হাওর বার্তা ডেস্কঃ কথাটা তো যেনতেন কেউ বলছেন না, খোদ ব্রিটিশ অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি হবে।
এমন পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে তারা পূর্বশর্ত হিসাবে বলছে, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের এখন যে গতিতে বিকাশ হচ্ছে, সে গতিটা অব্যাহত থাকতে হবে।
আমি নিজে যেহেতু আর্থিক খাত নিয়ে কাজ করি, আমার বিশ্বাস-যে গতিতে আমরা এগিয়ে চলেছি সেটি কেবল ধরে রাখা নয়, অনেক ক্ষেত্রে এ গতিকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব। এখানেও পূর্বশর্ত হলো-আর্থিক খাতে ডিজিটাইজেশনের যে সূচনা হয়েছে সেটি অব্যাহতভাবে চলতে দিতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে বরং এটিকে বেগবান করার পথে ধাবিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা যারা আর্থিক খাতের ডিজিটাল সেবা নিয়ে কাজ করি তাদের যেমন ভূমিকা আছে, তেমনি তাদের নীতি সহায়তা পেতে হবে নির্ধারকদের পক্ষ থেকেও।
বলে রাখা দরকার, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল ২০২১ নামের ওই প্রতিবেদন অনুসারে অর্থনৈতিক শক্তিতে বিশ্বের ৪১ নম্বর অবস্থানে থেকে ২০২১ সাল শেষ করলাম আমরা। সুতরাং পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী ১৩ বছরে ১৬ ধাপ এগিয়ে আসার সুযোগ।
টাকা লেনদেনে গতি দিতে পারলে সেই গতিময়তা যে সুপারসনিক বেগে মুহূর্তে অর্থনীতির অন্যান্য গলিপথেও ছড়িয়ে পড়ে, তা তো নতুন কোনো তত্ত্ব নয়। এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে টাকায় আমাদের এ গতিশীলতা নিশ্চয়ই বড় ভূমিকা রেখেছে। মাসে এখন ৭০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে কেবল মোবাইলের মাধ্যমে। এখানে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি আছে ৪০ শতাংশ। শুধু মোবাইলের কয়েকটি বাটনে হাতের আঙুলের স্পর্শ মুহূর্তে দূর-দূরান্তের লেনদেন করে দিচ্ছে নিমিষে। কিন্তু এখনো সব কাজই হচ্ছে না এভাবে। এখনো অনেক খাতকে গ্রাস করে রেখেছে ম্যানুয়াল পদ্ধতি।
আর্থিক খাতকে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে তুলে আনতে গিয়ে দেখছি-সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবসার নতুন নতুন মডেল আসার ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির ধারাবাহিক বিকাশের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও জটিল ও গতিশীল হচ্ছে। মুক্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন নতুন অনলাইন মার্কেট প্লেসের বিস্তারে লেনদেন জগতে এসেছে বড় পরিবর্তন। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সাপ্লাই চেইন পদ্ধতিতেও বড় রকমের অদল-বদল হয়েছে। এ সবকিছুর সঙ্গে খাপখাইয়ে এগিয়ে যেতে অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হলো মসৃণ লেনদেন ব্যবস্থার প্রচলন, যা কেবল ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। হাতের কয়েকটি আঙুলের স্পর্শে যদি যখন খুশি লেনদেন করতে না পারা যায়, তাহলে ডিজিটাল থেকে ভার্চুয়ালের পথে এগিয়ে যাওয়া এ দুনিয়ায় টিকে থাকা সত্যিই এক দুরূহ কাজ হবে।
বাংলাদেশের আর্থিক খাতকে পরিপূর্ণ ডিজিটাইজ্ডকরণের সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ এখনো আমাদের সামনে নেই। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রাইভেট সেক্টর নিজেদের প্রয়োজনেই ডিজিটালের পথ ধরে হাঁটছে। কখনো সেক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের সহযোগিতা যেমন থাকছে, আবার কখনো তাদের ‘ধীরে চলো’ নীতিতে হাঁটার কৌশলের কারণে আমরাও ধীর পায়ে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছি।
আবার নীতির আগে বাস্তবায়নের উদাহরণও আছে। যেমন-মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের জন্ম হয়েছিল নীতি কাঠামো গড়ে ওঠার আগেই। নতুন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক সময় এমনটা হয়। আবার ২০১৯ সালে যখন ডাক বিভাগের হাত ধরে ‘নগদ’ যাত্রা করল তখন দেশের আর্থিক খাত প্রবেশ করে ডিজিটাইজেশনের নতুন দিগন্তে। ই-কেওয়াইসির প্রথম প্রচলন বাংলাদেশে দেখা যায় নগদ-এর যাত্রার মাধ্যমে। অনেকেই শুরুতে এর সমালোচনা করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কিন্তু ঠিকই বিষয়টিকে গ্রহণ করে এবং দ্রুততার সঙ্গে ই-কেওয়াইসির অনুমোদন দিয়ে দেয়। এখন সবাই দেখছেন, ই-কেওয়াইসি কীভাবে ভেতর থেকে বদলে দিচ্ছে দেশের আর্থিক খাতকে। কারণ শুধু মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসই নয়, প্রচলিত বাণ্যিজিক ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক খাতও গ্রাহক নিবন্ধনের জন্য এখন ই-কেওয়াইসির ওপর নির্ভরশীল। এতে একদিকে যেমন লাখ লাখ মূল্যবান কর্মঘণ্টা বেঁচেছে, তেমনি ব্যবসা পরিচালন খরচও কমছে; সহজ ও নির্ঝঞ্ঝাট হয়েছে গ্রাহক নিবন্ধন প্রক্রিয়া। ফলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বেড়েছে হু হু করে। যেমন, গত বছর শুধু নগদ-এর মাধ্যমে সাড়ে তিন কোটি নতুন আর্থিক অ্যাকাউন্ট দেশে যুক্ত হয়েছে। এতে করে দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করার নতুন এক উপকরণ যুক্ত হয়েছে এর মাধ্যমে।
আমার মতে, এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে আপাতত ছোট ছোট এ উদ্ভাবনগুলো বড় বড় ভূমিকা রাখছে। দেখুন না, কেবল মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের হাত ধরে কীভাবে সরকারি ভাতা বিতরণ প্রক্রিয়াটাই বদলে যাচ্ছে। তাছাড়া কোভিড বিধিনিষেধের কঠোরতম সময়েও মোবাইলের লেনদেন সাধারণ মানুষের জন্য হয়ে ওঠে প্রধান মাধ্যম। আমরা চাই না কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে গিয়ে জনগণ বাধ্য হয়ে ডিজিটাল লেনদেনের সুবিধায় আসুক। তার বদলে চাই, এমন একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জাতি হিসাবে আমরা এগিয়ে যাব, যেখানে ভোক্তা-গ্রাহক সবার দৈনন্দিন জীবন সহজ করার অবলম্বন হিসাবে হাজির হবে মোবাইলের লেনদেন।
বলছিলাম মোবাইল আর্থিক সেবা মাধ্যমে সরকারি ভাতা ও অনুদান বিতরণের কথা। এতে করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলো; সরকারেরও শত শত কোটি টাকার অপচয় রোধ হলো। সরকার এখন আর ভাতা বিতরণে পুরোনো কাগুজে পদ্ধতির ওপর নির্ভর করছে না, বরং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে মুহূর্তেই কীভাবে সুবিধাভোগীর হাতে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া যায় তার জন্য মোবাইল লেনদেনের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হচ্ছে। গত অর্থবছরে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের মাঝে ১০ হাজার কোটি টাকার উপর এভাবে বিতরণ করেছে সরকার। আমি বিশ্বাস করি, সামনের দিনে এ অঙ্ক আরও বহুগুণে বাড়বে, হয়তো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পুরো বরাদ্দই এর মাধ্যমে বিতরণ হবে। জনপ্রতিনিধিরা শুধু তালিকাটা করে দেবেন আর হাতের মোবাইলে টাকা পেয়ে যাবেন সুবিধাভোগী। ই-মানি ব্যবহারের ফলে টাকা ছাপানো এবং এর ব্যবস্থাপনা খরচ বলে কিছু থাকবে না। একইসঙ্গে বাড়বে টাকার গতি, যা গতিশীল করবে দেশের অর্থনীতির চাকাকে।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস নিয়ে আলাদা করে বলা থাকছে। এসবও তো একটা বড় স্বীকৃতি। তবে এমন স্বীকৃতির পরও অনেক জায়গায় এখনো আমরা ঠিক কাজটি করতে পারিনি। এখনো পারিনি বলে যে পারব না তা তো নয়! নিশ্চয়ই আমরা সেই দিনকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিতে পারব, যেখানে সবকিছু হবে কয়েকটি আঙুলের স্পর্শে-শুধু টাকা পাঠানো বা ছোটখাটো লেনদেন নয়। ঘরে বসে মুহূর্তেই ঋণ পাওয়া থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানির মতো বড় বড় অঙ্কের কাজও মোবাইল লেনদেনের মাধ্যমে হবে।
সেটি হলে নিশ্চিত করে বলছি-খরচ কমবে, সময় বাঁচবে, সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। আর সর্বোপরি প্রক্রিয়ার মধ্যে স্বচ্ছতা আসবে। তাতে আমাদের সবারই জীবন আগের চেয়ে অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী হবে; যা উন্নতির সূচকে আমাদের নিঃসন্দেহে বাড়তি গতি দেবে। তখন হয়তো ১৩ বছরে ১৬ ধাপ নয়; আমার বিশ্বাস-কয়েক বছরের মধ্যেই ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল বা আরও এমন গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের নতুন পূর্বাভাস নিয়ে হাজির হবে।