হাওর বার্তা ডেস্কঃ পেটে তীব্র ব্যথা হয়ে অনেক সময় ‘অ্যাবডোমিনাল অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিজম’ হয়ে থাকে। পেটের মধ্যকার বড় রক্তনালী ফুলে বেলুনের মতো হয়ে গিয়ে এমনটি হয়। বেলুনের দেয়াল ফেটে সেখান থেকে অনেক সময় রক্তক্ষরণও হয়। দ্রুত অপারেশন করে রক্তনালী মেরামত করে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে না পারলে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বেশি।
অ্যানিউরিজম কেন হয় কাদের হয় এবং এই রোগের প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার
অ্যানিউরিজম কী এবং কেন হয়
ধমনির ভেতরের দেয়ালে কোলেস্টেরল জমা হওয়ার কারণে ব্লক সৃষ্টি হয়; যার ফলে ধমনির ভেতর দিয়ে রক্তের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়। কোলেস্টেরল দিয়ে যে শুধু ব্লকই হয়, তা নয়, বরং মাঝে মাঝে এর উল্টোটাও হতে পারে। যেমন- কখনও কখনও ধমনির দেয়াল দুর্বল ও পাতলা হয়ে বেলুনের মতো ফুলে যেতে পারে। ধমনির এ রকম ফুলে যাওয়া অংশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘অ্যানিউরিজম’ বলা হয়। অ্যানিউরিজমের কারণ হিসেবে মূলত ধমনির দেয়ালের দুর্বলতাকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এই দুর্বলতার কারণ কী তা সঠিকভাবে জানা যায় না, যদিও বংশগত কারণকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে ধারণা করা হয়। দেখা গেছে একই পরিবারের একাধিক পুরুষ সদস্য এই রোগে আক্রান্ত হয়। ধূমপান ও উচ্চ রক্তচাপকে এ রোগের দুটো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক বা ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ধূমপায়ীদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অধূমপায়ীদের চাইতে প্রায় ৮ গুণ বেশি।
কোথায় হয়
শরীরের যে কোনো অংশের ধমনিতেই অ্যানিউরিজম হতে পারে। তবে পেটের মহাধমনির নিচের অংশে অ্যানিউরিজম হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। মহাধমনির এই অংশের অ্যানিউরিজমকে ‘অ্যাবডোমিনাল অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিজম’ (Abdominal Aortic Aneurysm) বা সংক্ষেপে ‘ট্রিপল এ’ (অঅঅ) নামে অভিহিত করা হয়। মাঝে মাঝে মস্তিষ্কের ভেতরের ধমনিতে এক ধরনের অ্যানিউরিজম দেখা যায় যাকে ‘বেরি অ্যানিউরিজম’ বলা হয়। শিরায় ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক ব্যবহারকারীদের হাত বা পায়ের বিশেষ করে কুচকির ফেমোরাল ধমনিতে প্রায়ই ‘ফল্স অ্যানিউরিজম’ দেখা যায়।
কাদের হয়
অ্যানিউরিজমকে ‘বয়স্কদের রোগ’ বলা হয়ে থাকে। পশ্চিমা বিশ্বে ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়স্কদের মধ্যে মহাধমনির পেটের অংশের অ্যানিউরিজম বা ‘ট্রিপল এ’র হার ৫-৯%। আমেরিকার প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ২-৮% এই রোগে আক্রান্ত। মহিলাদের চেয়ে পুরুষের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়। আমাদের দেশে এ রোগের ব্যাপকতার ওপর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও বুকের এক্স-রে বা পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার সময় অপ্রত্যাশিতভাবে মহাধমনির অ্যানিউরিজম আবিষ্কার বিরল নয়।
অ্যানিউরিজমের উপসর্গ
‘ট্রিপল এ’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তেমন মারাত্মক কোনো উপসর্গ তৈরি করে না। রোগীরাও তাই সাধারণত এ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না।
‘ট্রিপল এ’ এর রোগীরা অনেক সময় পেটের মধ্যখানে, দু’পাশে বা পেছনের দিকটাতে ভোঁতা এক ধরনের ব্যথা অনুভব করেন। মহাধমনির বুকের অংশের অ্যানিউরিজমের কারণে পিঠে ব্যথা ও অনেক সময় শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
রোগীর শারীরিক গড়ন পাতলা হলে পেটের মাঝখানে হৃদস্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে স্পন্দিত হতে থাকা টিউমার বা চাকার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
অ্যানিউরিজমে জীবাণুর সংক্রমণ হলে ব্যথার সঙ্গে জ্বরও হতে পারে।
অ্যানিউরিজম দ্রুত বড় হতে থাকলে বা এ থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হলে দ্রুত ব্যথার তীব্রতা বেড়ে যেতে পারে।
মহাধমনির অ্যানিউরিজম ফেটে গেলে রক্তক্ষরণের কারণে দ্রুত রক্তচাপ কমে যেতে পারে ও এক পর্যায়ে রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া না গেলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে রোগীর মৃত্যু ঘটে।
শরীরের অন্যান্য অংশে অ্যানিউরিজমের লক্ষণও এগুলোই- স্পন্দনশীল টিউমার, ব্যথা বা রক্তক্ষরণ।
অ্যানিউরিজমের স্বাভাবিক পরিণতি কী
তেমন কোনো উপসর্গ তৈরি না করলেও অ্যানিউরিজম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে এদের দেয়াল ডিমের খোসার মতো পাতলা হয়ে গিয়ে একসময় ফেটে যেতে পারে। মহাধমনির অ্যানিউরিজম ফেটে গেলে আভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। উন্নত বিশ্বে জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্দান্ত আধুনিকায়ন সত্ত্বেও এ ধরনের রোগীদের শতকরা ৭৫ জনেরও বেশি অবশেষে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। আমাদের দেশে আপাতঃ কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ মৃত্যুর যেসব ঘটনা ঘটে, তাদের মধ্যে মহাধমনির অ্যানিউরিজম ফেটে যাওয়ার ঘটনাও রয়েছে বলে অনুমান করা যায়। মস্তিষ্কের বেরি অ্যানিউরিজমে ফেটে যাওয়া মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। হাত বা পায়ের অ্যানিউরিজম ফেটে গেলেও রক্তক্ষরণে রোগীর জীবন সংকটাপন্ন হয়ে উঠতে পারে। অ্যানিউরিজম ফেটে যাওয়া এক ধরনের জরুরি অবস্থা।
স্ক্রিনিং ও নজরদারি
অ্যানিউরিজম কোনো মারাত্মক উপসর্গ তৈরি করে না, তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে এদের উপস্থিতি চোখের আড়ালেই থেকে যায়, যা খুবই বিপজ্জনক। এজন্য পশ্চিমা বিশ্বে ইদানীং ট্রিপল এ স্ক্রিনিংয়ের ব্যাপারটি বেশ জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে। পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে খুব সহজেই স্ক্রিনিংয়ের এই কাজটি করা সম্ভব। ট্রিপল এ আছে কি নেই, সেটা জানার জন্য বয়স্ক ধূমপায়ীদের এই পরীক্ষাটি করিয়ে নেয়া উচিত। ৩-৪.৫ সেন্টিমিটার ব্যাসের ট্রিপল এ’র ক্ষেত্রে বছরে একবার এবং ৪.৫-৫.০ সেন্টিমিটার ব্যাসের ট্রিপল-এ’র ক্ষেত্রে তিন মাস পর পর এই পরীক্ষা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
চিকিৎসা
সাধারণত ৫.০ সেন্টিমিটার বা তার অধিক ব্যাসের অ্যানিউরিজমকে চিকিৎসার জন্য বিবেচনা করা হয়। তবে আকারে ছোট হলেও দ্রুত বড় হচ্ছে (বছরে ১ সেন্টিমিটার বা তার বেশি) বা উপসর্গ তৈরি করছে, এমন অ্যানিউরিজমকেও চিকিৎসার আওতায় আনা উচিত। সাধারণত অপারেশনের মাধ্যমেই অ্যানিউরিজমের চিকিৎসা করা হয়। ধমনির ফুলে যাওয়া অংশকে কৃত্রিম রক্তনালীর মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা এই চিকিৎসা পদ্ধতির মূল কথা। সনাতন এই শল্য চিকিৎসা পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও এ পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রেই জটিল ও বয়স্ক রোগীদের জন্য অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ। অ্যানিউরিজম চিকিৎসায় ইদানীং নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ‘এন্ডোভাস্কুলার অ্যানিউরিজম রিপেয়ার’ (Endovascular Aneurysm Repair) বা সংক্ষেপে (EVAR) নামের এই পদ্ধতিতে বড় ধরনের কোনো অপারেশন ছাড়াই অ্যানিউরিজমের ভেতরে কৃত্রিম রক্তনালী প্রতিস্থাপন সম্ভব। উন্নত বিশ্বে প্রায় তিন দশক আগ থেকেই এ পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়েছে। ভারতেও সাম্প্রতিক এর ব্যবহার বেড়েছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি এই পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হলেও বিভিন্ন কারণে এখনও ব্যাপকতা লাভ করেনি। এই কারণগুলোর মধ্যে একটা হল খরচ। এই পদ্ধতিতে যে কৃত্রিম রক্তনালী ব্যবহার করা হয় তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।