কলকাতায় আজ ফাইনাল হচ্ছে এমন একটা পরিবেশে যেখানে শহরে মাত্র কদিন আগেই ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আর ভারত টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাওয়ায় টিকিটের চাহিদাতেও ভাঁটা পড়েছে।
কিন্তু তার পরেও বহু বহু বছর পর ইডেনে কোনও বিশ্বকাপের ফাইনাল হচ্ছে – আর মাঝের বছরগুলোতে ইডেনকে নানা লজ্জার ভাগীদারও হতে হয়েছে।
নতুন চেহারার ইডেন গার্ডেন্সের তার পরও আজ কিন্তু অনেক কিছু প্রমাণ করার তাগিদও আছে। কিন্তু সেগুলো কী ?
বিশ্বকাপের শুরুর ঠিক আগে ডোয়েইন ব্র্যাভো যে চ্যাম্পিয়ন গানটা গেয়েছিলেন, তা গত এক মাসে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে, আর ক্যারিবিয়ানরা এখন নিজেরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকে মাত্র এক ধাপ দূরে। ফাইনালে ইডেন গার্ডেন্সের সমর্থনও ধরে নেওয়া হচ্ছে তারাই পাচ্ছেন।
কিন্তু ফাইনালের ঠিক আগে জোড়া ধাক্কায় ইডেন আজ অবশ্যই কিছুটা ম্রিয়মান। প্রথমে শহরের বুকে ফ্লাইওভার ভেঙে পড়া, আর তারপর বিশ্বকাপ থেকে ভারতের বিদায়।
রবিবারের সন্ধ্যায় ইডেনে ফাইনাল দেখতে আসা অনেকেই যেমন বলছিলেন, একে ভারতের ফাইনালে উঠতে না-পারা, তার ওপর শহরে একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা – দুয়ে মিলে অনেকেই ক্রিকেটের ওপর থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেলেছেন।
পাশ থেকে আর একজন আবার জানান, টিকিট থাকা সত্ত্বেও অনেকে এদিন খেলা দেখতে আসেননি। ‘বুঝলেন না, সেমিফাইনাল থেকে ভারত বিদায় নিয়েছে তো – হৃদয় একেবারে ভেঙে গেছে। ভেবেছিলাম বন্ধুরা সবাই মিলে খেলা দেখতে আসব – কিন্তু অনেকেই শেষ পর্যন্ত আর আসতে চাইল না!’
আইসিসির সাবেক মুখপাত্র ব্রায়ান মার্গাট্রয়েড আমাকে বলছিলেন ‘শুক্রবার সকালেও কলকাতাকে মনে হচ্ছিল শোকে মুহ্যমান – ঠিক যেন নিউ ইয়ার্স ডে বা দিওয়ালির পরের দিন। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখানে ভীষণ জনপ্রিয় – আর ফ্লাইওভার বিপর্যয়ের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিশ্বকাপ ফাইনালই বোধহয় কলকাতার সেরা সুযোগ।’
ক্রিকেট ভাষ্যকার ইন্দ্রনীল দত্ত আবার বলছিলেন, ফ্লাইওভার ভাঙার জায়গাটা ইডেন থেকে বেশি দূরে নয় – কিন্তু তার পরেও মানুষ কিন্তু সেই শোক বুকে নিয়েও হই হই করে অনেকেই কিন্তু মাঠে আসবেন।
তিনি আরও বলছিলেন, উনত্রিশ বছর বাদে বিশ্বকাপের ফাইনাল হচ্ছে কলকাতায় – সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বাধীন নতুন ইডেনের কিন্তু আজ অনেক কিছু দেখানোর আছে।
‘নতুন চেহারায় সেজেছে ইডেন, এখানে ক্রিকেট সংগঠনের মাথায় আছেন এমন একজন যিনি বহু বছর বিশ্ব ক্রিকেটে দাপটে খেলেছেন। তার পর এত বছর বাদে একটা বিশ্বকাপের ফাইনাল – ৯৬র সেমিফাইনাল কিংবা ২০১১তে বিশ্বকাপের ম্যাচ সরিয়ে নেওয়ার কলঙ্ক ঝেড়ে ফেলে ইডেনকেও আজ দেখাতে হবে এত বড় আয়োজনের জন্য সে সত্যিই প্রস্তুত!’ বলছিলেন তিনি।
সেই সঙ্গে কলকাতার একটা প্রজন্মের ছোটবেলার নায়ক ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটাররা, ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতিই আজ গোটা মাঠের যে সমর্থন থাকবে তা নিয়েও তার বিশেষ সন্দেহ নেই।
মাঠের সমর্থন বিশেষ পাবেন না, এটা জেনেও ইংল্যান্ড অধিনায়ক ইয়ন মর্গ্যানের তাই স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আজ একটা অসাধারণ ম্যাচ হতে যাচ্ছে।
মর্গ্যান যেমন চাইছেন তার ক্রিকেটাররা এই বড় ম্যাচের চ্যালেঞ্জে নিজেদেরকে সঁপে দিক, ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ড্যারেন স্যামি আবার ইডেন গার্ডেন্সের সম্মোহনে মুগ্ধ।
স্যামি বলছিলেন, ‘আমরা সবাই একটা আকর্ষণীয় ম্যাচ চাইব যেখানে ক্রিকেট শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে। ইডেন একটা বিশেষ মাঠ – আর যেখানে বিশ্বকাপ জেতার জন্য, দেশের সম্মানের জন্য দুটো দল লড়বে তার জন্য এর চেয়ে সেরা মঞ্চ আর কী হতে পারে?’
ফাইনালে যারাই খেলুক – আসলে ইডেন গার্ডেন্স নিজেই যে একটা বিরাট আকর্ষণ – মাঠে আসা দর্শকদের অনেকেরই তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
তারা কেই বলছিলেন, যারাই খেলুক – ইডেনে মানুষ শেষ পর্যন্ত ভাল ক্রিকেট দেখতে আসে। কেউ আবার বলছিলেন, ‘ভারত নেই – কী আর করা যাবে। কিন্তু ইডেনের মতো একটা রোমাঞ্চকর মাঠে বিশ্বের সেরা দুটো দলকে খেলতে দেখার আনন্দই আলাদা!’
এই ভারাক্রান্ত মন আর ক্রিকেটপ্রেমের মিলমিশই থাকবে আজ ইডেনের গ্যালারিতে – যা পুরো ভরবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ থাকছেই। কিন্তু টিটোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কারা, আজ রাতে তার ফয়সালা হয়ে যাবে এই মাঠেই! -বিবিসি বাংলা