ঢাকা ০১:২৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অটিজম: জানতে হবে, বুঝতে হবে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৪৩:০৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ এপ্রিল ২০১৬
  • ২৭৫ বার

‘অটিজম’- শিশুদের এক অদ্ভুত মনের রোগ; বলা যেতে পারে মনোজাগতিক সমস্যা। এ রোগের কারণে শিশুদের যে তিন ধরনের সমস্যা দেখা যায় তা হলো- মৌখিক কিংবা অন্য কোনো প্রকার যোগাযোগ সমস্যা, সামাজিক বিকাশগত সমস্যা, খুব সীমাবদ্ধ এবং গণ্ডিবদ্ধ জীবনযাপন ও চিন্তাভাবনা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ দেখা দেয়া। এছাড়া অতি চাঞ্চল্য, জেদি ও আক্রমণাত্মক আচরণ, অহেতুক ভয়ভীতি, খিঁচুনি ইত্যাদি শিশুদের মধ্যে দেখা দিতে পারে।

শিশুটি কী কী জিনিস, বিষয়, খাবার, খেলনা ইত্যাদি খুব পছন্দ করে। এগুলো প্রশিক্ষণ সহায়কশক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। প্রশিক্ষণ সহায়ক বিষয়টিকে শিশুর দৃষ্টিসীমার মধ্যে রেখে তাকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, নির্দেশিত কাজটি করলে তার পছন্দের জিনিসটি দেয়া হবে।

এরা নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেয় না এবং আপন মনে থাকতে পছন্দ করে। এরা অন্যদের চোখের দিকে তাকায় না। অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসে না কিংবা আদর করলেও ততটা সাড়া দেয় না। একই জিনিস পুনরাবৃত্তি করে এবং একই কাজ বারবার করতে পছন্দ করে।

অটিজম কী?

১৯৪৩ সালে একজন আমেরিকান চিকিৎসক লিও ক্যানার শিশুদের আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে ১১ জন শিশুর মধ্যে আচরণগত বৈসাদৃশ্য লক্ষ করেন এবং এসব অস্বাভাবিক আচরণকারী শিশুদের রোগী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনিই এই রোগের নামকরণ করেন ‘অটিজম’। পরবর্তীতে প্রায় বছরখানেক পর অস্ট্রিয়ার চিকিৎসক হ্যান্স অ্যাসপারজারও শিশুদের ওপর গবেষণা করে কিছু শিশুদের মধ্যে আচরণগত বৈসাদৃশ্য লক্ষ করেন। মজার ব্যাপার হলো তিনিও শিশুদের এই রোগটির নামকরণ করেন ‘অটিজম’। এই নামকরণের আগে পর্যন্ত তারা কেউ কাউকে চিনতেন না এবং নামকরণও করেছিলেন তারা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবেই। গ্রিক শব্দ ‘অটোস’ থেকে ‘অটিজম’ শব্দের উৎপত্তি। ‘অটোস’ শব্দের অর্থ ‘নিজ’। ‘অটিজম’ এ আক্রান্ত রোগী সব প্রকার সামাজিকতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয় বলে এই রোগকে ‘অটিজম’ নামে নামকরণ করা হয়েছে।

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস কিভাবে এলো?

২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর কাতারে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬২তম সাধারণ সভায় বিশ্বে অটিজম সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের ২ এপ্রিল প্রথম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুর আচরণের অস্বাভাবিকতা দেখে অটিস্টিক শিশুকে চিহ্নিত করে চিকিৎসা শুরু করে তাকে সমাজের স্বাভাবিক মানুষের মতো গড়ে তোলার লক্ষ্যেই সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর বেশ ঘটা করে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়।

রোগ চেনার উপায়

সাধারণত শিশুর বয়স ১৮ মাস থেকে ৩ বছরের মধ্যে এ রোগ ব্যর্থহীনভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এখানে উল্লেখ্য, যত দ্রুত রোগটি শনাক্ত করা যায়, শিশুর জন্য ততই মঙ্গল। সাধারণত নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর শিশুদের মধ্যে থাকলে অটিজম রোগটি শনাক্তকরণ

সম্ভব:

১. এদের ভাষায় বিকাশ হতে বিলম্ব হয় (এক বছর বয়সে অর্থবহ অঙ্গভঙ্গি, ১৬ মাস বয়সে একটি শব্দ এবং ২ বছর বয়সে ২ শব্দের বাক্য বলতে পারে না)।

২. এই রোগে আক্রান্ত শিশু সমবয়সী কিংবা অন্যদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না।

৩. এরা নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেয় না এবং আপন মনে থাকতে পছন্দ করে।

৪. এরা অন্যদের চোখের দিকে তাকায় না। অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসে না কিংবা আদর করলেও ততটা সাড়া দেয় না।

৫. একই জিনিস পুনরাবৃত্তি করে এবং একই কাজ বারবার করতে পছন্দ করে।

৬. এদের কাজকর্ম এবং সক্রিয়তা সীমিত বা গণ্ডিবদ্ধ।

৭. পরিবেশ এবং আশপাশের কোনো পরিবর্তন খুব অপছন্দ করে।

৮. এরা কখনো কখনো অতি সক্রিয়, আবার কখনো কখনো খুব কম সক্রিয় হয়। অতিসক্রিয়তা থেকে কখনো কখনো খিঁচুনি হতে পারে।

৯. সাধারণত দোলনা/রকিং চেয়ার বা এ জাতীয় পুনরাবৃত্তিমূলক খেলা পছন্দ করে।

১০. সাধারণত খেলনা দিয়ে কোনো গঠনমূলক খেলা খেলতে পারে না অথবা কোনো বিশেষ খেলনার প্রতি অত্যধিক মোহ দেখা যায়।

১১. কখনো মনে হতে পারে যে, এরা কানে শুনতে পায় না।

১২. এরা মাকে বা অন্য কোনো প্রিয়জনকে জড়িয়ে ধরে না এবং তাদের কেউ ধরলেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় না অথবা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।

১৩. এরা কখনো কখনো আত্মপীড়ন করে এবং মনে হয় তাতে সে তেমন কষ্ট পায় না।

১৪. কোনো বিশেষ কিছুর প্রতি অত্যধিক আকর্ষণ থাকে। যেমন- কাগজ ছেঁড়া, পানি বা তরল পদার্থ দিয়ে খেলা, চাল বা ডাল জাতীয় দানাদার কিছু দিয়ে খেলা ইত্যাদি।

১৫. কোনো বিশেষ সংবেদনের প্রতি অস্বাভাবিক আচরণ করে। যেমন- আলোতে চোখ বন্ধ করা, শব্দ শুনলে কানে হাত দেয়া, দুর্গন্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া না করা, স্বাদে তেমন কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ না করা ইত্যাদি।

অটিজম রোগের কারণ

এখনো পর্যন্ত অটিজম কেন হয় তার সঠিক কারণ উদঘাটন সম্ভব হয়নি। জন্ম-পরবর্তীকালের কোনো জটিলতা কিংবা শিশুর প্রতি অমনোযোগিতার ফলে এ রোগের সৃষ্টি হয় না। কাজেই কোনো বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজন নিজেদের দোষী ভাবা অথবা বাবা-মাকে দায়ী করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

আমাদের দেশে সঠিক তথ্য না থাকলেও গড়ে প্রতি হাজারে ১০ থেকে ২০টি শিশু এ রোগে আক্রান্ত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। উন্নত দেশগুলোতে এ সংখ্যা আরো বেশি বলে জানা গেছে।

রোগের চিকিৎসা

১. অটিজম সারিয়ে তোলার জন্য কোনো প্রকার কার্যকর চিকিৎসা এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। কাজেই জাদুকরী বা নাটকীয় কোনোরূপ পরামর্শে বিভ্রান্ত হওয়া বোকামি। তবে নিজেদের সম্পূর্ণ অসহায় মনে করাটাও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার এই যুগে সঠিক নয়।

২. অটিস্টিক শিশুরা কখনো বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শী হয়। যথাযথভাবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তারা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে বিধায় তাদের প্রতিবন্ধী আখ্যায়িত করা সঠিক নয়।

অটিস্টিক শিশুদের প্রশিক্ষণ

১. উন্নত এবং উন্নয়নশীল অনেক দেশে অটিস্টিক শিশুদের প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে আমাদের দেশেও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এ ধরনের শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। পৃথিবীর অনেক দেশে এই শিশুদের জন্য পরিচালিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো সাধারণত এ ধরনের শিশুদের বাবা-মায়েরা পরিচালনা করে থাকেন। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর দায়িত্ব হলো দ্রুত শিশুটিকে এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উন্নত করার পথটি উন্মুক্ত করা। এক্ষেত্রে বাবা-মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও পরিচর্যাকারীদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

স্বাবলম্বিতা বিকাশ

১. বেঁচে থাকার জন্য যে কাজগুলো করা অবশ্যই দরকার সেগুলো প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

সংবেদনশীলতার সমন্বয়

১. এ ধরনের শিশুদের সংবেদনশীলতা অত্যন্ত প্রখর অথবা অপ্রতুল হওয়ায় তাদের সংবেদনশীলতার সমন্বয় না করা হলে কোনো কিছু শিখতে কিংবা মনোসংযোগ করতে অনেক বিলম্ব হয়।

শারীরিক এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ

১. শিশুদের সঙ্গে মুখোমুখি এবং একই উচ্চতায় ও চোখে চোখে রেখে কথা বলতে হবে।

২. ঠোঁটের নড়াচড়া এবং চোখের ও হাতের সঞ্চালন অনুসরণ করতে সাহায্য করতে হবে।

৩. স্বাভাবিকভাবে শিশুটি কোনো শব্দ উচ্চারণ করলে তাকে অর্থপূর্ণ শব্দে রূপান্তর করার চেষ্টা করতে হবে।

৪. শুরুতে অতি দরকারি কিছু সহজ এবং একক সেলেবল যুক্ত শব্দ নির্বাচন করে সেগুলো শেখানোর চেষ্টা করতে হবে। যেমন- মা, বাবা, পানি, ভাত, জামা, জুতা, বই, বল ইত্যাদি।

৫. শেখানো কথাগুলো বারবার এবং প্রতিদিন পুনরাবৃত্তি করতে হবে, যাতে কোনোভাবেই শিশুটি শিখে ফেলা শব্দগুলো ভুলে যেতে না পারে।

৬. শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ছবির বই, দরকারি জিনিসপত্র ইত্যাদি দেখিয়ে ধীরে ধীরে শেখানোর চেষ্টা করতে হবে।

৭. কথা বলতে না পারলে তাকে ছবির ভাষা দেয়ার চেষ্টা করতে হবে, যেন ছবি দেখিয়ে তার চাহিদা বোঝাতে পারে।

৮. এরপর ধীরে ধীরে অক্ষর, সংখ্যা, ছড়াগানের ক্যাসেট, ভিডিও ইত্যাদির প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে হবে এবং শেখানোর চেষ্টা করতে হবে।

সামাজিকতা ও আচরণগত বিকাশ

১. সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে মিশতে ও ভাবের আদান-প্রদান করতে সহায়তা করতে হবে।

২. কখনই একাকী খেলতে দেয়া যাবে না।

৩. আদান-প্রদানমূলক খেলা যেমন- বল দেয়া-নেয়া, গাড়ি দেয়া-নেয়া ইত্যাদি নিয়ম করে শিশুদের সঙ্গে খেলতে হবে। প্রথমে সহজ যেমন- লুকোচুরি, টুকি ইত্যাদি থেকে ধীরে ধীরে গঠনমূলক খেলা খেলতে হবে।

৪. শিশুকে খেলার মাঠে/পার্কে নিয়ে যেতে হবে এবং সহজভাবে চলাফেরা করতে দিতে হবে।

৫. তত্ত্বাবধানের সঙ্গে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অন্যদের সঙ্গে খেলায় সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে।

৬. শিশুটিকে সব সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে নিয়ে যেতে হবে।

৭. ‘এটা ধরো না’, ‘ওটা করো না’- সারাক্ষণ এ জাতীয় নিয়ন্ত্রণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৮. কেউ যেন শিশুটিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে, বিরূপ সমালোচনা না করে এবং কোনো কঠিন আচরণ না করে তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

জরুরি বিষয়গুলো শেখানোর উপায় কী?

প্রথমেই নিশ্চিত হোন আপনার শিশুটি কী কী জিনিস, বিষয়, খাবার, খেলনা ইত্যাদি খুব পছন্দ করে। এগুলো প্রশিক্ষণ সহায়কশক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। প্রশিক্ষণ সহায়ক বিষয়টিকে শিশুর দৃষ্টিসীমার মধ্যে রেখে তাকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, নির্দেশিত কাজটি করলে তার পছন্দের জিনিসটি দেয়া হবে। এভাবে শিক্ষণীয় কাজটি সে নির্ভুল করে একনাগাড়ে ৩-৫ বার করতে পারলে তার চাহিদা পূরণ করতে হবে এবং তাকে পুরস্কৃত করতে হবে।

বিশেষজ্ঞ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

ঢাকায় ঢাকা শিশু হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগ, চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রে অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করেন এমন বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং নার্সিং স্টাফ রয়েছেন। ঢাকায় অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, কেয়ারিং গ্লোরি, বিউটিফুল মাইন্ডসহ বেশকিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের শিশুদের নিয়ে কাজ করছে।

তবে এ কথা মানতেই হবে যে অটিস্টিক শিশুকে সমাজের অন্য শিশুদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে গড়ে তোলার জন্য যে দক্ষ জনবল বা চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা উচিত তা আজো আমাদের দেশে পর্যাপ্ত নয়। তবে আশার বাণী হলো ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা গড়ে ওঠায় ধীরে ধীরে আমাদের দেশে অটিজম নিয়ে মানুষ বেশ সচেতন হচ্ছে যা অটিস্টিক শিশুদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে বেশ সহায়ক। আসুন অটিজম সম্পর্কে জানি, অপরকে জানাই এবং অটিস্টিক শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশে সহায়তা করি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

অটিজম: জানতে হবে, বুঝতে হবে

আপডেট টাইম : ১২:৪৩:০৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ এপ্রিল ২০১৬

‘অটিজম’- শিশুদের এক অদ্ভুত মনের রোগ; বলা যেতে পারে মনোজাগতিক সমস্যা। এ রোগের কারণে শিশুদের যে তিন ধরনের সমস্যা দেখা যায় তা হলো- মৌখিক কিংবা অন্য কোনো প্রকার যোগাযোগ সমস্যা, সামাজিক বিকাশগত সমস্যা, খুব সীমাবদ্ধ এবং গণ্ডিবদ্ধ জীবনযাপন ও চিন্তাভাবনা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ দেখা দেয়া। এছাড়া অতি চাঞ্চল্য, জেদি ও আক্রমণাত্মক আচরণ, অহেতুক ভয়ভীতি, খিঁচুনি ইত্যাদি শিশুদের মধ্যে দেখা দিতে পারে।

শিশুটি কী কী জিনিস, বিষয়, খাবার, খেলনা ইত্যাদি খুব পছন্দ করে। এগুলো প্রশিক্ষণ সহায়কশক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। প্রশিক্ষণ সহায়ক বিষয়টিকে শিশুর দৃষ্টিসীমার মধ্যে রেখে তাকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, নির্দেশিত কাজটি করলে তার পছন্দের জিনিসটি দেয়া হবে।

এরা নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেয় না এবং আপন মনে থাকতে পছন্দ করে। এরা অন্যদের চোখের দিকে তাকায় না। অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসে না কিংবা আদর করলেও ততটা সাড়া দেয় না। একই জিনিস পুনরাবৃত্তি করে এবং একই কাজ বারবার করতে পছন্দ করে।

অটিজম কী?

১৯৪৩ সালে একজন আমেরিকান চিকিৎসক লিও ক্যানার শিশুদের আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে ১১ জন শিশুর মধ্যে আচরণগত বৈসাদৃশ্য লক্ষ করেন এবং এসব অস্বাভাবিক আচরণকারী শিশুদের রোগী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনিই এই রোগের নামকরণ করেন ‘অটিজম’। পরবর্তীতে প্রায় বছরখানেক পর অস্ট্রিয়ার চিকিৎসক হ্যান্স অ্যাসপারজারও শিশুদের ওপর গবেষণা করে কিছু শিশুদের মধ্যে আচরণগত বৈসাদৃশ্য লক্ষ করেন। মজার ব্যাপার হলো তিনিও শিশুদের এই রোগটির নামকরণ করেন ‘অটিজম’। এই নামকরণের আগে পর্যন্ত তারা কেউ কাউকে চিনতেন না এবং নামকরণও করেছিলেন তারা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবেই। গ্রিক শব্দ ‘অটোস’ থেকে ‘অটিজম’ শব্দের উৎপত্তি। ‘অটোস’ শব্দের অর্থ ‘নিজ’। ‘অটিজম’ এ আক্রান্ত রোগী সব প্রকার সামাজিকতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয় বলে এই রোগকে ‘অটিজম’ নামে নামকরণ করা হয়েছে।

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস কিভাবে এলো?

২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর কাতারে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬২তম সাধারণ সভায় বিশ্বে অটিজম সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের ২ এপ্রিল প্রথম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুর আচরণের অস্বাভাবিকতা দেখে অটিস্টিক শিশুকে চিহ্নিত করে চিকিৎসা শুরু করে তাকে সমাজের স্বাভাবিক মানুষের মতো গড়ে তোলার লক্ষ্যেই সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর বেশ ঘটা করে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়।

রোগ চেনার উপায়

সাধারণত শিশুর বয়স ১৮ মাস থেকে ৩ বছরের মধ্যে এ রোগ ব্যর্থহীনভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এখানে উল্লেখ্য, যত দ্রুত রোগটি শনাক্ত করা যায়, শিশুর জন্য ততই মঙ্গল। সাধারণত নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর শিশুদের মধ্যে থাকলে অটিজম রোগটি শনাক্তকরণ

সম্ভব:

১. এদের ভাষায় বিকাশ হতে বিলম্ব হয় (এক বছর বয়সে অর্থবহ অঙ্গভঙ্গি, ১৬ মাস বয়সে একটি শব্দ এবং ২ বছর বয়সে ২ শব্দের বাক্য বলতে পারে না)।

২. এই রোগে আক্রান্ত শিশু সমবয়সী কিংবা অন্যদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না।

৩. এরা নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেয় না এবং আপন মনে থাকতে পছন্দ করে।

৪. এরা অন্যদের চোখের দিকে তাকায় না। অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসে না কিংবা আদর করলেও ততটা সাড়া দেয় না।

৫. একই জিনিস পুনরাবৃত্তি করে এবং একই কাজ বারবার করতে পছন্দ করে।

৬. এদের কাজকর্ম এবং সক্রিয়তা সীমিত বা গণ্ডিবদ্ধ।

৭. পরিবেশ এবং আশপাশের কোনো পরিবর্তন খুব অপছন্দ করে।

৮. এরা কখনো কখনো অতি সক্রিয়, আবার কখনো কখনো খুব কম সক্রিয় হয়। অতিসক্রিয়তা থেকে কখনো কখনো খিঁচুনি হতে পারে।

৯. সাধারণত দোলনা/রকিং চেয়ার বা এ জাতীয় পুনরাবৃত্তিমূলক খেলা পছন্দ করে।

১০. সাধারণত খেলনা দিয়ে কোনো গঠনমূলক খেলা খেলতে পারে না অথবা কোনো বিশেষ খেলনার প্রতি অত্যধিক মোহ দেখা যায়।

১১. কখনো মনে হতে পারে যে, এরা কানে শুনতে পায় না।

১২. এরা মাকে বা অন্য কোনো প্রিয়জনকে জড়িয়ে ধরে না এবং তাদের কেউ ধরলেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় না অথবা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।

১৩. এরা কখনো কখনো আত্মপীড়ন করে এবং মনে হয় তাতে সে তেমন কষ্ট পায় না।

১৪. কোনো বিশেষ কিছুর প্রতি অত্যধিক আকর্ষণ থাকে। যেমন- কাগজ ছেঁড়া, পানি বা তরল পদার্থ দিয়ে খেলা, চাল বা ডাল জাতীয় দানাদার কিছু দিয়ে খেলা ইত্যাদি।

১৫. কোনো বিশেষ সংবেদনের প্রতি অস্বাভাবিক আচরণ করে। যেমন- আলোতে চোখ বন্ধ করা, শব্দ শুনলে কানে হাত দেয়া, দুর্গন্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া না করা, স্বাদে তেমন কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ না করা ইত্যাদি।

অটিজম রোগের কারণ

এখনো পর্যন্ত অটিজম কেন হয় তার সঠিক কারণ উদঘাটন সম্ভব হয়নি। জন্ম-পরবর্তীকালের কোনো জটিলতা কিংবা শিশুর প্রতি অমনোযোগিতার ফলে এ রোগের সৃষ্টি হয় না। কাজেই কোনো বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজন নিজেদের দোষী ভাবা অথবা বাবা-মাকে দায়ী করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

আমাদের দেশে সঠিক তথ্য না থাকলেও গড়ে প্রতি হাজারে ১০ থেকে ২০টি শিশু এ রোগে আক্রান্ত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। উন্নত দেশগুলোতে এ সংখ্যা আরো বেশি বলে জানা গেছে।

রোগের চিকিৎসা

১. অটিজম সারিয়ে তোলার জন্য কোনো প্রকার কার্যকর চিকিৎসা এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। কাজেই জাদুকরী বা নাটকীয় কোনোরূপ পরামর্শে বিভ্রান্ত হওয়া বোকামি। তবে নিজেদের সম্পূর্ণ অসহায় মনে করাটাও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার এই যুগে সঠিক নয়।

২. অটিস্টিক শিশুরা কখনো বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শী হয়। যথাযথভাবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তারা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে বিধায় তাদের প্রতিবন্ধী আখ্যায়িত করা সঠিক নয়।

অটিস্টিক শিশুদের প্রশিক্ষণ

১. উন্নত এবং উন্নয়নশীল অনেক দেশে অটিস্টিক শিশুদের প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে আমাদের দেশেও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এ ধরনের শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। পৃথিবীর অনেক দেশে এই শিশুদের জন্য পরিচালিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো সাধারণত এ ধরনের শিশুদের বাবা-মায়েরা পরিচালনা করে থাকেন। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর দায়িত্ব হলো দ্রুত শিশুটিকে এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উন্নত করার পথটি উন্মুক্ত করা। এক্ষেত্রে বাবা-মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও পরিচর্যাকারীদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

স্বাবলম্বিতা বিকাশ

১. বেঁচে থাকার জন্য যে কাজগুলো করা অবশ্যই দরকার সেগুলো প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

সংবেদনশীলতার সমন্বয়

১. এ ধরনের শিশুদের সংবেদনশীলতা অত্যন্ত প্রখর অথবা অপ্রতুল হওয়ায় তাদের সংবেদনশীলতার সমন্বয় না করা হলে কোনো কিছু শিখতে কিংবা মনোসংযোগ করতে অনেক বিলম্ব হয়।

শারীরিক এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ

১. শিশুদের সঙ্গে মুখোমুখি এবং একই উচ্চতায় ও চোখে চোখে রেখে কথা বলতে হবে।

২. ঠোঁটের নড়াচড়া এবং চোখের ও হাতের সঞ্চালন অনুসরণ করতে সাহায্য করতে হবে।

৩. স্বাভাবিকভাবে শিশুটি কোনো শব্দ উচ্চারণ করলে তাকে অর্থপূর্ণ শব্দে রূপান্তর করার চেষ্টা করতে হবে।

৪. শুরুতে অতি দরকারি কিছু সহজ এবং একক সেলেবল যুক্ত শব্দ নির্বাচন করে সেগুলো শেখানোর চেষ্টা করতে হবে। যেমন- মা, বাবা, পানি, ভাত, জামা, জুতা, বই, বল ইত্যাদি।

৫. শেখানো কথাগুলো বারবার এবং প্রতিদিন পুনরাবৃত্তি করতে হবে, যাতে কোনোভাবেই শিশুটি শিখে ফেলা শব্দগুলো ভুলে যেতে না পারে।

৬. শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ছবির বই, দরকারি জিনিসপত্র ইত্যাদি দেখিয়ে ধীরে ধীরে শেখানোর চেষ্টা করতে হবে।

৭. কথা বলতে না পারলে তাকে ছবির ভাষা দেয়ার চেষ্টা করতে হবে, যেন ছবি দেখিয়ে তার চাহিদা বোঝাতে পারে।

৮. এরপর ধীরে ধীরে অক্ষর, সংখ্যা, ছড়াগানের ক্যাসেট, ভিডিও ইত্যাদির প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে হবে এবং শেখানোর চেষ্টা করতে হবে।

সামাজিকতা ও আচরণগত বিকাশ

১. সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে মিশতে ও ভাবের আদান-প্রদান করতে সহায়তা করতে হবে।

২. কখনই একাকী খেলতে দেয়া যাবে না।

৩. আদান-প্রদানমূলক খেলা যেমন- বল দেয়া-নেয়া, গাড়ি দেয়া-নেয়া ইত্যাদি নিয়ম করে শিশুদের সঙ্গে খেলতে হবে। প্রথমে সহজ যেমন- লুকোচুরি, টুকি ইত্যাদি থেকে ধীরে ধীরে গঠনমূলক খেলা খেলতে হবে।

৪. শিশুকে খেলার মাঠে/পার্কে নিয়ে যেতে হবে এবং সহজভাবে চলাফেরা করতে দিতে হবে।

৫. তত্ত্বাবধানের সঙ্গে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অন্যদের সঙ্গে খেলায় সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে।

৬. শিশুটিকে সব সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে নিয়ে যেতে হবে।

৭. ‘এটা ধরো না’, ‘ওটা করো না’- সারাক্ষণ এ জাতীয় নিয়ন্ত্রণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৮. কেউ যেন শিশুটিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে, বিরূপ সমালোচনা না করে এবং কোনো কঠিন আচরণ না করে তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

জরুরি বিষয়গুলো শেখানোর উপায় কী?

প্রথমেই নিশ্চিত হোন আপনার শিশুটি কী কী জিনিস, বিষয়, খাবার, খেলনা ইত্যাদি খুব পছন্দ করে। এগুলো প্রশিক্ষণ সহায়কশক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। প্রশিক্ষণ সহায়ক বিষয়টিকে শিশুর দৃষ্টিসীমার মধ্যে রেখে তাকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, নির্দেশিত কাজটি করলে তার পছন্দের জিনিসটি দেয়া হবে। এভাবে শিক্ষণীয় কাজটি সে নির্ভুল করে একনাগাড়ে ৩-৫ বার করতে পারলে তার চাহিদা পূরণ করতে হবে এবং তাকে পুরস্কৃত করতে হবে।

বিশেষজ্ঞ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

ঢাকায় ঢাকা শিশু হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগ, চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রে অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করেন এমন বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং নার্সিং স্টাফ রয়েছেন। ঢাকায় অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, কেয়ারিং গ্লোরি, বিউটিফুল মাইন্ডসহ বেশকিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের শিশুদের নিয়ে কাজ করছে।

তবে এ কথা মানতেই হবে যে অটিস্টিক শিশুকে সমাজের অন্য শিশুদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে গড়ে তোলার জন্য যে দক্ষ জনবল বা চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা উচিত তা আজো আমাদের দেশে পর্যাপ্ত নয়। তবে আশার বাণী হলো ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা গড়ে ওঠায় ধীরে ধীরে আমাদের দেশে অটিজম নিয়ে মানুষ বেশ সচেতন হচ্ছে যা অটিস্টিক শিশুদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে বেশ সহায়ক। আসুন অটিজম সম্পর্কে জানি, অপরকে জানাই এবং অটিস্টিক শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশে সহায়তা করি।