হাওর বার্তা ডেস্কঃ এ যেন আরতুগ্রুল গাজীর অটোমান বা উসমানীয় আমলের রীতিকে ফিরিয়ে আনল চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার একটি বাজার।
উসমানীয় সাম্রাজ্যে সামর্থ্যবানরা তাদের পরিবারের চাহিদার তুলনায় একটু বেশিই পণ্য কিনতেন দোকানে গিয়ে। আর বাড়তি পণ্যগুলো ওই দোকানেরই সামনে ঝুলন্ত ঝুড়িতে রেখে দিয়ে আসতেন। যাতে করে ক্ষুধার্ত, হতদরিদ্ররা সেই ঝুড়ি থেকে পণ্য বিনামূল্যে বাড়ি নিয়ে যেতেন।
হাটহাজারীর দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের মদুনাঘাট বাজারে এমন মহান রীতি চালু করেছে বাজারের একটি সবজির দোকান। সেই দোকানের সামনে রাখা আছে ঝুড়ি। পাশে ঝোলানো ফেস্টুনের লেখা, ‘যাদের সামর্থ্য আছে তারা ডোনেট বাক্সে সবজি রাখবেন, আর যাদের সবজি কেনার টাকা নাই; তারা ডোনেট বাক্স থেকে সবজি নিতে পারবেন।’
এটা দেখে অনেকেই তাদের কেনা সবজি’র কিছু অংশ ওই ঝুড়িতে রাখছেন; আর যাদের কেনার সামর্থ্য নেই তারা এসে ঝুড়ি থেকে বিনামূল্যে সবজি নিয়ে যাচ্ছেন।
বিনামূল্যের সবজির হাটটি এখন ‘মানবিক বাজার’ নামে বেশ পরিচিতি পেয়েছে। বিগত দুই সপ্তাহ আগে উদ্যোক্তারা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে চালু করেছেন এই রীতি। তাদের এই উদ্যোগ ইতোমধ্যে দেশব্যাপী বেশ সাড়া ফেলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা রীতিমতো ভাইরাল।
এ মানবিক বাজারের উদ্যোক্তা সবাই হাটহাজারী ও পাশ্ববর্তী উপজেলা রাউজানের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। তারা হলেন – স্বেচ্ছাসেবী রাশেদ উদ্দিন, আবু হাসান, আরশাদ সিদ্দিকী, কায়সার আলী চৌধুরী, মো. আলম, সানাউল্লাহ চৌধুরী এবং নাসির ফারুকী।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, শুধু মদুনাঘাট বাজারে নয়, সবমিলিয়ে এমন ‘মানবিক বাজার’ সাতটি স্পটে খুলেছেন তারা। এসব স্পটগুলো হলো – হাটহাজারীর দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের মদুনাঘাট, বুড়িশ্চর ইউনিয়নের নজুমিয়াহাট, নগরীর চকবাজার, কাজিরহাট, পূর্ব বাকলিয়া, চান্দঁগাও কালামিয়া বাজার ও পাহাড়তলী থানার অলংকার এলাকায়।
গত ৮ মার্চ নগরীর খুলশী গরিব উল্লাহ শাহ হাউজিং সোসাইটি এলাকায় প্রথম এ বাজার চালু করা হয়। উদ্যোক্তা আরও একাধিক স্থানে এ রকম বাজার চালু করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন বলে জানালেন।
সরেজমিনে বুড়িশ্চর ইউনিয়নের নজুমিয়াহাট বাজারে দেখা যায়, এক গৃহিণী সবজি কিনে দোকানের পাশে রাখা মানবিক বাজারের ঝুড়িতে বেগুন, টমেটো, আলুসহ আরও নানান সবজি রেখে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই গৃহিণী বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে আশপাশে কিছু অসহায় ও হতদরিদ্ররা সবজি কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন। দিনাতিপাত করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তাদের। আমাদের সামর্থ্য থাকায় বাজার করে কিছু সবজি এসব সামর্থ্যহীনদের জন্য ডোনেট বাক্সে (ঝুড়িতে) রেখে যাচ্ছি।’
ঝুড়ি থেকে সবজি নিয়ে আসা মাইমুনা আক্তার নামে এক গৃহপরিচারিকা বলেন, ‘আমার বাবা নেই। মানুষের বাড়িতে কাজ করে পরিবারের ৬ সদস্যের খরচ চালাই। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন হিমশিম খাচ্ছি। তাই এলাকার তরুণদের এমন মহৎ উদ্যোগের কথা শুনে বাজারে এসে পরিবারের সদস্যদের জন্য সবজি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি।’
এ ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের একজন মুহাম্মদ রাশেদ উদ্দিন বলেন, ‘করোনা সংকটের পর যেভাবে দ্রব্যমূল্য ও সবজির দাম বেড়েছে, তাতে অনেকেই না খেয়ে মরার অবস্থা । আমরা কয়েকজন মিলে চিন্তা করে এ রকম একটি উদ্যোগ নিই, যাতে দরিদ্র লোকজন উপকৃত হবেন।’
জানতে চাইলে হাটহাজারীর বুড়িশ্চর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহেদ হোসাইন বলেন, ‘হতদরিদ্র গরিব মানুষের জন্য এলাকার তরুণদের গড়ে তোলা ‘মানবিক বাজার’ সারা দেশে ছড়িয়ে যাক। এতে করে মেহনতি মানুষরা ভীষণভাবে উপকৃত হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ সময় এই উদ্যোগকে সকলে স্বাগত জানাই। এই ব্যতিক্রমী মহতি উদ্যোগকে সারাদেশে অনুকরণীয় হোক এমনটাই প্রত্যাশা থাকবে।’