নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, চারটি শক্তির মিলন আমাদের এগিয়ে যাওয়ার মহাশক্তি তৈরি করতে পারে। এগুলো হলো তারুণ্য, প্রযুক্তি, সামাজিক ব্যবসা ও সুশাসন। এই চার শক্তির মেলবন্ধনে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে উন্নত বাংলাদেশ ও শান্তির পৃথিবী এমনিতেই গড়ে উঠবে। স্বপ্নের দারিদ্র্যশূন্য, বেকারশূন্য ও কার্বন নিঃসরণশূন্য পৃথিবী বাস্তবায়ন করা যাবে। এ জন্য তরুণদেরকে নিজেদের সৃজশীলতার প্রতি আস্থা রেখে এগিয়ে যেতে হবে। উন্নয়নের জন্য প্রচলিত গণ্ডির বাইরে গিয়ে সৃজশীলতার ব্যবহার ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই।
গতকাল সোমবার রাজধানীর পুলিশ স্টাফ কলেজের কনভেনশন হলে সামাজিক ব্যবসা একাডেমিয়া ২০১৫ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সোস্যাল বিজনেস একাডেমি সেল (এসবিএসি) এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশি ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বন-গাছ আছে বলে পৃথিবী ও মানুষ টিকে আছে। মানুষ সেই বন-গাছ উজাড় করে দিচ্ছে। স্বার্থপর হতে গিয়ে অন্যের সঙ্গে নিজেদেরও ক্ষতি করছে। কিন্তু মানুষ শুধু স্বার্থপর নয়, স্বার্থহীনও। বিভিন্ন গুণের অমিত আধার মানুষ। তাই স্বার্থহীনতার গুণ দিয়ে স্বার্থপরতাকে পরাজিত করতে হবে।
তিনি বলেন, বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দিনে দিনে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। আমরা এ ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি বলে পরিবর্তনটা এখনও অনুভব করতে পাচ্ছি না। প্রচলিত অর্থ ব্যবস্থা ও জীবনযাত্রায় গলদ রয়েছে। এর ফলে পৃথিবী বাসযোগ্য থাকবে না। পৃথিবীকে বাসের অনুপযোগী করে তুলছি। বিদ্যমান কাঠামোতে ধনী বা শক্তিশালী ব্যক্তি আরো বড় হচ্ছে, উপরে উঠছে। আর নিচের মানুষ আরো তলানিতে যাচ্ছে। এ ব্যবস্থা পাল্টাতে হবে। সবার জন্য সুষম না হোক, অন্তত গ্রহণযোগ্য ভোগের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
তিনটি পি’র প্রতি উদ্যোক্তাদের নজর দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যমান ব্যবসা পদ্ধতিতে ব্যক্তির বা উদ্যোক্তার নজর শুধু একটি পি’তে। এই পি হলো প্রফিট বা লাভ। কিন্তু অপর দুই পি অর্থাত্ পিপল ও প্লানেট বা মানুষ ও পৃথিবীর প্রতি নজর দিতে হবে। তাদের সাফল্যও এ তিন পি বিবেচনায় নিয়ে মাপা দরকার।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পৃথিবীর সম্পদ অশেষ নয়। কিন্তু দায়িত্বশীল ভূমিকার মাধ্যমে এটি বাড়ানো যায়। আমাদের এখনই ঠিক করতে হবে, আমাদের প্রজন্ম কতটুকু ভোগ করবে এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কতটুকু রেখে যাব। আমরা অনেক বর্জ্য তৈরি করছি ও সমুদ্রে ফেলছি। সমুদ্রের বিভিন্ন স্থানে বিশাল পরিমাণ বর্জ্য জমে গিয়ে পরিবেশের প্রতি মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। রিসাইকেল বা পুন:চক্রায়ন করে সম্পদ তৈরির চেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বর্জ্য উত্পাদন নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, কার্বন নিঃসরণের ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। ফসিল ফুয়েল ব্যবহার দূর করে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করতে হবে।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূস বলেন, আমাদের প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গরীবের ব্যাংকিং নেই। প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে তৈরি যে, এগুলো নিচের দিকে না তাকিয়ে উপরের দিকে ছুটছে। আমাদের ব্যাংকিং আইনটিতে মূলত: ধনীর জন্য ব্যাংক, গরীবের জন্য নয়- এমন নীতি প্রতিফলিত হয়েছে। এটি পরিবর্তন করতে হবে।
গ্রামীণ ব্যাংকের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতারা চাকরিজীবী নয়, উদ্যোক্তা। তারা তেমন শিক্ষিতও নয়। অর্থ ঋণ নিয়ে তারা উন্নতি করতে পারলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বা পাস করা তরুণ-তরুণীরা কেন পারবে না? তাহলে শিক্ষার অবদান কী? সমস্যা শিক্ষা বা শিক্ষার্থীদের নয়। গলদ রয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। চাকরি করার ঝোঁক থেকে তরুণদের বের হতে হবে। তাদেরকে উদ্যোক্তা হতে হবে। তরুণদের সৃজনশীল ক্ষমতার প্রয়োগই পারে বাংলাদেশ ও বিশ্বকে ইতিবাচকভাবে বদলে দিতে।
সম্মেলনের সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ডা. এস কাদির পাটোয়ারী বলেন, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। আরো উন্নয়নের জন্য সামাজিক ব্যবসা বড় দরজা খুলে দিয়েছে।
সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ডিআইইউ’র ভিসি অধ্যাপক কে এম মোহসীন, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম, ইউনূস সেন্টারে নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোর্শেদ, কানাডাভিত্তিক সেবাসংস্থা হেলথব্রিজ’র কান্ট্রি ডিরেক্টর দেবরা ইফরমসন, গ্রামীণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক এইচ আই লতিফী, গ্রামীণ কমিউনিকেশনের নাজনিন সুলতানা, গ্রামীণ হেলথ সার্ভিসের কে এম আসাদুজ্জামান, গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টের পারভীন মাহমুদ, গ্রামীণ কৃষির এহসানুল বারি, ডিআইইউর সহকারী অধ্যাপক মো. বজলুর রহমান।