হাওর বার্তা ডেস্কঃ ভয়াবহ মাত্রায় বিষিয়ে উঠছে বঙ্গোপসাগর। মাছসহ সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদের টিকে থাকার অনুপযোগী হয়ে উঠছে সমুদ্রের পরিবেশ-প্রকৃতি। কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরের মিলিত মোহনায় চট্টগ্রাম বন্দরের নৌ-চলাচল চ্যানেলে ড্রেজিং করতে গিয়ে তলদেশে স্থানভেদে ২ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত পু রো প্লাস্টিক-পলিথিন ও কঠিন বর্জ্যরে স্তর পাওয়া গেছে। ব্যাহত হচ্ছে ড্রেজিং কার্যক্রম। এর চেয়ে প্লাস্টিক ও পলিথিনের মোটা আস্তর জমেছে বঙ্গোপসাগর ও উপকূলজুড়ে। তাছাড়া বৃহত্তর চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা অঞ্চলসহ সারাদেশের হাজারো কল-কারখানার বিপুল পরিমাণ শিল্পবর্জ্য নদী-নালা-খাল হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে।
তেল বা পোড়া তেলের বর্জ্য, সমগ্র দেশে জমিতে ব্যবহৃত বিষাক্ত কীটনাশক, সারসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য, প্লাস্টিক-পলিথিন মিলিয়ে যাবতীয় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে বঙ্গোপসাগর। প্রতিদিনই শত শত জাহাজ-ট্রলার, নৌযান থেকে বর্জ্য-আবর্জনা সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে অবাধে। যা মানুষের তৈরি সমস্যা-সঙ্কট। অথচ এর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা কার্যত নেই। অভাব রয়েছে বিশেষায়িত সার্ভেল্যান্স জাহাজ ও প্রশিক্ষিত জনবলের।
সমুদ্রে ওইসব বিষাক্ত বর্জ্য মাছেরা খাদ্যের সাথে খেয়ে ফেলছে। আর, মাছ খেতে গিয়ে সেসব বর্জ্য উপাদান শেষ গন্তব্য হিবেবে ঢুকছে মানুষের পেটে। এতে করে নানাবিধ জটিল রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চঝুঁকি রয়েছে মানুষের। বিজ্ঞানীগণ বলছেন, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদি মিশ্রণের অব্যাহত প্রক্রিয়ার ফলে সমুদ্রের পানিতে অক্সিজেনের অভাব প্রকট হচ্ছে। গভীর সমুদ্রে তৈরি হচ্ছে ‘ডেড জোন’। এর ফলে মাছসহ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। মাছশূণ্য হতে চলেছে বঙ্গোপসাগর।
সমুদ্রবিজ্ঞানী যা বললেন : এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস’র প্রফেসর সমুদ্রবিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী গতকাল জানান, প্লাস্টিক-পলিথিন সমুদ্রের তলদেশে ঢেকে ও জেঁকে বসছে। এতে করে সাগরের তলদেশীয় মাছের বিচরণ এলাকা মাছশূণ্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে দীর্ঘমেয়াদে। এ মুহূর্তে প্লাস্টিক সাগরে বড় ধরনের সমস্যা।
তিনি আরও বলেন, কৃষিকাজে মাত্রাতিরিক্ত হারে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার বিশেষত ইউরিয়া সার, বিষাক্ত কীটনাশকের অর্ধেকই পানিতে ধুয়েমুছে সারাদেশের নদী-নালা-খাল-বিল হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক দ্রব্য নিঃসরণের ফলে বঙ্গোপসাগরের পানিতে অক্সিজেন-শূণ্য জোন সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে মাছসহ পরিবেশ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। প্লাস্টিক-পলিথিন, বিষাক্ত রাসায়নিক জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে।
বিগত ২০১৮ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় নরওয়ের সর্বাধুনিক জরিপ-গবেষণা জাহাজ ‘ড. ফ্রিডজফ নেনসেন-৩’-এর সাহায্যে বঙ্গোপসাগরের পরিবেশ-প্রকৃতির উপর পরিচালিত সর্বশেষ গবেষণা কার্যক্রমে দেশী-বিদেশী ৩০ জন বিজ্ঞানীর অন্যতম ছিলেন প্রফেসর সাইদুর রহমান চৌধুরী। এই গবেষণায়ও সমুদ্রে রাসায়নিক দূষণে অক্সিজেন-শূণ্য জোন সৃষ্টির বিষয়টিও উঠে আসে।
বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকা বাংলাদেশের সমুদ্র সীমা। ষাট থেকে আশির দশকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার জরিপ-গবেষণায় বঙ্গোসাগরকে ‘মৎস্য খনি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এতে ৩৬ প্রজাতির চিংড়িসহ ৪৭৬ প্রজাতির মাছের বিচরণশীলতা দেখা গেছে। কিন্তু ক্রমাগত ভয়াবহ দূষণ, বেপরোয়া মাছ বিশেষ করে মা-মাছ নিধন, বিদেশী ট্রলার নৌযানে ব্যাপকহারে মাছ চুরি বা লোপাটের কারণে বঙ্গোপসাগরে অসংখ্য প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির মুখে কিংবা অস্তিত্ব সঙ্কটে। মাছ শিকারি জেলেরা সুস্বাদু ও বড়সড় লাক্ষ্যা মাছের মতো অনেক মাছ এখন সমুদ্রে তেমন পাচ্ছেন না। সমুদ্রে কয়েকদিনের ট্রিপে মাছ শিকারের জন্য গিয়ে অনেক সময়ই জেলেরা ফিরছে প্রায় খালি হাতে। সমুদ্রপাড়ের অনেক জেলে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে।
অক্সিজেন-শূণ্য ‘ডেড জোন’ : বঙ্গোপসাগরে ‘ডেড জোন’ বা অক্সিজেন-শূণ্য জোন’ (অথবা শূণ্যের কাছাকাছি নিম্নতম অক্সিজেন জোন) সমুদ্র বিজ্ঞানীদের মাঝে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। তারা জানান, জ্বালানি তেল, পোড়া তেলের গাদ, গ্যাস ও কয়লা পোড়ানোর কারণে এসব জ্বালানির বর্জ্য এবং কৃষি জমি, ক্ষেত-খামারে অনিয়ন্ত্রিত হারে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে সেগুলোর যাবতীয় বর্জ্য খাল-বিল, নদ-নদী হয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশছে।
এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নাইট্রাস অক্সাইড। যা সাগরের পানিরাশিকে করে তুলছে অক্সিজেন-শূন্য। সমুদ্র হারাচ্ছে স্বাভাবিক অক্সিজেনের মাত্রা। অক্সিজেনহীন কিংবা শূন্যের কাছাকাছি অক্সিজেন জোন সৃষ্টি হলে সেখানে মূল্যবান মৎস্য সম্পদসহ সামুদ্রিক প্রাণিকুল, জীববৈচিত্র্য, উদ্ভিদরাজি ও তাদের প্রাকৃতিক খাদ্য-শৃঙ্খল মারা যায়। অথবা অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
সাগরে নিঃসরিত নাইট্রাস অক্সাইড থেকে পরিণত হচ্ছে মারাত্মক ক্ষতিকর নাইট্রাইড। এতে করে সমুদ্রে এককোষী শৈবাল সৃষ্টি এবং এর বংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখান থেকে ‘ডি-কম্পোজ’ নিয়মে প্রাদুর্ভাব ঘটছে ব্যাকটেরিয়ার। এসব মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান সাগরতলে পানির স্বাভাবিক অক্সিজেন খেয়ে সাবাড় করে ফেলছে। এই প্রক্রিয়ায় সাগরতলে সৃষ্টি হয় অক্সিজেন-শূন্য বা ‘ডেড জোন’।
সেখানে বিচরণশীল মৎস্যসহ প্রাণিকুল, উদ্ভিদ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য অপরিহার্য স্বাভাবিক অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। এ কারণে বাঁচার তাগিদে বড় আকারের প্রাণিকুল পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মাছসহ ছোট আকারের কোটি কোটি প্রাণিকুল ও তাদের খাদ্য-শৃঙ্খল মারা যায়। ২০১৬ সালে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সমুদ্র বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানে বঙ্গোপসাগরে অক্সিজেন-শূণ্য জোন থাকার বিষয়টি প্রথম উদঘাটিত হয়। যা ‘ন্যাচার জিও-সায়েন্স’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।
প্রফেসর সাইদুর জানান, এই রাসায়নিক দূষণের কারণে বঙ্গোপসাগরের বিরাট এলাকা বর্তমানে অক্সিজেন-শূণ্য হয়ে পড়েছে। সেখানে মাছ টিতে থাকতে পারবে না। বঙ্গোপসাগরের কমপক্ষে ১০ ভাগ এলাকা অক্সিজেন-শূণ্য। তবে এটা ২০১৬ সালের গবেষণার তথ্য। এখন যত এলাকায় ইউরিয়াসহ রাসায়নিকের দূষণ ছড়িয়ে পড়বে, অক্সিজেন-শূণ্য এলাকার বিস্তার ও আয়তন ততই বেড়ে যাবে। সাধারণত সমুদ্রের ২শ’ মিটার গভীরে অক্সিজেন-শূণ্য এলাকা সৃষ্টি হয়ে থাকে।