খাদ্যশষ্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে এখন যে দিকেই চোখ যায়, দেখা যাবে একই দৃশ্য। ধান কাটা, মাড়াই ও পরিহন। যেন হাওর জুড়ে ধান কাটার এক উৎসব বিরাজমান। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ জেলার বিভিন্ন হাওরে হাজার হাজার কৃষক ও কৃষি শ্রমিকরা ধানকাটা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বসে নেই বাড়ির কৃষাণি-গৃহবধূ এমনকি শিশুরাও।
হয়েছে। মওসুমের শুরুতে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুতের দুঃসহ লোডশেডিংসহ নানা প্রতিকূলতার পরও ধানের ফলন হয়েছে বাম্পার। তবে বাড়তি ফলনেও খুশি হতে পারছেনা কৃষক। বাজারে ধানের দাম কম থাকায় তাদের মাথায় হাত পড়েছে। লাভতো দূরের কথা তাদের আশঙ্কা নতুন ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ উঠাতে পারবেন কি না সেটা নিয়ে।
তারা বলছেন, বাজারে ধানের দামের সঙ্গে উৎপাদন খরচের হিসাব মিলছে না। এরই মাঝে বাজারে নতুন ধান আসতে শুরু করেছে। তবে বাজারে ধানের দাম কম।
অনেক কৃষক বলছেন, এক মণ ধান ঘরে তোলা পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৭শ টাকা কিন্তু বাজারে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৪শ থেকে ৫শ টাকা।
নিকলী উপজেলার দামপাড়া এলাকার কৃষক মজনু মিয়া জানান, তার বিরি-২৮ জাতের ধান পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। দৈনিক ৬শ টাকা মজুরি দিয়ে ধান কাটিয়েছেন। জমির পাশে কাঁচা ধান বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪শ টাকা মণ। এতে তার লাভতো হবেই না উৎপাদন খরচও উঠবেনা।
জেলার মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও ইটনায় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার ধানের ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ বেশি আর ধানের বিক্রয়মূল্য কম থাকায় তাদের পোষাচ্ছে না। বিভিন্ন হাওরে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা নিয়ে কম টাকায় ধান কিনছে এক শ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ী। বড় হাওরে দেখা গেছে জমির পাশেই ব্যবসায়ীরা ধান কিনে বস্তাভর্তি করছেন।
ফায়েজ উদ্দিন নামে এক ক্রেতা জানালেন, তিনি ৪শ টাকা মণ ধরে ধান কিনছেন। এ মৌসুমে তার বিশ হাজার মণ ধান কেনার টার্গেট আছে।
নিকলীর গোয়াইহাটি এলাকার কৃষক আরজ আলী জানান, ২৫ জন কৃষিশ্রমিক প্রতিদিন তার জমিতে ধান কাটছে। তাদের পারিশ্রমিক দিতে হয় দৈনিক ১৫ হাজার টাকা। এ জন্য তিনি ৪শ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করছেন।
তবে ফলন বেশি হওয়ায় এখন তারা সোনালী ধান গোলায় তোলার আয়োজন নিয়েই বেশি ব্যস্ত। বিভিন্ন হাওরে দিনভর চলছে ধানকাটা, মাড়াই ও পরিবহন। কৃষকদের নাওয়া-খাওয়া সবই চলছে ফসলের মাঠে। আর রাত্রি যাপন হচ্ছে মাঠের পাশের অস্থায়ী ঘরে। চড়া মজুরি দিয়েও মিলছেনা কৃষি শ্রমিক। ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে কিশোরগঞ্জের চামড়া নৌ-বন্দর দিয়ে হাজার হাজার মণ ধান পরিবহন করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৭৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৫৮ হাজার ১২১ মে.টন চাল। কৃষি বিভাগ বলছে, গত বছরের মতো এবারও ছাড়িয়ে যাবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শফিকুল ইসলাম খান ধানের দাম কম হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগে ধান কেনা শুরু হলে বাজারে ধানের দাম বাড়বে। তাছাড়া বোরো ধানের উৎপাদন খরচ কিভাবে কমিয়ে আনা যায় এ নিয়ে কৃষি বিভাগ কাজ শুরু করেছে বলেও জানান তিনি।
হাওরের কৃষকরা জানিয়েছেন, বৈশাখের প্রথম সপ্তাহেই আগাম জাতের ধান কাটা শেষ হবে। তবে হাওরের নিচু এলাকার ধান কাটা শেষ হতে আরও অন্তত ১৫ দিন লাগবে। তাই প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়ে ভালোয় ভালোয় মাঠের ফসল ঘরে উঠবে আর বাজারে বাড়বে ধানের দাম এমন প্রত্যাশায় আছেন তারা।