লাবিত হয়। এ বছর বেশি হবে বন্যা। দেশের ৩৫-৪০ ভাগ অঞ্চল বন্যাকবলিত হতে পারে। স্থায়ী বন্যার সম্ভাবনা কম।
মোস্তফা কামাল (পলাশ) বলেন, আগামী ৩ দিন সিলেট বিভাগে চলমান বন্য পরিস্থিতির আরো চরম অবনতির প্রবল আশঙ্কা নির্দেশ করছে বিশ্বের প্রধান-প্রধান আবহাওয়া পূর্বাভাষ মডেলগুলো। জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ ভিত্তিক বন্যা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে সিলেট বিভাগের প্রায় ৮০ এর বেশি স্থল ভাগ বর্তমানে পানির নিচে ডুবে আছে। আমেরিকার ম্যারিল্যালন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্য পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে গতকাল সকাল ৬টায় সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের সামনে সুরমা নদীতে সেকেন্ডে ১২ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, এখন আর ১৯৮৮ সালের মতো সারা দেশে বন্যার আশঙ্কা নেই। কারণ তখন বন্যা হয়েছিল ৫২টি জেলায়। বর্তমানে ৩০-৩৩ জেলায় বন্যা হয়। আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হতে পারে। সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপত্সীমার ১০৮, সিলেট পয়েন্টে ৭০ এবং সুনামগঞ্জ পয়েন্টে ১২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি হাতিয়া পয়েন্টে বিপত্সীমার ৬০ এবং চিলমারী পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুধকুমার নদের পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপত্সীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলার পানি কুড়িগ্রাম পয়েন্টে বিপত্সীমার ৯ এবং তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপত্সীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এছাড়া সারিগোয়াইন নদীর পানি সারিঘাটে বিপত্সীমার ২৩, পুরাতন সুরমা নদীর পানি দেরাই পয়েন্টে বিপত্সীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লরেরগড়ে বিপত্সীমার ১৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে যাদুকাটা নদীর পানি। সোমেশ্বরী নদী কমলাকান্দা পয়েন্টে ৫৬ এবং ভুগাই নদী নাকুয়াগাঁও পয়েন্টে বিপত্সীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।