ওয়েস্ট ইন্ডিজ চ্যাম্পিয়ন

বেন স্টোকসের তখন ‘স্টোক’ করার মতোই অবস্থা। জয়ের জন্য শেষ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দরকার ছিল ১৯ রান। স্ট্রাইকে কার্লোস ব্রাফেট। স্টোকসের ওভারের প্রথম চার বলেই চারটি ছক্কা মেরে ইংলিশদের স্বপ্ন ভেঙে দেন ব্রাফেট। শেষ ওভারে এমন খুনে ব্যাটিং খুব কমই দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। মাথায় হাত দিয়ে স্টোকস মাটিতেই বসে পড়লেন। ওদিকে মারলন স্যামুয়েলস ও ব্রাথওয়েট জার্সি খুলে মাতলেন পাগুলে উদযাপনে। মুষ্টিবদ্ধ হাত ইংল্যান্ডের ড্রেসিংরুমের দিকে ছুড়ে দিয়ে ক্যারিবীয়রা জানান দিলেন ছোট ফরম্যাটে আবার রাজত্ব ফিরে পাওয়ার স্বস্তি। টি ২০ বিশ্বকাপের ষষ্ঠ আসরে আবার মুকুট মাথায় পরলেন গেইল, স্যামিরা। ২০১২ সালে এই স্যামিই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে প্রথম টি ২০ বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন। ২০১৬-তে এসে ইংল্যান্ডকে চার উইকেটে হারিয়ে আবারও সেই স্যামি কলকাতাকে ক্যালিপসো সুরে মাতালেন। ফাইনালের হিরো মারলন স্যামুয়েলস ও কার্লোস ব্রাফেট। স্যামুয়েলস ৬৬ বলে ৮৫* এবং ব্রাথওয়েট ১০ বলে ৩৪* করে দলকে জিতিয়ে ফেরেন। একই মাঠে একই দিনে ছেলে ও মেয়েদের টি ২০ বিশ্বকাপ ট্রফি জিতে নিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। রবিবাসরীয় ইডেন গার্ডেনে ক্যারিবীয়দের উদযাপনটা হল দ্বিগুণ আনন্দের। আর ১৯৮৭-র পর ইংল্যান্ডের জন্য আরও একটি দুঃখগাথার সাক্ষী হয়ে থাকল ইডেন গার্ডেন।
কাল ছিল ক্যারিবীয় রাত। একই মঞ্চে একইদিনে মহিলাদের পর চ্যাম্পিয়ন ছেলেরাও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাচটা শুরু হয়েছিল ভারতকে হারানোর পরই। ডুয়ানে ব্রাভোর ওই ‘চ্যাম্পিয়ন’ ভিডিওর নাচই চলল বিমানবন্দর, হোটেল থেকে শুরু করে ড্রেসিংরুম পর্যন্ত। কাল ইডেনে ক্যারিবীয়দের নাচের সূচনা এনে দিয়েছিল স্টেফানি টেলররা। মহিলা টি ২০ বিশ্বকাপে প্রথম শিরোপা জিতে তারাও ‘চ্যাম্পিয়ন’ নাচ করেছে ইডেনে। পরে প্রায় ৬৬ হাজার দর্শকের সামনে ব্রাফেটের বীরত্ব যখন কাঁপিয়ে দিয়েছে ইডেনকে, তখন মিলল গেইলদের পাগুলে উদযাপন। সেই পাগলামিটা আরও বেশি মধুর হল যখন ইংল্যান্ডে ড্রেসিংরুমের পাশ দিয়ে মাঠে ছুটে গিয়ে গেইলদের সঙ্গে সামিল হলেন মহিলা ক্রিকেটাররাও। ক্রিকেটের মচমচে এই ফরম্যাটটা ক্যারিবীয়দেরই সঙ্গে ভালো মানায়। পুরো মাঠ ঘুরে জার্সিগুলো একে একে ছুড়ে মারতে লাগলেন গেইলরা। আইসিসি সভাপতি জহির আব্বাসের কাছ থেকে ট্রফিটা টেনেই নিলেন স্যামি। আতশবাজির আলোতে গেইলদের সঙ্গে নেচে উঠলেন ফ্লাই এমিরেটসের মেয়েরা, নেচে উঠল মাঠকর্মীরা, তখন ‘চ্যাম্পিয়ন’ নাচে নাচছে গ্যালারি। হোটেলে হয়তো উদযাপন চলেছে কাল সারারাত, হয়তো চলবে ক্যারবীয় দ্বীপে পৌঁছানোর পরও।
সেমিতে ভারতের বিপক্ষে জয়ের পরই শিরোপা তাদের হাতে এমনটা অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য ইডেনের উইকেটে ১৫৬ রানের লক্ষ্যটা কমই মনে হচ্ছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডও শুরুতে বুঝিয়ে দিয়েছিল যোগ্য হিসেবেই তারা ফাইনালে উঠেছে। ১১ রানে উইন্ডিজের তিন উইকেট তুলে নিয়ে সেটাই প্রমাণ করেছিলেন রুটরা। শুরুর চিত্রটা ইংল্যান্ডের ইনিংসের মতোই। ইংলিশরা যেমন প্রথম তিন উইকেট হারানোর পরও চতুর্থ উইকেটে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। একইভাবে চতুর্থ উইকেটে ঘুরে দাঁড়ায় ক্যারিবীয়রাও। কিন্তু পরে দ্রুত দুটি উইকেট হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজও চাপে পড়ে যায়। একপাশে ম্যাচসেরা মারলন স্যামুয়েল ধরে রাখলেন ম্যাচের হাল। শেষ দুই ওভারে ক্যারিবীয়দের প্রয়োজন ছিল ২৭ রান। কিন্তু ১৯তম ওভারে জর্ডান মাত্র আট রান দিয়ে ইংলিশদের দিকেই ম্যাচ ঘুরিয়ে নিয়ে যান। তখন চমক যে ছিল ব্রাফেটের হাতে সেটা কেই বা জানতেন? শেষ ওভারে পরপর তিন ছয় মারলে স্কোর টাই হয়ে যায়। তখনই জয়ের আনন্দে মাঠে প্রবেশ করেন স্যামিরা। উইকেটে লাফালাফি করছেন স্যামুয়েলস ও ব্রাফেট। ইংলিশরা অভিযোগ করে আম্পায়ারের কাছে। তাতে দু’মিনিট খেলা নষ্ট হয়েছে। কিন্তু যেখানে এক রান লাগে সেখানে আরও একটি ছয় মেরেই শেষটা টানলেন ব্রাফেট। ১০ বলে চার ছয় ও এক চারে ৩৪* করে শেষ করলেন ব্রাফেট। ম্যাচসেরা স্যামুয়েলস তখন ৮৫* রানে অপরাজিত।
এরআগে মাঠে এসেই মেয়েদের ট্রফি জয় দেখেছেন গেইলরা। মেয়েদের ‘চ্যাম্পিয়ন’ নাচ দেখে ড্রেসিংরুমেই হয়তো শরীর দুলিয়েছেন স্যামি-ব্রাভোরা। মেয়েদের খেলা দেখেই উইকেট সম্পর্কে ভালো একটা ধারণা হয়ে গেছে। টস জিতে তাই ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন অধিনায়ক ড্যারেন স্যামি। প্রায় ৬৬ হাজার দর্শকের সামনে প্রথম ওভারে স্যামুয়েল বদ্রি তুলে নিলেন জেসন রয়কে, দ্বিতীয় ওভারে রাসেলের বলে ফিরলেন অ্যালেক্স হেলস। বিগ ম্যাচে আট রানে দুই উইকটে তুলে নিয়ে ভালোই শুরু করেছিল ক্যারিবীয়রা। এরপর ২৩ রানের মধ্যে ফেরেন মরগ্যানও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই ধারাবাহিকতা থামিয়ে দেন দুই ‘জ’। জো রুট ও জস বাটলারের ৬১ রানের জুটিতে বড় সংগ্রহের দিকেই ছিল ইংল্যান্ড। রুট ৩৬ বলে ৫৪ ও বাটলার ২২ বলে ৩৬ রান করেন। তবে জুটি ভাঙার পরই আবার ধস নামে তাদের ব্যাটিং লাইনআপে। তবে ক্ষণে ক্ষণে ব্রাভো-ব্রাথওয়েটরা একেকটি উইকেট নিয়েই ‘চ্যাম্পিয়ন’ নাচে দর্শকদের বিনোদন দিয়েছেন। রুটের তৈরি করা ভিতের ওপর জর্ডান (১২*) ও উইল্লি’র (২১) ব্যাটিংয়ে শেষ পর্যন্ত নয় উইকেটে ১৫৫ রানের লড়াই করার মতো পুঁজি পায় ইংলিশরা। ব্রাভো ও ব্রাথওয়েট তিনটি করে উইকেট নেন, বদ্রি নেন দুটি।
টুর্নামেন্টস সেরা হয়েছেন ভারতের বিরাট কোহলি। তবে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান এবং সেরা বোলিং পারফরম্যান্স বাংলাদেশের তামিম ইকবাল ও মুস্তাফিজুর রহমানেরই। টি ২০ বিশ্বকাপের সপ্তম আসর অনুষ্ঠিত হবে অস্ট্রেলিয়ায় ২০২০ সালে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর