ঢাকা ০৩:৪৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত নওগাঁর কারিগররা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:৪৪:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল ২০১৬
  • ৩৭১ বার

বাঁশির গ্রাম হিসেবে পরিচিত নওগাঁর দেবীপুর। বৈশাখের বিভিন্ন মেলাকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। পরিবার পরিজন নিয়ে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে শুধু বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত সবাই। অনেকে ধার দেনা করে টাকা পয়সা নিয়ে বাঁশি তৈরির সরঞ্জাম কিনে বাঁশি তৈরি করছেন। ক্ষুদ্র এই কুটির শিল্পকে রক্ষা করেত সরকারি নজরদারিসহ ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন কারিগররা।

জানা গেছে, দেবীপুর গ্রামের প্রায় ২০০টির অধিক পরিবার বাঁশি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। বছরের ছয় মাস বাঁশির ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ হলেও বাকি সময়টা কষ্ট করে পার করতে হয়।

বাঁশি তৈরির প্রধান কাঁচামাল নল। জমি থেকে নল কাটার পর তা রোদে ৫/৬ দিন শুকানো হয়। এরপর নল পরিষ্কার করে মাপ মতো কেটে ছোট ছোট করা হয়। বাঁশির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাঁশির উপর এক প্রকার চকচকে কাগজ (জুরি) পেঁচানো হয়। এছাড়া বাঁশিতে বিভিন্ন রঙের বেলুন লাগানো হয়। সাধারণ বাঁশিগুলোর দাম ১০/১৫ টাকা এবং হাজারে প্রায় ৮০০-৯০০টাকা। আর বেলুন ও জরি পেঁচানো বাঁশি ২০/২৫ টাকা এবং হাজারে প্রায় ১১০০-১১৫০ টাকা দাম।

শুধু বাঁশিই না পাশাপাশি গুনা (তার), প্লাস্টিক, কাগজ ও কাপড় দিয়ে বিভিন্ন ফুলও তৈরি করা হয় এই গ্রামে। বাজার থেকে এসবের উপকরণ পাইকারি কিনে এনে বিভিন্ন ধরনের ফুল তৈরি করা হয়। প্রতিটি ছোট আকারের ফুলের দাম ১৫/২০ টাকা।

সরজমিনে দেবীপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, যে যার মতো বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত আছেন। কেউ নল পরিষ্কার করছে, কেউ নল কাটছে, আবার কেউ সাইজ করে বাঁশি তৈরি করছে। আবার কেউ বাঁশির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য জরি এবং বেলুন লাগাচ্ছেন। মনে হচ্ছে দম ফেলা সময় তাদের নেই। বাঁশি তৈরিতে বেশি কাজ করেন মেয়েরা। আর পুরুষা সেই বাঁশি নিয়ে ৭/১০দিনের জন্য চুয়াডাঙ্গা, সিলেট, বগুড়া, পাবনা, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, ঢাকা, খুলনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় যান।

বাঁশি তৈরির কারিগর মৌসুমি ও রাশেদা জানান, বাড়ির পুরুষরা বাঁশি নিয়ে বিভিন্ন মেলায় যান। আর আমরা বাড়িতে বসে সংসারের কাজের পাশাপাশি বাঁশি তৈরি করি। পুরুষরাও বাঁশি তৈরিতে সহযোগিতা করে। সারা বছরই বাঁশি তৈরি করা হয়।

কারিগর আজাদ ও আব্দুল হাকিম জানান, প্রতি বছরই মাল্টিপারপাস, বিভিন্ন সমিতি থেকে ধার দেনা ও সুদের উপর টাকা নিয়ে বাঁশি তৈরি করে মেলায় বেঁচা হয়। এতে যে লাভ হয় তা থেকে ধার-দেনা পরিশোধ করা হয়। অনেক সময় আবহাওয়া খারাপ হলে ব্যবসা ভাল না হওয়া ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। ক্ষুদ্র এই কুটির শিল্প রক্ষার জন্য সরকারের নজরদারিসহ সরকারকে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার দাবি জানান।

জব্বার মন্ডল তার স্ত্রীকে নিয়ে ফুল তৈরি করছেন। মেলা উপলক্ষে ফুল ও বাঁশি নিয়ে তিনিসহ ৮/৯ জন চুয়াডাঙ্গা জেলার ডিঙ্গাডা মেলায় যাবেন। ১০/১২ দিন সেখান থাকবেন। এতে প্রায় ১৫/২০ হাজার টাকা বা তার চেয়েও বেশি টাকা বেচা বিক্রি হবে বলে আশা করছেন। বিক্রি বেশি হলে লাভও ভাল থাকবে বলে জানান।

কারিগর সাজেদুর জানান, নলের চাষ করার জন্য ৫ বছরের জন্য এক বিঘা জমি বন্ধক নিয়েছেন। এক বিঘা জমির নল থেকে প্রায় ৪০/৫০ হাজার বাঁশি তৈরি হবে।

বিক্রেতা খোকন জানান, ফসলি জমি না থাকায় বাঁশির ব্যবসার উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। মহাজনের কাছ থেকে বাকিতে বাঁশি কিনে বিভিন্ন জেলার বড় বড় মেলায় বেচে যে লাভ হয় তা থেকে বাকি টাকা পরিশোধ করা হয়। বছরের ছয় মাস বাঁশির ব্যবসা হয় আর বাকি সময় রিকশা-ভ্যান চালাতে হয়।

মহাজন আনিছুর রহমান জানান, তার কাছ থেকে গ্রামের প্রায় ৫০ জনের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাকিতে মালপত্র কিনে নেয়। পরে ব্যবসার লাভের টাকা থেকে পরিশোধ করেন। তিনি নিজেও পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করেন। এই গ্রাম থেকে বছরের প্রায় ৫০ লাখের মতো বাঁশি দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। এমনকি বিদেশেও পাঠানো হয়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত নওগাঁর কারিগররা

আপডেট টাইম : ১০:৪৪:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল ২০১৬

বাঁশির গ্রাম হিসেবে পরিচিত নওগাঁর দেবীপুর। বৈশাখের বিভিন্ন মেলাকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। পরিবার পরিজন নিয়ে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে শুধু বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত সবাই। অনেকে ধার দেনা করে টাকা পয়সা নিয়ে বাঁশি তৈরির সরঞ্জাম কিনে বাঁশি তৈরি করছেন। ক্ষুদ্র এই কুটির শিল্পকে রক্ষা করেত সরকারি নজরদারিসহ ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন কারিগররা।

জানা গেছে, দেবীপুর গ্রামের প্রায় ২০০টির অধিক পরিবার বাঁশি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। বছরের ছয় মাস বাঁশির ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ হলেও বাকি সময়টা কষ্ট করে পার করতে হয়।

বাঁশি তৈরির প্রধান কাঁচামাল নল। জমি থেকে নল কাটার পর তা রোদে ৫/৬ দিন শুকানো হয়। এরপর নল পরিষ্কার করে মাপ মতো কেটে ছোট ছোট করা হয়। বাঁশির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাঁশির উপর এক প্রকার চকচকে কাগজ (জুরি) পেঁচানো হয়। এছাড়া বাঁশিতে বিভিন্ন রঙের বেলুন লাগানো হয়। সাধারণ বাঁশিগুলোর দাম ১০/১৫ টাকা এবং হাজারে প্রায় ৮০০-৯০০টাকা। আর বেলুন ও জরি পেঁচানো বাঁশি ২০/২৫ টাকা এবং হাজারে প্রায় ১১০০-১১৫০ টাকা দাম।

শুধু বাঁশিই না পাশাপাশি গুনা (তার), প্লাস্টিক, কাগজ ও কাপড় দিয়ে বিভিন্ন ফুলও তৈরি করা হয় এই গ্রামে। বাজার থেকে এসবের উপকরণ পাইকারি কিনে এনে বিভিন্ন ধরনের ফুল তৈরি করা হয়। প্রতিটি ছোট আকারের ফুলের দাম ১৫/২০ টাকা।

সরজমিনে দেবীপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, যে যার মতো বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত আছেন। কেউ নল পরিষ্কার করছে, কেউ নল কাটছে, আবার কেউ সাইজ করে বাঁশি তৈরি করছে। আবার কেউ বাঁশির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য জরি এবং বেলুন লাগাচ্ছেন। মনে হচ্ছে দম ফেলা সময় তাদের নেই। বাঁশি তৈরিতে বেশি কাজ করেন মেয়েরা। আর পুরুষা সেই বাঁশি নিয়ে ৭/১০দিনের জন্য চুয়াডাঙ্গা, সিলেট, বগুড়া, পাবনা, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, ঢাকা, খুলনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় যান।

বাঁশি তৈরির কারিগর মৌসুমি ও রাশেদা জানান, বাড়ির পুরুষরা বাঁশি নিয়ে বিভিন্ন মেলায় যান। আর আমরা বাড়িতে বসে সংসারের কাজের পাশাপাশি বাঁশি তৈরি করি। পুরুষরাও বাঁশি তৈরিতে সহযোগিতা করে। সারা বছরই বাঁশি তৈরি করা হয়।

কারিগর আজাদ ও আব্দুল হাকিম জানান, প্রতি বছরই মাল্টিপারপাস, বিভিন্ন সমিতি থেকে ধার দেনা ও সুদের উপর টাকা নিয়ে বাঁশি তৈরি করে মেলায় বেঁচা হয়। এতে যে লাভ হয় তা থেকে ধার-দেনা পরিশোধ করা হয়। অনেক সময় আবহাওয়া খারাপ হলে ব্যবসা ভাল না হওয়া ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। ক্ষুদ্র এই কুটির শিল্প রক্ষার জন্য সরকারের নজরদারিসহ সরকারকে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার দাবি জানান।

জব্বার মন্ডল তার স্ত্রীকে নিয়ে ফুল তৈরি করছেন। মেলা উপলক্ষে ফুল ও বাঁশি নিয়ে তিনিসহ ৮/৯ জন চুয়াডাঙ্গা জেলার ডিঙ্গাডা মেলায় যাবেন। ১০/১২ দিন সেখান থাকবেন। এতে প্রায় ১৫/২০ হাজার টাকা বা তার চেয়েও বেশি টাকা বেচা বিক্রি হবে বলে আশা করছেন। বিক্রি বেশি হলে লাভও ভাল থাকবে বলে জানান।

কারিগর সাজেদুর জানান, নলের চাষ করার জন্য ৫ বছরের জন্য এক বিঘা জমি বন্ধক নিয়েছেন। এক বিঘা জমির নল থেকে প্রায় ৪০/৫০ হাজার বাঁশি তৈরি হবে।

বিক্রেতা খোকন জানান, ফসলি জমি না থাকায় বাঁশির ব্যবসার উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। মহাজনের কাছ থেকে বাকিতে বাঁশি কিনে বিভিন্ন জেলার বড় বড় মেলায় বেচে যে লাভ হয় তা থেকে বাকি টাকা পরিশোধ করা হয়। বছরের ছয় মাস বাঁশির ব্যবসা হয় আর বাকি সময় রিকশা-ভ্যান চালাতে হয়।

মহাজন আনিছুর রহমান জানান, তার কাছ থেকে গ্রামের প্রায় ৫০ জনের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাকিতে মালপত্র কিনে নেয়। পরে ব্যবসার লাভের টাকা থেকে পরিশোধ করেন। তিনি নিজেও পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করেন। এই গ্রাম থেকে বছরের প্রায় ৫০ লাখের মতো বাঁশি দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। এমনকি বিদেশেও পাঠানো হয়।