ঢাকা ০১:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধান চাষে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিস্তার প্রসঙ্গে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৫৯:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ এপ্রিল ২০১৬
  • ৪৬১ বার

কৃষক সমাজে কোনো নির্দিষ্ট প্রযুক্তি বা টেকনোলজির বিস্তার বোঝার জন্য নিবিড় সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি ‘সমাজ বহমানতাকে’ও বোঝা জরুরি। বিশেষ করে প্রযুক্তিটির সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষের চিরায়ত অভ্যাস, কর্মপ্রণালি, কর্মধরন, সময়, অবকাঠামোগত বাস্তবতা ইত্যাদি নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার মাধ্যমে সমাজের একটা সামগ্রিক চিত্র পাওয়া জরুরি। কেননা প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিস্তারকে বুঝতে হলে ‘ব্যক্তিক’ পর্যায়ের বাস্তবতার সঙ্গে পরিবেশ, প্রতিবেশ, বৈশ্বিক বাস্তবতা, বৈশ্বিক অর্থনীতি, বিশ্বায়ন প্রভৃতি বিষয়ের সমন্বিত জ্ঞান তথা ‘হলিসটিক’ একটা বোঝাবুঝি ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনে কী ভূমিকা রাখছে, তা বুঝতে হবে।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার তথা কৃষক সমাজে প্রযুক্তির বিস্তার ও ব্যবহার বিষয়ে যদি ভাবা যায়, তবে চাষ পদ্ধতি কীভাবে টেকসই হবে সেদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির লাগামহীন ব্যবহার, কীটপতঙ্গ ও আগাছা দমন ইত্যাদি বিষয়ে টেকসই কোনো ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা উচিত। কৃষিতে কীটপতঙ্গ, রোগবালাই ও আগাছা দমনে যে পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, তার কথা আমাদের কৃষকরা নিজেরাই স্মরণ করতে ভয় পান। কৃষক নিজেও বিরক্ত হয়ে গেছেন সার, কীটনাশক, বালাইনাশক ব্যবহার করতে করতে। কিন্তু আজ তারা বাধ্য হয়ে পড়েছেন। কেননা এগুলো ব্যবহার না করলে তাদের ফলন ভালো হয় না। ধান চাষে কৃষকের ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের যে অভ্যাস, তা কোনোভাবেই ‘টেকসই’ কোনো ব্যবস্থা নয়। প্রকারান্তরে কৃষকের এহেন অভ্যাস ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’র বিপরীতে অবস্থান করে।

কৃষিতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের জন্য ‘গ্রিন ইকোনমি’ বা ‘সবুজ অর্থনীতি’-কে বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে। এই সবুজ অর্থনীতির সামগ্রিক সংজ্ঞায়নের জায়গায় কার্ল বারকার্টের সংজ্ঞায়নে যে ছয়টি সেক্টরের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ও ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিষয় দুটি কৃষির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ভূগর্ভস্থ পানির সিংহভাগ ব্যবহার হচ্ছে কৃষিক্ষেত্রে। বিশেষ করে ধান চাষে যে পরিমাণে ব্যবহার হচ্ছে তা অনেক বেশি বা প্রয়োজনের অধিক। এক অর্থে ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের অপচয়। আবার যে হারে কীটনাশক ব্যবহার হয়, তা বাস্তু ব্যবস্থা তথা প্রতিবেশের প্রতি হুমকিস্বরূপ। আর যদি খাদ্যনিরাপত্তার দিক থেকে দেখতে চাই, তবে তা নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের পরিপন্থী; যা প্রকারান্তরে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার যদি কার্ল বারকার্টের সবুজ অর্থনীতির আরেকটা সেক্টর ল্যান্ড ম্যানেজমেন্টের কথা বিবেচনা করা হয়, দেখা যাবে যে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কৃষিজমিকে ঊষর করে তুলছে, জলাভূমির পানিকে বিষাক্ত করে তুলছে এবং জলজ জীবকুলকে হুমকির মুখে ফেলছে। এগুলো সবই বাস্তু ব্যবস্থা ও প্রতিবেশ-প্রকৃতির ওপর সরাসরি আঘাত। একজন কৃষক এ বিষয়ে জানান যে, তাদের কৃষিজমিতে আগের মতো কেঁচো দেখতে পাওয়া যায় না কিন্তু কেঁচো জমির উর্বরা শক্তি বাড়াতে ভূমিকা রাখে; তাই কেঁচোকে বলা হয় কৃষকের বন্ধু। তিনি মনে করেন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষক বন্ধুহারা হচ্ছেন। অর্থাত্ কৃষকের ক্ষেতে কেঁচোর মতো উপকারী জীব হুমকির মুখে পড়ছে। কৃষিক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সবুজ অর্থনীতি আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে কৃষকের ‘নির্মিত অভ্যাস’গুলো পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে— এমন প্রযুক্তি বা ধারণা কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া বর্তমান সময়ের চাহিদা। এরই ধারাবাহিকতায় ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগ এবং মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন কর্তৃক যৌথভাবে পরিচালিত ‘গ্রামীণ বাংলাদেশে প্রযুক্তির ব্যবহার ও খাদ্য নিরাপত্তা’ (Technology Adoption and Food Security in Rural Bangladesh) শীর্ষক গবেষণায় বাংলাদেশের ৩০০ গ্রামে আট হাজার কৃষিখানার সংখ্যাতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনার পাশাপাশি নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিরও সাহায্য নেয়া হয়। এ গবেষণায় ট্রিটমেন্ট গ্রুপের কৃষকদের মধ্যে নিবিড় পদ্ধতিতে ধান চাষ বা The System of Rice Intensification সংক্ষেপে এসআরআইয়ের ওপর পরিচালিত প্রশিক্ষণ কৃষকের বোঝাবুঝি ও অভ্যাসের জায়গায় কী পরিবর্তন আনতে পেরেছে? বিষয়টি বোঝার জন্য কৃষকের প্রচলিত চাষাভ্যাসে এ প্রযুক্তি বা তথ্যভাণ্ডার কীভাবে কাজ করছে, তা দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।

এসআরআই পদ্ধতিটি ১৯৮৩ সালে মাদাগাসকারের এক ধর্মযাজকের হাতে উদ্ভাবিত হয়। এটি যতটা না প্রযুক্তি, তার চেয়ে বেশি ধান চাষে কিছু চর্চাগত অভ্যাসের সমষ্টি কিংবা পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে চর্চিত বিষয়গুলো পরিবর্তনের অযোগ্য কোনো বিষয় নয়। কৃষি বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসআরআই প্রতিনিয়ত রূপায়িত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ব্র্যাকের কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা কর্মসূচি কৃষিবিদ ড. সিরাজুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের কৃষকের বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রযুক্তিটি কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কাজ করছে। আদতে এসআরআই এমন একটি চাষ পদ্ধতির কিছু চর্চাগত অভ্যাসকে উত্সাহিত করে, যা কিনা কৃষকের উৎপাদন খরচ কমিয়ে ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি টেকসই কৃষির বিকাশেও ভূমিকা রাখে। এসআরআই পদ্ধতির কম্পোনেন্টগুলো কৃষকের মাঝে বিস্তারের মাধ্যমে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারে। ব্র্যাকের প্রস্তাবিত এসআরআই পদ্ধতির যে ছয়টি বিষয় বা কম্পোনেন্টকে গুরুত্বের কেন্দ্রে রাখা হয় সেগুলো হলো— ১. অল্প বয়সের (১৫-২০) চারা রোপণ করা ২. নির্দিষ্ট দূরত্বে (১০ ইঞ্চি – ১০ ইঞ্চি) প্রতি গোছায় ১-২টি করে চারা ব্যবহার করে সারিবদ্ধভাবে রোপণ ৩. পর্যায়ক্রমিকভাবে জমি ভেজানো ও শুকানো (AWD) ৪. আগাছানাশক ব্যবহার না করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে আগাছা দমন ৫. কীটনাশক ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক উপায়ে পোকামাকড় দমন করা ৬. রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে নিয়ে এসে অধিক পরিমাণে জৈব সার ব্যবহার করা। এই ছয়টি কম্পোনেন্টের মধ্যে শুধু চারা রোপণ সম্পর্কিত অভ্যাসগুলো ছাড়া সব অভ্যাসই প্রতিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং প্রতিবেশবান্ধব। এ পদ্ধতি বিস্তারের ফলে এক ধরনের প্রতিবেশবান্ধব চাষাভ্যাস কৃষকের মধ্যে গড়ে উঠবে। যা কৃষিক্ষেত্রকে টেকসই করবে। পক্ষান্তরে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের মধ্যে অন্তত চারটি লক্ষ্য (২. ক্ষুধামুক্তি ৩. সুস্বাস্থ্য ১২. টেকসই উৎপাদন পদ্ধতি ও পরিমিত ভোগ ১৫. স্থলভাগের জীবন ও প্রতিবেশ সুরক্ষা) অর্জনে এ প্রকল্প প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখবে।

এ গবেষণায় আরো দেখতে চাওয়া হয়েছিল যে, এসআরআই কৃষকের মাঝে বিস্তারে তাদের সামাজিক সম্পর্কগুলো কীভাবে কাজ করে। অর্থাত্ নতুন একটি প্রযুক্তি বিস্তারে কৃষকের সামাজিক পুঁজি কীভাবে কাজে লাগানো সম্ভব। এ গবেষণার অংশ হিসেবে কয়েকজন কৃষককে এসআরআইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এখানে এসআরআইয়ের বিস্তার বিষয়ে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় কৃষকদের মধ্যে এক ধরনের চিরায়ত সামাজিক বন্ধন বিদ্যমান। কৃষকরা গ্রামীণ পরিবেশে একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন; গ্রামীণ সামাজিক সম্পর্ক যদি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, তবে দেখা যাবে যে একটি গ্রামের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের সম্পর্কের নিবিড়তা এমন যে ওপর থেকে দেখলে মনে হবে একে অন্যের আত্মীয় কিংবা জ্ঞাতি সম্পর্কে আবদ্ধ। বিষয়টি লক্ষ করা যায় যখন তারা একে অন্যকে সম্বোধন করে— একে অন্যকে কোনো না কোনো আত্মীয়তার সম্বোধনে সম্বোধন করছে। যদিও বিষয়টি বাঙালি সংস্কৃতির আবহে লালিত ভাষা ব্যবহারেরই একটা অংশ কিংবা মোটাদাগে বলা যায় বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। তার পরও গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় বিশেষত কৃষকসমাজ ব্যবস্থায় যে ‘সামাজিক বন্ধন’ লক্ষ করা যায়, তা সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে প্রথাগত চিন্তার বাইরে আলাদা গুরুত্বারোপ করে। কৃষক সমাজের এই শক্ত বন্ধনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। তবে বর্তমান ‘বাজার অর্থনীতি-সংস্কৃতি’ মানুষকে ‘ব্যক্তি কেন্দ্রিকতার’ দিকে ধাবিত করছে প্রতিনিয়ত, যার প্রভাব বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের ওপরও পড়ছে। কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ আজ ক্রমবর্ধমান। সে আলোচনা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করবে। তবে ‘গ্রামীণ বাংলাদেশে প্রযুক্তির ব্যবহার ও খাদ্য নিরাপত্তা’ শীর্ষক গবেষণার অবস্থান থেকে দেখার চেষ্টা করা হয়, ধান চাষের নিবিড়তার ওপর পরিচালিত একটি প্রশিক্ষণ কৃষকসমাজে কী প্রভাব ফেলে বা কীভাবে এ পদ্ধতি কৃষক সমাজে বিস্তার লাভ করে সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের মাধ্যমে। গবেষণার মাঠ পর্যবেক্ষণ ও কৃষকদের সঙ্গে আলাপচারিতার পরিপ্রেক্ষিতে জানা যায়, এ প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হওয়ায় তাদের মধ্যে একটি ‘কৃষিবন্ধন’ তৈরি হয়েছে। তাছাড়া এক ধরনের সচেতনতাও বেড়েছে। অতীতে প্রথাগত সনাতনী পদ্ধতিতে ধান চাষের যে চর্চা, যার মধ্যে ফলন বৃদ্ধির নিমিত্তে নিবিড় প্রচেষ্টা তেমনভাবে উপস্থিত ছিল না। কিন্তু এ প্রশিক্ষণের ফলে তাদের মধ্যে ফলন বৃদ্ধিকরণের একটা প্রচেষ্টা ও সচেতনতা লক্ষ করা যায়। এখানে লক্ষণীয় যে, একটি গ্রামের একদল কৃষক একই ধরনের প্রশিক্ষণ পাওয়ায় তাদের মধ্যে এক ধরনের চিন্তার সমরূপতা পরিলক্ষিত হয়। তারা ধান চাষের নতুন পদ্ধতি (এসআরআই) নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করেন, যা আগে এতটা হতো না।

কৃষকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে জানা যায়, একই গ্রাম থেকে যে কৃষকরা এসআরআই পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের নিজেদের মধ্যে কৃষি বিষয়ে আলাপচারিতা, যোগাযোগ ও একে অন্যকে সহায়তা করার মানসিকতা বেড়েছে। এ প্রশিক্ষণের ফলে কৃষকদের মধ্যে চিরায়ত সম্পর্কের মাঝে নতুন এক মাত্রা তৈরি হয়েছে, যা চাষাবাদে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে কৃষকরা মনে করেন। কৃষকরা জানান, প্রশিক্ষণের ফলে প্রশিক্ষিত কৃষকরা দলগতভাবে চেষ্টা করছেন কীভাবে এসআরআই পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে ফলন বাড়ানো যায়, যদিও তারা প্রচলিত চাষাভ্যাসের কারণে ও আবহাওয়ার প্রতিকূলতায় সফল হতে পারছেন না। গ্রামে এই এসআরআইয়ের বিস্তার হতে সময় লাগবে বলে তারা মনে করেন। এ বিষয়ে কৃষকরা আরো জানান, এসআরআই পদ্ধতিতে ধান চাষ করার জন্য কৃষকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক যদি মজবুত হয় তাহলে তারা উপকৃত হবেন। এ ধরনের প্রশিক্ষণ কৃষকদের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে ভূমিকা রাখতে পারে বলেও তারা মত প্রকাশ করেন। শুধু প্রশিক্ষণ নিয়েই শেষ নয়, এ প্রশিক্ষণের বিষয়াদি নিজেদের মধ্যে চর্চা করতে তাদের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার তাগিদ তারা অনুভব করেন। তারা মনে করেন, কৃষকদের মধ্যে সম্পর্ক যখন মজবুত হবে তখন তারা যেকোনো বিষয়ে একজন আরেকজনের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। তাই কৃষকদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কৃষক সংগঠন করতে হবে, যাতে তারা একসঙ্গে বসতে পারেন এবং তাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। এ প্রশিক্ষণ কৃষকদের মধ্যে এই উপলব্ধি তৈরি করতে পেরেছে। তারা মনে করেন, প্রশিক্ষণের ওছিলায় একত্র হওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু দীর্ঘ সময়ে এর সুফল বয়ে আনতে নিজেদের সংগঠিত হওয়া জরুরি। তাছাড়া কৃষকদের মধ্যে সংগঠন থাকলে সরকারি বা কোনো বেসরকারি সংস্থা থেকে তাদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা এলে তারা তা সহজেই পেতে পারেন সংগঠনের মাধ্যমে। এতে কৃষক উপকৃত হতে পারেন। আর যদি সংগঠন না থাকে তবে তা কৃষকদের হাত পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাই কৃষকদের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত হওয়া জরুরি— এ বিষয়টি কৃষকরা উপলব্ধি করতে পারছেন এ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের পর তাদের মধ্যে যে কৃষি-সম্পর্কিত যোগাযোগ বেড়েছে তার বদৌলতে।

এ বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষকরা মনে করেন, একজন কৃষক যখন এসআরআই পদ্ধতিতে ধান চাষ করে বেশি উৎপাদন করবেন, তখন তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে অন্য কৃষককে চাষাবাদ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করবেন। অন্য কৃষকও এসআরআই পদ্ধতিতে ধান চাষ করে লাভবান হবেন। তাছাড়া একজন কৃষক যখন সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে লাভবান হবেন তখন সংগঠনের অন্য কৃষকরাও তা অনুসরণ করে উপকৃত হবেন। এভাবে একে অন্যের সহযোগিতার মাধ্যমে ধান চাষ করে ফলন বৃদ্ধি করে নিজেদের উন্নতির পাশাপাশি দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারবেন।

তাই এ ধরনের গবেষণা সামনের দিনে ব্র্যাকের পাশাপাশি অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংগঠন ও রাষ্ট্রকে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নতুন কর্মসূচি বা কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে সহায়তা করবে। এ গবেষণা কৃষি অর্থনীতি টেকসইকরণে সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক: স্টাফ রিসার্চার, কৃষি অর্থনীতি গবেষণা ইউনিট গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগ, ব্র্যাক

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ধান চাষে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিস্তার প্রসঙ্গে

আপডেট টাইম : ১২:৫৯:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ এপ্রিল ২০১৬

কৃষক সমাজে কোনো নির্দিষ্ট প্রযুক্তি বা টেকনোলজির বিস্তার বোঝার জন্য নিবিড় সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি ‘সমাজ বহমানতাকে’ও বোঝা জরুরি। বিশেষ করে প্রযুক্তিটির সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষের চিরায়ত অভ্যাস, কর্মপ্রণালি, কর্মধরন, সময়, অবকাঠামোগত বাস্তবতা ইত্যাদি নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার মাধ্যমে সমাজের একটা সামগ্রিক চিত্র পাওয়া জরুরি। কেননা প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিস্তারকে বুঝতে হলে ‘ব্যক্তিক’ পর্যায়ের বাস্তবতার সঙ্গে পরিবেশ, প্রতিবেশ, বৈশ্বিক বাস্তবতা, বৈশ্বিক অর্থনীতি, বিশ্বায়ন প্রভৃতি বিষয়ের সমন্বিত জ্ঞান তথা ‘হলিসটিক’ একটা বোঝাবুঝি ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনে কী ভূমিকা রাখছে, তা বুঝতে হবে।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার তথা কৃষক সমাজে প্রযুক্তির বিস্তার ও ব্যবহার বিষয়ে যদি ভাবা যায়, তবে চাষ পদ্ধতি কীভাবে টেকসই হবে সেদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির লাগামহীন ব্যবহার, কীটপতঙ্গ ও আগাছা দমন ইত্যাদি বিষয়ে টেকসই কোনো ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা উচিত। কৃষিতে কীটপতঙ্গ, রোগবালাই ও আগাছা দমনে যে পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, তার কথা আমাদের কৃষকরা নিজেরাই স্মরণ করতে ভয় পান। কৃষক নিজেও বিরক্ত হয়ে গেছেন সার, কীটনাশক, বালাইনাশক ব্যবহার করতে করতে। কিন্তু আজ তারা বাধ্য হয়ে পড়েছেন। কেননা এগুলো ব্যবহার না করলে তাদের ফলন ভালো হয় না। ধান চাষে কৃষকের ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের যে অভ্যাস, তা কোনোভাবেই ‘টেকসই’ কোনো ব্যবস্থা নয়। প্রকারান্তরে কৃষকের এহেন অভ্যাস ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’র বিপরীতে অবস্থান করে।

কৃষিতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের জন্য ‘গ্রিন ইকোনমি’ বা ‘সবুজ অর্থনীতি’-কে বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে। এই সবুজ অর্থনীতির সামগ্রিক সংজ্ঞায়নের জায়গায় কার্ল বারকার্টের সংজ্ঞায়নে যে ছয়টি সেক্টরের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ও ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিষয় দুটি কৃষির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ভূগর্ভস্থ পানির সিংহভাগ ব্যবহার হচ্ছে কৃষিক্ষেত্রে। বিশেষ করে ধান চাষে যে পরিমাণে ব্যবহার হচ্ছে তা অনেক বেশি বা প্রয়োজনের অধিক। এক অর্থে ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের অপচয়। আবার যে হারে কীটনাশক ব্যবহার হয়, তা বাস্তু ব্যবস্থা তথা প্রতিবেশের প্রতি হুমকিস্বরূপ। আর যদি খাদ্যনিরাপত্তার দিক থেকে দেখতে চাই, তবে তা নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের পরিপন্থী; যা প্রকারান্তরে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার যদি কার্ল বারকার্টের সবুজ অর্থনীতির আরেকটা সেক্টর ল্যান্ড ম্যানেজমেন্টের কথা বিবেচনা করা হয়, দেখা যাবে যে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কৃষিজমিকে ঊষর করে তুলছে, জলাভূমির পানিকে বিষাক্ত করে তুলছে এবং জলজ জীবকুলকে হুমকির মুখে ফেলছে। এগুলো সবই বাস্তু ব্যবস্থা ও প্রতিবেশ-প্রকৃতির ওপর সরাসরি আঘাত। একজন কৃষক এ বিষয়ে জানান যে, তাদের কৃষিজমিতে আগের মতো কেঁচো দেখতে পাওয়া যায় না কিন্তু কেঁচো জমির উর্বরা শক্তি বাড়াতে ভূমিকা রাখে; তাই কেঁচোকে বলা হয় কৃষকের বন্ধু। তিনি মনে করেন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষক বন্ধুহারা হচ্ছেন। অর্থাত্ কৃষকের ক্ষেতে কেঁচোর মতো উপকারী জীব হুমকির মুখে পড়ছে। কৃষিক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সবুজ অর্থনীতি আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে কৃষকের ‘নির্মিত অভ্যাস’গুলো পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে— এমন প্রযুক্তি বা ধারণা কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া বর্তমান সময়ের চাহিদা। এরই ধারাবাহিকতায় ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগ এবং মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন কর্তৃক যৌথভাবে পরিচালিত ‘গ্রামীণ বাংলাদেশে প্রযুক্তির ব্যবহার ও খাদ্য নিরাপত্তা’ (Technology Adoption and Food Security in Rural Bangladesh) শীর্ষক গবেষণায় বাংলাদেশের ৩০০ গ্রামে আট হাজার কৃষিখানার সংখ্যাতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনার পাশাপাশি নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিরও সাহায্য নেয়া হয়। এ গবেষণায় ট্রিটমেন্ট গ্রুপের কৃষকদের মধ্যে নিবিড় পদ্ধতিতে ধান চাষ বা The System of Rice Intensification সংক্ষেপে এসআরআইয়ের ওপর পরিচালিত প্রশিক্ষণ কৃষকের বোঝাবুঝি ও অভ্যাসের জায়গায় কী পরিবর্তন আনতে পেরেছে? বিষয়টি বোঝার জন্য কৃষকের প্রচলিত চাষাভ্যাসে এ প্রযুক্তি বা তথ্যভাণ্ডার কীভাবে কাজ করছে, তা দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।

এসআরআই পদ্ধতিটি ১৯৮৩ সালে মাদাগাসকারের এক ধর্মযাজকের হাতে উদ্ভাবিত হয়। এটি যতটা না প্রযুক্তি, তার চেয়ে বেশি ধান চাষে কিছু চর্চাগত অভ্যাসের সমষ্টি কিংবা পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে চর্চিত বিষয়গুলো পরিবর্তনের অযোগ্য কোনো বিষয় নয়। কৃষি বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসআরআই প্রতিনিয়ত রূপায়িত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ব্র্যাকের কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা কর্মসূচি কৃষিবিদ ড. সিরাজুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের কৃষকের বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রযুক্তিটি কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কাজ করছে। আদতে এসআরআই এমন একটি চাষ পদ্ধতির কিছু চর্চাগত অভ্যাসকে উত্সাহিত করে, যা কিনা কৃষকের উৎপাদন খরচ কমিয়ে ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি টেকসই কৃষির বিকাশেও ভূমিকা রাখে। এসআরআই পদ্ধতির কম্পোনেন্টগুলো কৃষকের মাঝে বিস্তারের মাধ্যমে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারে। ব্র্যাকের প্রস্তাবিত এসআরআই পদ্ধতির যে ছয়টি বিষয় বা কম্পোনেন্টকে গুরুত্বের কেন্দ্রে রাখা হয় সেগুলো হলো— ১. অল্প বয়সের (১৫-২০) চারা রোপণ করা ২. নির্দিষ্ট দূরত্বে (১০ ইঞ্চি – ১০ ইঞ্চি) প্রতি গোছায় ১-২টি করে চারা ব্যবহার করে সারিবদ্ধভাবে রোপণ ৩. পর্যায়ক্রমিকভাবে জমি ভেজানো ও শুকানো (AWD) ৪. আগাছানাশক ব্যবহার না করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে আগাছা দমন ৫. কীটনাশক ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক উপায়ে পোকামাকড় দমন করা ৬. রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে নিয়ে এসে অধিক পরিমাণে জৈব সার ব্যবহার করা। এই ছয়টি কম্পোনেন্টের মধ্যে শুধু চারা রোপণ সম্পর্কিত অভ্যাসগুলো ছাড়া সব অভ্যাসই প্রতিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং প্রতিবেশবান্ধব। এ পদ্ধতি বিস্তারের ফলে এক ধরনের প্রতিবেশবান্ধব চাষাভ্যাস কৃষকের মধ্যে গড়ে উঠবে। যা কৃষিক্ষেত্রকে টেকসই করবে। পক্ষান্তরে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের মধ্যে অন্তত চারটি লক্ষ্য (২. ক্ষুধামুক্তি ৩. সুস্বাস্থ্য ১২. টেকসই উৎপাদন পদ্ধতি ও পরিমিত ভোগ ১৫. স্থলভাগের জীবন ও প্রতিবেশ সুরক্ষা) অর্জনে এ প্রকল্প প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখবে।

এ গবেষণায় আরো দেখতে চাওয়া হয়েছিল যে, এসআরআই কৃষকের মাঝে বিস্তারে তাদের সামাজিক সম্পর্কগুলো কীভাবে কাজ করে। অর্থাত্ নতুন একটি প্রযুক্তি বিস্তারে কৃষকের সামাজিক পুঁজি কীভাবে কাজে লাগানো সম্ভব। এ গবেষণার অংশ হিসেবে কয়েকজন কৃষককে এসআরআইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এখানে এসআরআইয়ের বিস্তার বিষয়ে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় কৃষকদের মধ্যে এক ধরনের চিরায়ত সামাজিক বন্ধন বিদ্যমান। কৃষকরা গ্রামীণ পরিবেশে একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন; গ্রামীণ সামাজিক সম্পর্ক যদি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, তবে দেখা যাবে যে একটি গ্রামের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের সম্পর্কের নিবিড়তা এমন যে ওপর থেকে দেখলে মনে হবে একে অন্যের আত্মীয় কিংবা জ্ঞাতি সম্পর্কে আবদ্ধ। বিষয়টি লক্ষ করা যায় যখন তারা একে অন্যকে সম্বোধন করে— একে অন্যকে কোনো না কোনো আত্মীয়তার সম্বোধনে সম্বোধন করছে। যদিও বিষয়টি বাঙালি সংস্কৃতির আবহে লালিত ভাষা ব্যবহারেরই একটা অংশ কিংবা মোটাদাগে বলা যায় বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। তার পরও গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় বিশেষত কৃষকসমাজ ব্যবস্থায় যে ‘সামাজিক বন্ধন’ লক্ষ করা যায়, তা সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে প্রথাগত চিন্তার বাইরে আলাদা গুরুত্বারোপ করে। কৃষক সমাজের এই শক্ত বন্ধনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। তবে বর্তমান ‘বাজার অর্থনীতি-সংস্কৃতি’ মানুষকে ‘ব্যক্তি কেন্দ্রিকতার’ দিকে ধাবিত করছে প্রতিনিয়ত, যার প্রভাব বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের ওপরও পড়ছে। কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ আজ ক্রমবর্ধমান। সে আলোচনা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করবে। তবে ‘গ্রামীণ বাংলাদেশে প্রযুক্তির ব্যবহার ও খাদ্য নিরাপত্তা’ শীর্ষক গবেষণার অবস্থান থেকে দেখার চেষ্টা করা হয়, ধান চাষের নিবিড়তার ওপর পরিচালিত একটি প্রশিক্ষণ কৃষকসমাজে কী প্রভাব ফেলে বা কীভাবে এ পদ্ধতি কৃষক সমাজে বিস্তার লাভ করে সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের মাধ্যমে। গবেষণার মাঠ পর্যবেক্ষণ ও কৃষকদের সঙ্গে আলাপচারিতার পরিপ্রেক্ষিতে জানা যায়, এ প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হওয়ায় তাদের মধ্যে একটি ‘কৃষিবন্ধন’ তৈরি হয়েছে। তাছাড়া এক ধরনের সচেতনতাও বেড়েছে। অতীতে প্রথাগত সনাতনী পদ্ধতিতে ধান চাষের যে চর্চা, যার মধ্যে ফলন বৃদ্ধির নিমিত্তে নিবিড় প্রচেষ্টা তেমনভাবে উপস্থিত ছিল না। কিন্তু এ প্রশিক্ষণের ফলে তাদের মধ্যে ফলন বৃদ্ধিকরণের একটা প্রচেষ্টা ও সচেতনতা লক্ষ করা যায়। এখানে লক্ষণীয় যে, একটি গ্রামের একদল কৃষক একই ধরনের প্রশিক্ষণ পাওয়ায় তাদের মধ্যে এক ধরনের চিন্তার সমরূপতা পরিলক্ষিত হয়। তারা ধান চাষের নতুন পদ্ধতি (এসআরআই) নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করেন, যা আগে এতটা হতো না।

কৃষকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে জানা যায়, একই গ্রাম থেকে যে কৃষকরা এসআরআই পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের নিজেদের মধ্যে কৃষি বিষয়ে আলাপচারিতা, যোগাযোগ ও একে অন্যকে সহায়তা করার মানসিকতা বেড়েছে। এ প্রশিক্ষণের ফলে কৃষকদের মধ্যে চিরায়ত সম্পর্কের মাঝে নতুন এক মাত্রা তৈরি হয়েছে, যা চাষাবাদে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে কৃষকরা মনে করেন। কৃষকরা জানান, প্রশিক্ষণের ফলে প্রশিক্ষিত কৃষকরা দলগতভাবে চেষ্টা করছেন কীভাবে এসআরআই পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে ফলন বাড়ানো যায়, যদিও তারা প্রচলিত চাষাভ্যাসের কারণে ও আবহাওয়ার প্রতিকূলতায় সফল হতে পারছেন না। গ্রামে এই এসআরআইয়ের বিস্তার হতে সময় লাগবে বলে তারা মনে করেন। এ বিষয়ে কৃষকরা আরো জানান, এসআরআই পদ্ধতিতে ধান চাষ করার জন্য কৃষকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক যদি মজবুত হয় তাহলে তারা উপকৃত হবেন। এ ধরনের প্রশিক্ষণ কৃষকদের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে ভূমিকা রাখতে পারে বলেও তারা মত প্রকাশ করেন। শুধু প্রশিক্ষণ নিয়েই শেষ নয়, এ প্রশিক্ষণের বিষয়াদি নিজেদের মধ্যে চর্চা করতে তাদের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার তাগিদ তারা অনুভব করেন। তারা মনে করেন, কৃষকদের মধ্যে সম্পর্ক যখন মজবুত হবে তখন তারা যেকোনো বিষয়ে একজন আরেকজনের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। তাই কৃষকদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কৃষক সংগঠন করতে হবে, যাতে তারা একসঙ্গে বসতে পারেন এবং তাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। এ প্রশিক্ষণ কৃষকদের মধ্যে এই উপলব্ধি তৈরি করতে পেরেছে। তারা মনে করেন, প্রশিক্ষণের ওছিলায় একত্র হওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু দীর্ঘ সময়ে এর সুফল বয়ে আনতে নিজেদের সংগঠিত হওয়া জরুরি। তাছাড়া কৃষকদের মধ্যে সংগঠন থাকলে সরকারি বা কোনো বেসরকারি সংস্থা থেকে তাদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা এলে তারা তা সহজেই পেতে পারেন সংগঠনের মাধ্যমে। এতে কৃষক উপকৃত হতে পারেন। আর যদি সংগঠন না থাকে তবে তা কৃষকদের হাত পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাই কৃষকদের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত হওয়া জরুরি— এ বিষয়টি কৃষকরা উপলব্ধি করতে পারছেন এ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের পর তাদের মধ্যে যে কৃষি-সম্পর্কিত যোগাযোগ বেড়েছে তার বদৌলতে।

এ বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষকরা মনে করেন, একজন কৃষক যখন এসআরআই পদ্ধতিতে ধান চাষ করে বেশি উৎপাদন করবেন, তখন তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে অন্য কৃষককে চাষাবাদ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করবেন। অন্য কৃষকও এসআরআই পদ্ধতিতে ধান চাষ করে লাভবান হবেন। তাছাড়া একজন কৃষক যখন সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে লাভবান হবেন তখন সংগঠনের অন্য কৃষকরাও তা অনুসরণ করে উপকৃত হবেন। এভাবে একে অন্যের সহযোগিতার মাধ্যমে ধান চাষ করে ফলন বৃদ্ধি করে নিজেদের উন্নতির পাশাপাশি দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারবেন।

তাই এ ধরনের গবেষণা সামনের দিনে ব্র্যাকের পাশাপাশি অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংগঠন ও রাষ্ট্রকে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নতুন কর্মসূচি বা কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে সহায়তা করবে। এ গবেষণা কৃষি অর্থনীতি টেকসইকরণে সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক: স্টাফ রিসার্চার, কৃষি অর্থনীতি গবেষণা ইউনিট গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগ, ব্র্যাক