হাওর বার্তা ডেস্কঃ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা ও ত্বকের সমস্যায় ২০১৪ সালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আসেন সিরাজগঞ্জের রোকেয়া বেগম (৪২)। চিকিৎসকরা কিডনির সমস্যা জানিয়ে ওষুধ সেবনের পাশাপাশি নিয়মিত ফলোআপের পরামর্শ দেন। কিন্তু কিছু দিন পর ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেন তিনি। দীর্ঘদিনের পুরোনো সমস্যার সঙ্গে পেট-বুকে পানি জমলে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আবার বিএসএমএমইউতে ছুটে আসেন। এবার চিকিৎসকরা কিডনি সমস্যার সঙ্গে বাতরোগে আক্রান্ত জানিয়ে রিউম্যাটোলজি বিভাগে পাঠান। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তার বাতজনিত ‘লুপাস নেফ্রাইটিস’ ধরা পড়ে। যার কারণে দুটি কিডনির প্রায় ৮০ শতাংশই বিকল হয়ে গেছে। এখন সপ্তাহে অন্তত তিনবার কিডনির ডায়ালাইসিস প্রয়োজন। রোববার রোকেয়া বেগমের ছেলে রনি হোসেন জানান, বর্তমান শারীরিক পরিস্থিতি বিবেচনায় গত দুই সপ্তাহে মাকে ১০ বার ডায়ালাইসিস দিতে হয়েছে।
রোগটি সম্পর্কে জানতে চাইলে সোমবার বিএসএমএমইউর রিউম্যাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মিনহাজ রহিম চৌধুরী বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতেম মানবদেহে প্রায় ৬০০ শতাধিক রিউমেটিক ডিজিজেস বা বাতরোগ হতে পারে। আর রিউম্যাটোলজি বিভাগের অধীনে লুপাস বা এসএলই (সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথেমেটোসাস) একটি মাল্টি সিস্টেম ডিজঅর্ডার। এতে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শরীরের বিভিন্ন কোষের বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করে। ফলে রোগীর ত্বক, চুল, শরীরের বিভিন্ন গিরা, মাংসপেশি, রক্তকণিকা, øায়ু, হৃৎপিণ্ড, খাদ্যনালী, চোখ, ফুসফুস কিডনিসহ প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করতে থাকে। বিভিন্ন অঙ্গে আক্রমণ করে বলে এই রোগের উপসর্গও বিচিত্র হয়। যেমন-দেহের ত্বকে লালচে দাগ বা ফুসকুড়ি, নাকের দু’পাশে, গালে প্রজাপতির ডানার মতো বিস্তৃত লাল দানা, মুখের ভেতরে তালুতে ঘা হতে পারে। বিশেষ করে ত্বকের সংক্রমণ এতটাই ভয়াবহ হয়, যা দেখে মনে হতে পারে নেকড়ে বাঘ আঁচর দিয়েছে।
এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির চুল পড়া, জ্বর, হাত-পা ফোলা, মাথাব্যথা, খিঁচুনি, অসংলগ্ন আচরণ, রক্তশূন্যতা, রক্তকণিকা কমে যাওয়া, পেট-বুকে পানি জমাসহ নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। এসব জটিলতা অনেক সময় মৃত্যুর কারণও হতে পারে। রোগটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম বয়সিদের অর্থাৎ ১১ থেকে ৩০ বছর বয়সে শুরু হয়। পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেশি হয়। তবে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়।
এমন পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের মতো আজ ১০ মে মঙ্গলবার দেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব লুপাস দিবস-২০২২। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘মেক লুপাস ভিজিবল অর্থাৎ লুপাসকে দৃশ্যমান করুন’। প্রতিপ্রাদ্যের মাধ্যমে রোগটি সম্পর্কে জনগণের মধ্যে স্পষ্ট ধারণা ও সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
অধ্যাপক ডা. মিনহাজ রহিম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ রিউমাটোলজি সোসাইটির উদ্যোগে রিউমেটিক বা বাতরোগে আক্রান্তদের ওপর সারা দেশে এ পর্যন্ত তিনটি জরিপ করা হয়েছে। ওই জরিপেও আক্রান্তদের সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। তবে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের ধারণা, দেশে আট থেকে থেকে ১০ লাখ মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত। সম্প্রতি রিউমাটোলজি সোসাইটি ও লুপাস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে রোগীদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয়ে লুপাস রেজিস্ট্রেশন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই রোগের চিকিৎসায় অনেক উন্নতি হয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে, যার অধিকাংশই বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া সাধারণত লুপাস রোগটি রিউমাটোলজি বিভাগের অধীনে হয়ে থাকে। রিউমাটোলজি বা বাতরোগের চিকিৎসায় বিএসএমএমইউতে একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগ চালু আছে। এই বিভাগে ১৯৯৩ সাল থেকে লুপাস ক্লিনিক চালু হয়েছে। যেখানে কয়েক লাখ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। সম্প্রতি ঢাকার বাইরে আটটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিউমাটোলজি বিভাগ খোলার প্রক্রিয়া চলছে। রোগটির চিকিৎসায় সারা দেশে ৬০ জন রিউমাটোলজি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হলো অসচেতনতার কারণে দেশে সঠিক সময়ে লুপাস রোগ নির্ণয় কম হচ্ছে। যার ফলে অনেক রোগী চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
দিবসটি উপলক্ষ্যে লুপাস রোগীদের সমন্বয়ে গঠিত লুপাস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, বিএসএমএমইউর রিউমাটোলোজি বিভাগ ও রিউমাটোলজি সোসাইটির উদ্যোগে জনসচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি পালিত হবে। দেশের ৮ বিভাগে চিকিৎসক, নার্স, রোগী ও অভিভাকদের নিয়ে সচেতনতামূলক র্যালি, লিফলেট বিতরণ ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক লুপাস ফেডারেশন দিবসটি উপলক্ষ্যে চলতি বছর মার্চ থেকে বিশ্বব্যাপী লুপাস আক্রান্ত ব্যক্তিদের অঙ্গ-প্রতঙ্গে লুপাসের প্রভাব সম্পর্কে একটি অনলাইন জরিপ পরিচালনা করছে যা এ বছর প্রকাশ করা হবে।