হাওর বার্তা ডেস্কঃ উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত হাওর অঞ্চলে অন্তত পাঁচ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এসব জমির নষ্ট হওয়া ফসলের বাজারমূল্য প্রায় ১০৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। হাওরের বেশ কিছু ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে। কিছু বাঁধ ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে।
এসব বাঁধ ভেঙে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে। কৃষকরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
তবে কৃষি বিভাগের দেওয়া হিসাবের চেয়ে বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি বলে কৃষকরা আশঙ্কা করছেন। কারণ প্রতিদিনই নতুন নতুন ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যাচ্ছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২ এপ্রিল টাঙ্গুয়ার হাওরের তাহিরপুর উপজেলার নজরখালি ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে যায়। এতে মধ্যনগর উপজেলা ও তাহিরপুর উপজেলার কাঁচা বোরো ধান তলিয়ে যায়। পাশাপাশি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ছোট কানলার হাওর, ছাতক উপজেলার পাগুয়ার হাওর, শাল্লা উপজেলার পুঁটিয়ার হাওর, কৈয়াবন হাওর, ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল হাওর, দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরসহ ১৪টি হাওরের মোট চার হাজার ৯০০ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে যায়। এর মধ্যে বেশি ফসল নষ্ট হয়েছে দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরে। বৃহস্পতিবার কালনী নদীর তীরের বৈশাখীর বাঁধ ভেঙে এই ফসলহানির ঘটনা ঘটেছে। এতে তিনটি ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রামের কৃষকের একমাত্র ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের এরাইল্যাকোনা বাঁধটি ভেঙে গেছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র গতকাল রাতে জানায়, আগামী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে উজানে ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এতে হাওরাঞ্চলে পানির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে।
এদিকে সকালে বাঁধ ভেঙে ফসল ডুবে যাওয়া দিরাই উপজেলার চাপতির হাওর পরিদর্শন করেছেন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম। এ সময় কৃষকরা তাঁকে বৈশাখী বাঁধের বদলে পাশের কচুয়া গ্রামের পাশের চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বেড়িবাঁধটি স্থায়ীভাবে করে দেওয়ার অনুরোধ জানান। বৈশাখী ফসল রক্ষা বাঁধের কোরে (বাঁধঘেঁষা গভীর গর্ত) প্রতিবছর বাঁধটিকে ঝুঁকিপূর্ণ রাখলেও যথাযথভাবে কাজ করা হয় না বলে উপমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন কৃষকরা।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বলেন, জেলার ১৫টি হাওরের চার হাজার ৯০০ হেক্টর বোরো জমির ধান তলিয়ে গেছে। সাধারণত প্রতি হেক্টরে চার মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়। ৫০ হাজার টাকা মেট্রিক টন দরে এসব চালের মূল্য ৯৮ কোটি টাকা।
নেত্রকোনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলার খালিয়াজুরী উপজেলায় ১২৩ হেক্টর ও মদনে ১০ হেক্টর জমির ধান বিনষ্ট হয়েছে। প্রতি হেক্টরে চার মেট্রিক টন চালের উৎপাদন ধরে এসব জমির ফসলের ক্ষতির পরিমাণ দুই কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
খালিয়াজুরী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, এরই মধ্যে তলিয়ে যাওয়া জমি বাঁধের বাইরে ছিল। বাঁধের আওতায় খালিয়াজুরীর হাওরে আগাম জাতের ব্রিধান-২৮ ও হাইব্রিড ধান মিলিয়ে ১৮ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। এই জমিতে এক লাখ ১৩ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন ধান উৎপন্ন হওয়ার কথা। এই ফসলের সঙ্গে জড়িত কমপক্ষে ২৫ হাজার কৃষক পরিবার। বাঁধ ভেঙে গেলে ওই জমির ধান মুহূতেই পানিতে তলিয়ে যাবে।
পাউবো ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, পানির চাপে খালিয়াজুরীর কীর্তনখোলা হাওর ছাড়াও চুনাই হাওর, বাইদ্যার চর, কাটকাইলের কান্দা, পায়া হাওর, দৈলং হাওরে বাঁধের বিভিন্ন স্থান ঝুঁকিতে আছে। বাঁধের এমন নড়বড়ে অবস্থার কারণে হাওরপারের কমপক্ষে ২৫ হাজার কৃষক পরিবার তাদের ফসল নিয়ে এখনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে। বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অংশে শত শত কৃষক বাঁশ, মাটিভর্তি বস্তা দিয়ে রাত-দিন স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামতের কাজ করছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জানান, এ বছর সারা জেলায় বোরো আবাদ হয়েছে এক লাখ ৮৪ হাজার ৮২৮ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় সাত লাখ ৭০ হাজার ৭০২ মেট্রিক টন চাল।
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, খালিয়াজুরীতে চারটি পোল্ডারে ১৮১ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ফসল রক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কীর্তনখোলা বাঁধ। যার দৈর্ঘ্য সাত কিলোমিটার। এই বাঁধের পাঁচ কিলোমিটার অংশ পানির চাপে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী সেখানে ৩৫০ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়েছে। সরকারি হিসাবে প্রতি হেক্টর জমিতে চার মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়। সে হিসাবে পানিতে নষ্ট হয়েছে এক হাজার ৪০০ মেট্রিক টন চাল, যার বাজারমূল্য সাত কোটি টাকা।
তবে হাওরের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে।
উজানের পাহাড়ি ঢল কিশোরগঞ্জের দিকে এসে প্রথম হানা দেয় ইটনা উপজেলায়। কৃষি বিভাগের হিসাবে পানিতে ইটনায় তলিয়েছে প্রায় ২৮৫ হেক্টর বোরো জমি। একরে যার পরিমাণ প্রায় ৮০০ একর। এ উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত হাওরগুলো হচ্ছে—আফাইন্যার হাওর, চাচুয়ার হাওর, মৃগার হাওর, জিওলের বাঁধ এলাকার হাওর ও নদী তীরের নিচু জমি।