হাওর বার্তা ডেস্কঃ তালেবানরা বাবাকে হত্যার পর জাল পাসপোর্টে আফগানিস্তান থেকে প্রথমে পাকিস্তান পালিয়ে যান নাদিয়া নাদিম।
দেশ পালানো মেয়েটিই এখন ফুটবল মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ডেসমার্কে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তু মেয়েটিকেই সে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফুটবলার বলে মেনে নিয়েছেন অনেকে।
৩৪ বছরের নাদিয়াকে অনেকে সর্বকালের সেরা আফগান মহিলা ফুটবলারের তকমাও দিয়েছেন। খবর ইন্ডিয়া ডটকমের।
শুধু খেলাতে থেমে নেই কঠোর পরিশ্রমী আফগান নারী। পাঁচ বছরের কঠোর অধ্যবসায়ের ফল হিসেবে মেডিকেল পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উতরে গিয়েছেন তিনি।
তবে চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছে মেটানোর আগে নিজের আরও কয়েকটি স্বপ্নপূরণ করে ফেলেছেন নাদিয়া নাদিম!
ক্লাব বা আন্তর্জাতিকস্তরে ফুটবল নিয়ে দৌড়ে বেড়ানোর পাশাপাশি ডাক্তারি পরীক্ষার পড়াশোনাও সমান তালে চালিয়ে গিয়েছেন নাদিয়া। তাতে পাশ করার পর টুইট করে ধন্যবাদ দিয়েছেন অগণিত শুভানুধ্যায়ীকে।
টুইটে নাদিয়া লিখেছেন, ‘প্রথম দিন থেকে আমার পাশে থাকার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। চলার পথে যেসব নতুন বন্ধুকে পেয়েছি, তাদের সাহায্য ছাড়া এসব সম্ভব হতো না। আমার ওপর ভরসা করার জন্য আপনাদের কাছে চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকব’
বিপক্ষের কড়া রক্ষণকে তছনছ করে গোলরক্ষককে বোকা বানানোর মতোই এককালে তালিবানদের বোকা বানিয়েছিলেন নাদিয়া।
তখন তার বয়স মাত্র ১১! ওই বয়সেই কাবুলের দক্ষিণে হেরাট শহরে তাদের ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন নাদিয়ারা।
২০০০ সালে ১১ বছরের নাদিয়া এক দিন খবর পেলেন, তার বাবা রাব্বানি নাদিমকে তালেবান জঙ্গিরা তুলে নিয়ে গেছে। সেসময় রাব্বানি ছিলেন আফগান সেনাবাহিনীর জেনারেল। সেদিনের পর বাবাকে আর দেখতে পাননি তিনি।
শুনেছিলেন, কোনও এক মরুভূমিতে বাবাকে ফাঁসিকাষ্টে ঝুলিয়ে দিয়েছে তালেবান। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের নিয়ে আফগান ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন নাদিয়ার মা হামিদা। এর পর তালেবান জঙ্গিদের বোকা বানিয়ে ভুয়া পাসপোর্টে দেশ ছেড়েছিলেন নাদিয়ারা। সঙ্গে মা এবং চার বোন।
ভিটেমাটিসহ নিজেদের প্রায় সব কিছু বেচে ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে প্রথমে পাকিস্তান পৌঁছান নাদিয়ারা। সেখান থেকে ট্রাকে করে ইটালি। তার পর লন্ডন। শেষমেশ পা রাখেন ডেনমার্কে।
ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমে নাদিয়া বলেছিলেন, আফগানিস্তানের স্মৃতিগুলো সুখের নয়। বেশ অশান্তির আর বেশির ভাগই ভয়ের। আফগানিস্তানে আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত ছিল না।
ডেনমার্কের গ্রামে এসে একটি শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই হয়েছিল নাদিয়াদের। শিবিরের মাঠে ফুটবলের অনুশীলন করত ছোট ছোট মেয়েরা। আর কাঁটাতারের পাশে দাঁড়িয়ে তা-ই দেখতেন ছোট্ট নাদিয়া। সেসময় থেকেই ফুটবলের নেশা ধরে যায় তার।
ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর নাদিয়ার সে সময় মনে হয়েছিল, আমাকেও এ মাঠে নামতে হবে। আমি ফুটবলারই হতে চাই।
এক দিন শিবিরের ফুটবল কোচের কাছে নিজের ইচ্ছের কথাটা বলে বসেন নাদিয়া। কয়েক মাস অনুশীলনের পর তার অভিষেক হয় ফুটবল মাঠে।
এক সময় শরণার্থী নাদিয়াকে ডেনমার্ক সরকার আশ্রয় দেয়। এর পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ২০০৫ সালে পেশাদার হিসেবে ডেনমার্কের প্রথম শ্রেণির ক্লাব বি৫২ আলবর্গ দলের জার্সি পরেন। সে বছরের শেষে টিম ভাইবর্গে যোগ দেন। এর পরে প্রায় ১০ বছর সে দেশের একাধিক ক্লাবে খেলেছেন নাদিয়া। সবখানেই তিনি দলের ভরসাযোগ্য স্ট্রাইকার।
এর পরের ঘটনা আরও সাড়া জাগানো। ২০০৯ সালে ডেনমার্কের জাতীয় দলের জার্সিতে মাঠে নামেন নাদিয়া। বস্তুত, নাদিয়াই ডেনমার্কের প্রথম ফুটবলার যিনি জন্মসূত্রে ডেনিশ নন। অন্য দেশকে আপন করে নিয়েছেন নাদিয়া। ডেনমার্কের জাতীয় দলের হয়ে ৯৯টি ম্যাচে করেছেন ২ শতাধিক গোল।
২০১৪ সালে নাদিয়া চলে যান আমেরিকায়। স্কাই ব্লু এফসি ক্লাবের হয়ে খেলতে। ২০১৮ সালে আসে তার ক্লাব ফুটবল ক্যারিয়ারের সোনালি অধ্যায়। সেবছর উইমেন্স সুপার লিগে ম্যানচেস্টার সিটির জার্সি পরেন নাদিয়া।
ম্যান সিটিতে বছরখানেক কাটিয়ে ২০১৯ সালে প্যারিনের একটি টিমে যোগ দেন নাদিয়া। সহ অধিনায়কও হন সেখানে।
সে মৌসুমে ২৭টি ম্যাচে ১৮ গোল এসেছিল নাদিয়ার পা থেকে। গত বছরের জুনে অবশ্য আমেরিকার লিগ ফুটবলে রেসিং লুইভিল ক্লাবে চলে গিয়েছেন তিনি।
পায়ের নিপুণ কাজে বল ঠেলতে দক্ষ নাদিয়া খেলার মাঝে মগ্ন ছিলেন মেডিকেল পরীক্ষার প্রস্তুতিতে। দুইয়ের মাঝে ফাঁক খুঁজে নাদিয়া হামেশাই সরব হয়েছেন আফগানিস্তানের নারী এবং শিশুকন্যাদের অধিকার রক্ষার দাবিতে।
আফগানিস্তানের নারী এবং শিশুকন্যাদের অধিকার রক্ষার লড়াইতে গত বছর জাতিসংঘসহ নানা স্থানীয় সংগঠনের হয়ে ২৯ হাজার পাউন্ড তোলায় সাহায্য করেন নাদিয়া।
তালেবার শাসনে নিজভূমের মেয়েরা যে ভয়ের পরিবেশে বাস করছেন, তা নিয়েও মুখ খুলেছেন এই আন্তর্জাতিক তারকা।