ঢাকা ০২:৩৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মন্ত্রী এমপি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মুখোমুখি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:০৭:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ জুন ২০২২
  • ১১৬ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আধিপত্য বিস্তার, দলীয় পদ-পদবি এবং জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়নপ্রাপ্তির প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ঘিরে সারা দেশে মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। জেলা থেকে উপজেলা, ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ডে ছড়িয়ে পড়েছে এই কোন্দল। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন দলটির নেতাকর্মীরা। তাদের আশঙ্কা-দ্রুত দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসন করতে না পারলে সম্ভাব্য প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করা খুবই কঠিন হবে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার সম্মেলন উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করছেন। তারা চেষ্টা করছেন দলীয় নেতাদের মধ্যকার বিরোধ মেটানোর। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতারা স্থানীয় পর্যায়ের এ বিরোধ নিরসনে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে জানা গেছে। তবে মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ কার্যকর না হলেও দলটির তৃণমূল নেতাদের ঢাকায় ডেকে কথা বলছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। ফেব্রুয়ারি থেকে এমন বৈঠক করে আসছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। হাইকমান্ডের নির্দেশে দ্বন্দ্ব-কোন্দল মিটিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করতেই ধারাবাহিক এসব বৈঠক করছেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা যুগান্তরকে বলেছেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশেই মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

কোনোভাবেই দলের মধ্যকার এসব দ্বন্দ্ব নিরসন করা যাচ্ছে না। কারণ আধিপত্য বিস্তার, সংগঠনের পদ-পদবি এবং আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে এসব দ্বন্দ্ব। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব^-কোন্দল থাকলে অবশ্যই আগামী নির্বাচনে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। সামনে যে জাতীয় নির্বাচন আসছে, সেটা একটা কঠিন নির্বাচন হবে। তাই মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে জেলার নেতা এবং দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের যে ‘কোল্ডওয়ার’ চলছে, তা দলের সিনিয়র নেতারা নিরসনের চেষ্টা করছেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, একটি বড় সংগঠনে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকেই। সেখান থেকে দ্বন্দ্ব-কোন্দলের সৃষ্টি হতে পারে। সে ধরনের সমস্যা দেখা দিলে সাংগঠনিকভাবে উদ্যোগ নিয়ে তা নিরসন করা হয়। কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে গঠিত সাংগঠনিক টিমের সদস্যরা সারা দেশ সফর করছেন। দলীয় ঐক্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অতীতে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থেকেছে, আগামী দিনেও ঐক্যবদ্ধ থাকবে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে বড় সংগঠন। এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকাটাই স্বাভাবিক। দলের অভিভাবক শেখ হাসিনা চার দশক ধরে দক্ষ হাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তৃণমূল পর্যায়ের সব নেতাকর্মীর সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। যদি কোথাও সমস্যা থাকে, নেত্রীর নির্দেশে সাংগঠনিক টিম তা নিরসনে কাজ করবে।

চাঁদপুর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সদর আসনের এমপি ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। দীপু মনি চাঁদপুরে যখন কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেন, তখন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির উদ্দীন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলালসহ তাদের অনুসারীরা অংশ নেন না। এ দ্বন্দ্ব অনেক আগের। চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি কেনার ঘটনায় বিষয়টি সামনে চলে আসে। মন্ত্রীর স্বজন ও অনুসারীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য মন্তব্য করেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। কেন্দ্রীয়ভাবে আওয়ামী লীগ উভয় গ্রুপকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বর্তমানে দুই গ্রুপকে আলাদাভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তার ছোট ভাই বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার দ্বন্দ্ব কিছুদিন আগেও সারা দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ-সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গেও পৌর মেয়র কাদের মির্জার দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। এ নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ হয়ে পড়েছে দুইভাগে বিভক্ত।

পটুয়াখালী-৩ আসনের এমপি এসএম শাহজাদার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেন তার দলীয় প্রতিপক্ষরা। গত ২ মে নলখোলাবন্দরের দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ লিটন সমর্থিত যুবলীগের একাংশ। একই দিন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন এমপি সমর্থকরা।

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের এমপি প্রয়াত সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিনের ছেলে জুয়েল আরেং ও উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদুল হকের দ্বন্দ্ব এখন চরমে। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রথমবার নির্বাচন করে পরাজিত হলেও দ্বিতীয় দফায় বিপুল ভোটে বিজয়ী হন তিনি। নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও এমপির অনুসারী দলের অনেক নেতা ছিলেন তার বিরুদ্ধে। সেখান থেকেই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়।

মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগে বিভক্তি বহুদিনের। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ একটি গ্রুপ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সমর্থক। অপর গ্রুপটি মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ-সদস্য দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাবেক নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খানের সমর্থক।

গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শাজাহান খান ও বাহাউদ্দিন নাছিম একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেন। শাজাহান খান তার প্রতিপক্ষ বাহাউদ্দিন নাছিমকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আমার এলাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা গিয়ে অনুষ্ঠান করেন। কিন্তু আমাকে জানানো হয় না। আমার সঙ্গে কোনো আলোচনাও করা হয় না।’ বৈঠকে শাজাহান খানের বক্তব্যের জবাবে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমরা বাধ্য হয়েই অনুষ্ঠান করেছি। মাদারীপুরে পুরোনো ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হয় না। এমনকি কেউ মারা গেলে তার স্মরণসভা পর্যন্ত করা হয় না।’ মাদারীপুরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করা হয় আলাদা আলাদাভাবে। বাহাউদ্দিন নাছিম সমর্থকরা পুরানবাজার জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে তাদের বেশিরভাগ কর্মসূচি পালন করেন। অপরদিকে শাজাহান খান গ্রুপ শাজাহান খানের বাড়ির কাছে দলীয় কর্মসূচি পালন করে থাকে।

রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনে এমপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমপির সঙ্গে পৌরসভার মেয়রদেরও সুসম্পর্ক নেই। গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বদিউজ্জামান।

উপজেলা চেয়ারম্যান পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বদিউজ্জামান বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে অংশ নেন। এরপর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার জন্য তিনি এমপিকে দায়ী করে আসছেন। কাঁকনহাট পৌরসভার মেয়র আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান খানের সঙ্গেও এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এ সংসদীয় আসনের আরেকটি উপজেলা তানোর।

এই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রাব্বানী এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গেও এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর সম্পর্ক সাপে-নেউলে। উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো সভায় এখন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে উপস্থিত হতে দেন না এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী ও তার অনুসারীরা।

টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ-সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনিরের প্রকাশ্যে বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন গোপালপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার। হুমকি দেওয়ার অভিযোগ এনে গত এপ্রিলে তিনি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ পাঠান। এতে তার পক্ষে সাতজন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান স্বাক্ষর করেন। যদিও সংসদ-সদস্য ছোট মনির হুমকি দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছেন। নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি বহুদিন ধরে দ্বিধাবিভক্ত। সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নানা ইস্যুতে অনেক আগে থেকেই একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড একাধিকবার তাদের সঙ্গে বৈঠক করলেও কার্যকর ফলাফল আসেনি।

নাটোর সদর আসনের সংসদ-সদস্য শফিকুল

ইসলাম শিমুলের সঙ্গে জেলার আরেক সংসদ-সদস্য আবদুল কুদ্দুসের দ্বদ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

দুজনের অনুসারীরা দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে রাজনীতি করছেন। জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ এ দুই নেতার অনুসারীরা পক্ষে-বিপক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে দলের মধ্যকার বিভক্তির চিত্র প্রকাশ্যে এনেছেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্ত্রী এমপি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মুখোমুখি

আপডেট টাইম : ১০:০৭:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ জুন ২০২২

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আধিপত্য বিস্তার, দলীয় পদ-পদবি এবং জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়নপ্রাপ্তির প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ঘিরে সারা দেশে মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। জেলা থেকে উপজেলা, ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ডে ছড়িয়ে পড়েছে এই কোন্দল। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন দলটির নেতাকর্মীরা। তাদের আশঙ্কা-দ্রুত দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসন করতে না পারলে সম্ভাব্য প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করা খুবই কঠিন হবে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার সম্মেলন উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করছেন। তারা চেষ্টা করছেন দলীয় নেতাদের মধ্যকার বিরোধ মেটানোর। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতারা স্থানীয় পর্যায়ের এ বিরোধ নিরসনে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে জানা গেছে। তবে মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ কার্যকর না হলেও দলটির তৃণমূল নেতাদের ঢাকায় ডেকে কথা বলছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। ফেব্রুয়ারি থেকে এমন বৈঠক করে আসছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। হাইকমান্ডের নির্দেশে দ্বন্দ্ব-কোন্দল মিটিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করতেই ধারাবাহিক এসব বৈঠক করছেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা যুগান্তরকে বলেছেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশেই মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

কোনোভাবেই দলের মধ্যকার এসব দ্বন্দ্ব নিরসন করা যাচ্ছে না। কারণ আধিপত্য বিস্তার, সংগঠনের পদ-পদবি এবং আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে এসব দ্বন্দ্ব। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব^-কোন্দল থাকলে অবশ্যই আগামী নির্বাচনে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। সামনে যে জাতীয় নির্বাচন আসছে, সেটা একটা কঠিন নির্বাচন হবে। তাই মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে জেলার নেতা এবং দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের যে ‘কোল্ডওয়ার’ চলছে, তা দলের সিনিয়র নেতারা নিরসনের চেষ্টা করছেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, একটি বড় সংগঠনে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকেই। সেখান থেকে দ্বন্দ্ব-কোন্দলের সৃষ্টি হতে পারে। সে ধরনের সমস্যা দেখা দিলে সাংগঠনিকভাবে উদ্যোগ নিয়ে তা নিরসন করা হয়। কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে গঠিত সাংগঠনিক টিমের সদস্যরা সারা দেশ সফর করছেন। দলীয় ঐক্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অতীতে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থেকেছে, আগামী দিনেও ঐক্যবদ্ধ থাকবে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে বড় সংগঠন। এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকাটাই স্বাভাবিক। দলের অভিভাবক শেখ হাসিনা চার দশক ধরে দক্ষ হাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তৃণমূল পর্যায়ের সব নেতাকর্মীর সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। যদি কোথাও সমস্যা থাকে, নেত্রীর নির্দেশে সাংগঠনিক টিম তা নিরসনে কাজ করবে।

চাঁদপুর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সদর আসনের এমপি ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। দীপু মনি চাঁদপুরে যখন কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেন, তখন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির উদ্দীন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলালসহ তাদের অনুসারীরা অংশ নেন না। এ দ্বন্দ্ব অনেক আগের। চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি কেনার ঘটনায় বিষয়টি সামনে চলে আসে। মন্ত্রীর স্বজন ও অনুসারীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য মন্তব্য করেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। কেন্দ্রীয়ভাবে আওয়ামী লীগ উভয় গ্রুপকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বর্তমানে দুই গ্রুপকে আলাদাভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তার ছোট ভাই বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার দ্বন্দ্ব কিছুদিন আগেও সারা দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ-সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গেও পৌর মেয়র কাদের মির্জার দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। এ নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ হয়ে পড়েছে দুইভাগে বিভক্ত।

পটুয়াখালী-৩ আসনের এমপি এসএম শাহজাদার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেন তার দলীয় প্রতিপক্ষরা। গত ২ মে নলখোলাবন্দরের দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ লিটন সমর্থিত যুবলীগের একাংশ। একই দিন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন এমপি সমর্থকরা।

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের এমপি প্রয়াত সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিনের ছেলে জুয়েল আরেং ও উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদুল হকের দ্বন্দ্ব এখন চরমে। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রথমবার নির্বাচন করে পরাজিত হলেও দ্বিতীয় দফায় বিপুল ভোটে বিজয়ী হন তিনি। নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও এমপির অনুসারী দলের অনেক নেতা ছিলেন তার বিরুদ্ধে। সেখান থেকেই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়।

মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগে বিভক্তি বহুদিনের। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ একটি গ্রুপ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সমর্থক। অপর গ্রুপটি মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ-সদস্য দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাবেক নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খানের সমর্থক।

গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শাজাহান খান ও বাহাউদ্দিন নাছিম একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেন। শাজাহান খান তার প্রতিপক্ষ বাহাউদ্দিন নাছিমকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আমার এলাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা গিয়ে অনুষ্ঠান করেন। কিন্তু আমাকে জানানো হয় না। আমার সঙ্গে কোনো আলোচনাও করা হয় না।’ বৈঠকে শাজাহান খানের বক্তব্যের জবাবে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমরা বাধ্য হয়েই অনুষ্ঠান করেছি। মাদারীপুরে পুরোনো ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হয় না। এমনকি কেউ মারা গেলে তার স্মরণসভা পর্যন্ত করা হয় না।’ মাদারীপুরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করা হয় আলাদা আলাদাভাবে। বাহাউদ্দিন নাছিম সমর্থকরা পুরানবাজার জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে তাদের বেশিরভাগ কর্মসূচি পালন করেন। অপরদিকে শাজাহান খান গ্রুপ শাজাহান খানের বাড়ির কাছে দলীয় কর্মসূচি পালন করে থাকে।

রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনে এমপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমপির সঙ্গে পৌরসভার মেয়রদেরও সুসম্পর্ক নেই। গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বদিউজ্জামান।

উপজেলা চেয়ারম্যান পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বদিউজ্জামান বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে অংশ নেন। এরপর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার জন্য তিনি এমপিকে দায়ী করে আসছেন। কাঁকনহাট পৌরসভার মেয়র আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান খানের সঙ্গেও এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এ সংসদীয় আসনের আরেকটি উপজেলা তানোর।

এই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রাব্বানী এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গেও এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর সম্পর্ক সাপে-নেউলে। উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো সভায় এখন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে উপস্থিত হতে দেন না এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী ও তার অনুসারীরা।

টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ-সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনিরের প্রকাশ্যে বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন গোপালপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার। হুমকি দেওয়ার অভিযোগ এনে গত এপ্রিলে তিনি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ পাঠান। এতে তার পক্ষে সাতজন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান স্বাক্ষর করেন। যদিও সংসদ-সদস্য ছোট মনির হুমকি দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছেন। নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি বহুদিন ধরে দ্বিধাবিভক্ত। সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নানা ইস্যুতে অনেক আগে থেকেই একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড একাধিকবার তাদের সঙ্গে বৈঠক করলেও কার্যকর ফলাফল আসেনি।

নাটোর সদর আসনের সংসদ-সদস্য শফিকুল

ইসলাম শিমুলের সঙ্গে জেলার আরেক সংসদ-সদস্য আবদুল কুদ্দুসের দ্বদ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

দুজনের অনুসারীরা দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে রাজনীতি করছেন। জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ এ দুই নেতার অনুসারীরা পক্ষে-বিপক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে দলের মধ্যকার বিভক্তির চিত্র প্রকাশ্যে এনেছেন।