ঢাকা ১২:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাবা-মায়ের চেয়েও আমাদের কাছে দেশ ছিল বড়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৪৪:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ মার্চ ২০১৬
  • ৩৬১ বার

অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। একাত্তরে কুমিল্লা রণাঙ্গনে লড়াই করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার আগে তিনি যুক্ত ছিলেন না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে, তবু দেশের প্রয়োজনে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে দ্বিধা করেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যোগ দেন সরকারী চাকরিতে, অনেক চাপ আর প্রলোভনকে উপেক্ষা করে দূরে থেকেছেন দলীয় রাজনীতি থেকে। তবে সাংগঠনিকভাবে তিনি সম্পৃক্ত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সঙ্গে। অবসরজীবনে নিজ এলাকা কুমিল্লার মেঘনা অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে নিবেদিত হয়েছেন। কুমিল্লা ২ নং সেক্টরে লড়াই করা এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মুখোমুখি হয়েছিল পূর্বপশ্চিম। যে আদর্শ আর চেতনায় সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে শাহজালাল ভুঁইয়া মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, বললেন সেই কথা। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনা যাক মুক্তিযোদ্ধার নিজের ভাষ্যেই।
[সাক্ষাৎকার ও অনুলিখন: বিপুল হাসান/ ছবি: নাজমুল হাসান]

‘কৃষক পরিবারের সন্তান আমি। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে ক্ষেতেখামারে ছুটতে হতো, তাকে কৃষিকাজে সহায়তা করতাম। আমি কৃষক হই তা অবশ্য বাবা চাইতেন না। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, তার ছেলে পড়াশোনা করে বড় অফিসার হবে। পড়াশোনা আমার ভালো লাগতো না। তবু বাবার চাপে পড়েই স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করি। কৃষিকাজের ফাঁকেই পড়াশোনা শেষ করে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করি।’

‘যে সময়টায় আমি বড় হয়ে ওঠেছি, সেই ষাটের দশক জুড়ে দেশ ছিল উত্তাল। শিক্ষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা, আইয়ুব বিরোধী অন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান; সবশেষে সত্তরের নির্বাচন – কতোকিছু হলো এই সময়টাতে। আমার বয়সী ছেলের সবাই রাজনীতি করতো, মিছিলে যেত, পুলিশের গুলিতে মারা যেত। কেন জানি রাজনীতি আমাকে সেভাবে টানতো না। যে সময়টায় সহপাঠীরা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিত, আমি আমার কৃষক বাবার সঙ্গে কাটাতাম। চাষাবাদে তাকে সহায়তা করেই আনন্দ পেতাম। সমবয়সী বন্ধুরা আমাকে মিটিং মিছিলে নিয়ে যেতে চাইতো। ভালো লাগতো না বলে এড়িয়ে যেতাম। আওয়ামী লীগ বা মুসলীম লীগ আর ছাত্র লীগ বা ছাত্র ইউনিয়ন কোনোটার সঙ্গেই যুক্ত হই নাই।’

‘রাজনীতি না করলেও এটা বুঝতে পারতাম পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা আমাদের ঠকাচ্ছে। তার আমাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। বাঙালিদের যোগ্যতা থাকলেও তাদের সরকারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয় না। আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নে পশ্চিমাদের নজর নেই। বরং এদেশের টাকা লুটপাট করে নিয়ে তারা করাচিতে গড়ে তুলছে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। এই ব্যাপারগুলো শুধু আমি নই, সব বাঙালিই বুঝতো। আর দল-মত-ধর্ম-পেশা নির্বিশেষে এটা সবাইকে বোঝানোর কঠিন দায়িত্বটা পালন করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’

‘রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও মনে মনে একজনকে নেতা মেনেছি, তিনি বঙ্গবন্ধু। তিনি এমনই এক কারিগর যে পুরো জাতিকে এক সুতায় গেঁথেছিলেন। অনেককেই বলতে শুনি, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তাদের সঙ্গে একমত নই। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি। ৭ মার্চের ভাষণে শেখসাহেব বলেছিলেন, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব।এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই ভাষণেই স্পষ্ট তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’

‘বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি। তিনি জন্ম না নিলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির নেতা। দলীয় গন্ডির অনেক উধ্বে তার অবস্থান। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নের্তৃত্ব দিলেও এতে অংশ নেয় দল-মত-ধর্ম-পেশা নির্বিশেষে সাধারণ মানুষেরা। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থেকেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া গণমানুষের একজন আমি।’

‘দুপুরে সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাবো, সন্ধ্যার পর রওনা দিলাম সীমান্তের উদ্দেশ্যে। যুদ্ধে যাবো এরকম চিন্তাভাবনা আগে থেকে করে রাখিনি। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে জমিতে চাষাবাদ করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ১৫/২০ জনের একটা দল আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে অাসার পর সবাইকে চিনলাম। এরা আমাদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর চাচাত-জ্যাঠাত আর দূরসম্পর্কের ভাই। ওদের মধ্যে আমার চেয়ে কমবয়সী যেমন আছে, তেমনি আছে বেশি বয়সী। সবার বয়সই ১৬ থেকে ২২ এর মধ্যে। ওদের একজন আমাকে বললো, দেশে এতোকিছু হইতাছে। তুমি কি কোনো খবর রাখো? এখন কি জমিতে লাঙ্গল দিয়া দিন কাটানোর সময়? আমি ধরে ফেললাম ওরা কী বলতে চায়? স্পষ্টভাবেই বললাম, তোমরা কী মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা বলছো? ওরা জানালো, সবাই মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায়। আমাকে ওদের সঙ্গে যেতে হবে। বললাম, যাবো মুক্তিযুদ্ধে।’

‘সেদিন সন্ধার পরই বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা হবো বলে ঠিক হলো। ত্রিপুরায় তখন মেজর হায়দার ক্যাম্প খুলেছেন। তার ক্যাম্পেই গেরিলা ট্রেনিং নেব বলে ঠিক করি। জমিতে লাঙ্গল দেওয়ার কাজ শেষ করে বিকেলে বাড়ি ফিরে বোনকে ডেকে বললাম, আমার কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে চাদরে বেঁধে দিতে। বাবা মসজিদে মাগরেবের নামাজ বাড়িতে ফিরে তাকে সালাম করলাম। বললাম, আপনি অনুমতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চাই। বাবা বললেন, ঠিক আছে যাও। আমার মা চিৎকার করে কেঁদে বললেন, অনুমতি দিবেন না। বাবা তখন মাকে ধমক দিয়ে বললেন, তুমি কি চাও তোমার ছেলে বেয়াদবী করুক। বাবার এই কথার অর্থটা পরে বুঝতে পেরেছি। আমাকে অনুমতি না দেলেও তার অবাধ্য হয়ে বেয়াদবী করে আমি য়ে মুক্তিযুদ্ধে যাবো, এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বলেই মাকে ওই কথা বলেছিলেন।’

‘আমাদের ২০ তরুণের ওই দলটি রাতেই সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরার মেলাঘরের মেজর হায়দারের ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌাছাই। একটা জঙ্গলের ভেতর ছিল ওই ক্যাম্প। সেখানে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নেই। ট্রেনিং শেষে যার যার এলাকায় ফিরে গিয়ে পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প ও স্থাপনার ওপর গেরিলা হামলা চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়। আমাদের দেয়া হয় এলএমজি-গ্রেনেডসহ বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ। প্রায় দেড়মাস পর ফিরে আসি নিজ গ্রাম মহেশখোলাতে। অস্ত্র-গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখি সবার অজান্তে আমাদের বাড়ির ধানের গোলার ভেতর। আর খোঁজখবর নিতে থাকি আশেপাশের কোথায় কোথায় পাকিস্তানি মিলিটারিরা ক্যাম্প করেছে। কখন দাউদকান্দি দিয়ে অার্মির কনভয় যাওয়া-আসা করে। মেঘনা অার গোমতি দিয়ে আর্মি নেভির শিপ সপ্তাহে কয়বার টহল দেয়, কখন আসে, কতোজন থাকে। স্বতস্ফুর্তভাবে মানুষের কাছ থেকে তথ্য পেতে থাকি। এমন কী রাজাকাররাও আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে। তারা বলতো, আমরা চাপে পড়ে পরিবার-পরিজনকে রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছি। কিন্তু পাকিস্তানিদের আমরা ঘৃণা করি। আমরা চাই স্বাধীন বাংলার পক্ষে থাকতে। অামরা ওদের বলতাম, তোমরা মিলিটিারিদের সঙ্গেই থাকো। আর ওদের খবরাখবর আমাদের জানাও। ওরা তাই করতো। এখন ওদের রাজাকার বলবো নাকি মুক্তিযোদ্ধা বলবো!’

‘আমার বাড়ির ধানের গোলার ভেতর লুকিয়ে রাখা অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে ঘটলো আরেক ঘটনা। কাউকে না জানিয়ে আমি ওইগুলো রেখেছিলাম। একদিন মা গোলাঘর থেকে ধান অানতে গেলেন। ধানের ভেতর লুকিয়ে অস্ত্রগুলো দেখে আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে ওঠলেন। চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই ছুটলো গোলাঘরে। আমি বুঝে ফেললাম, ঘটনা কী ঘটেছে! পাগলের মতো ছুটে গিয়ে গোলাঘরের দরোজা আগলে দাঁড়িয়ে সবাইকে বললাম, খবরদার ভেতরে কেউ ঢুকবে না। কী হয়েছে আমি দেখছি। আমার কণ্ঠে এমন কিছু হয়তো ছিল সবাই চলে গেল। বাবাকে নিয়ে গোলাঘরে ঢুকলাম। ধানের ভেতর থেকে হাত ঢুকিয়ে একটা এলএমজি উচু করে ধরে বললাম, যা দেখার দেখেছো। কিন্তু এটা যদি অন্য কারে কানে যায়, তাহলে বুঝবো তোমরাই বলেছো। দায়ি হবে তোমরা। মা-বাবা হলেও তোমাদের ছাড় দেওয়া হবে না। বাবা-মার চোখে সেদিন দেখেছিলাম শূন্য দৃষ্টি। কিন্তু আমার করার কিছু ছিল না। কারণ ওই সময়টায় বাবা-মায়ের চেয়েও আমাদের কাছে দেশ ছিল বড়’।

‘দাউদকান্দি আর চিটাগাং রোডে বেশ কয়েকটা গেরিলা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করি। গোমতি নদীতে পাকিস্তানি নেভির গান শিপ উড়িয়ে দেই। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্যকে খতম করলেও আমাদের গেরিলা দলটির কেউ প্রাণ হারায়নি, তবে একাধিক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হয় বেশকয়েকজন।
আমাদের গেরিলা হামলার কৌশল ছিল- কিছু বুঝে ওঠার আগেই শত্রুদের ওপর আচমকা হামলা চালানো। ওদের ক্ষয়ক্ষতি করে নিজেরা নিরাপদে ফিরে আসা। কুমিল্লার মধ্যে গেরিলা হামলায় আমাদের দলটাই নিজেদের নিরাপদে রেখে সবচেয়ে বেশি অপারেশন করে। আমাদের কুমিল্লা অঞ্চল স্বাধীন হয়ে যায় ৮ ডিসেম্বর।’

স্বাধীনতার পর পাসপোর্ট অফিসের সরকারী চাকরিতে যোগ দেই। সহযোদ্ধাদের অনেকে আওয়ামী লীগ, আবার কেউ কেউ জাসদে যোগ দিলেও রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াতে ইচ্ছে করেনি। অনেক চাপ এসেছে, প্রলোভন এসেছে। দলীয় রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি। কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য তো আমি মুক্তিযুদ্ধ করিনি। দেশের জন্য দেশপ্রেম থেকেই যুদ্ধ করেছি। রাজনৈতিক দলের ব্যানারে কাজ করলে হয়তো প্রমোশন হতো, আরো বড় পদে গিয়ে অবসরে যেতে পারতাম। কিন্তু মন থেকে সাড়া পাইনি। সরকারী চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে এখন কাজ করছি।

‘অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই বলতে শুনি, দেশ স্বাধীন করে কী পেলাম? কিংবা দেশ আমাদের কী দিল? আসলে কিছু পাওয়ার লোভে পড়ে তো আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করি নাই। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসেব করে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি নাই। বরং দেশকে কিছু দেওয়ার জন্য, দেশের মানুষের স্বাধীনতার সাধ পূরণের জন্যই যুদ্ধ করেছি। এখন কেন মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য প্রতিদান চাইবো? তবে হ্যা, মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দরকার। তাদের যোগ্য সম্মান দেওয়া দরকার। সুবিধার জন্য নয়, সম্মান আর স্বীকৃতি জন্যই মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ও নির্ভুল তালিকা প্রয়োজন। মেঘনা অঞ্চলে আমাদের দলের এমন কয়েকজন সদস্য আছে, যারা আমার পাশে থেকে মুক্তিযুদ্ধ অংশ নিয়েছে। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় কখনো তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এটা আমাকে কষ্ট দেয়। কখনো তাদের কারো সঙ্গে দেখা হলে অামার মাথা নিঁচু হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকার অাদায় নয়, তাদের সম্মান ও মর্যাদা আদায়ের জন্যই মুক্তিযোদ্ধা সংসদে সাংগঠনিক কাজে নিজেকে জড়িয়েছি।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

বাবা-মায়ের চেয়েও আমাদের কাছে দেশ ছিল বড়

আপডেট টাইম : ১২:৪৪:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ মার্চ ২০১৬

অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। একাত্তরে কুমিল্লা রণাঙ্গনে লড়াই করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার আগে তিনি যুক্ত ছিলেন না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে, তবু দেশের প্রয়োজনে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে দ্বিধা করেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যোগ দেন সরকারী চাকরিতে, অনেক চাপ আর প্রলোভনকে উপেক্ষা করে দূরে থেকেছেন দলীয় রাজনীতি থেকে। তবে সাংগঠনিকভাবে তিনি সম্পৃক্ত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সঙ্গে। অবসরজীবনে নিজ এলাকা কুমিল্লার মেঘনা অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে নিবেদিত হয়েছেন। কুমিল্লা ২ নং সেক্টরে লড়াই করা এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মুখোমুখি হয়েছিল পূর্বপশ্চিম। যে আদর্শ আর চেতনায় সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে শাহজালাল ভুঁইয়া মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, বললেন সেই কথা। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনা যাক মুক্তিযোদ্ধার নিজের ভাষ্যেই।
[সাক্ষাৎকার ও অনুলিখন: বিপুল হাসান/ ছবি: নাজমুল হাসান]

‘কৃষক পরিবারের সন্তান আমি। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে ক্ষেতেখামারে ছুটতে হতো, তাকে কৃষিকাজে সহায়তা করতাম। আমি কৃষক হই তা অবশ্য বাবা চাইতেন না। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, তার ছেলে পড়াশোনা করে বড় অফিসার হবে। পড়াশোনা আমার ভালো লাগতো না। তবু বাবার চাপে পড়েই স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করি। কৃষিকাজের ফাঁকেই পড়াশোনা শেষ করে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করি।’

‘যে সময়টায় আমি বড় হয়ে ওঠেছি, সেই ষাটের দশক জুড়ে দেশ ছিল উত্তাল। শিক্ষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা, আইয়ুব বিরোধী অন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান; সবশেষে সত্তরের নির্বাচন – কতোকিছু হলো এই সময়টাতে। আমার বয়সী ছেলের সবাই রাজনীতি করতো, মিছিলে যেত, পুলিশের গুলিতে মারা যেত। কেন জানি রাজনীতি আমাকে সেভাবে টানতো না। যে সময়টায় সহপাঠীরা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিত, আমি আমার কৃষক বাবার সঙ্গে কাটাতাম। চাষাবাদে তাকে সহায়তা করেই আনন্দ পেতাম। সমবয়সী বন্ধুরা আমাকে মিটিং মিছিলে নিয়ে যেতে চাইতো। ভালো লাগতো না বলে এড়িয়ে যেতাম। আওয়ামী লীগ বা মুসলীম লীগ আর ছাত্র লীগ বা ছাত্র ইউনিয়ন কোনোটার সঙ্গেই যুক্ত হই নাই।’

‘রাজনীতি না করলেও এটা বুঝতে পারতাম পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা আমাদের ঠকাচ্ছে। তার আমাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। বাঙালিদের যোগ্যতা থাকলেও তাদের সরকারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয় না। আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নে পশ্চিমাদের নজর নেই। বরং এদেশের টাকা লুটপাট করে নিয়ে তারা করাচিতে গড়ে তুলছে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। এই ব্যাপারগুলো শুধু আমি নই, সব বাঙালিই বুঝতো। আর দল-মত-ধর্ম-পেশা নির্বিশেষে এটা সবাইকে বোঝানোর কঠিন দায়িত্বটা পালন করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’

‘রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও মনে মনে একজনকে নেতা মেনেছি, তিনি বঙ্গবন্ধু। তিনি এমনই এক কারিগর যে পুরো জাতিকে এক সুতায় গেঁথেছিলেন। অনেককেই বলতে শুনি, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তাদের সঙ্গে একমত নই। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি। ৭ মার্চের ভাষণে শেখসাহেব বলেছিলেন, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব।এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই ভাষণেই স্পষ্ট তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’

‘বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি। তিনি জন্ম না নিলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির নেতা। দলীয় গন্ডির অনেক উধ্বে তার অবস্থান। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নের্তৃত্ব দিলেও এতে অংশ নেয় দল-মত-ধর্ম-পেশা নির্বিশেষে সাধারণ মানুষেরা। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থেকেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া গণমানুষের একজন আমি।’

‘দুপুরে সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাবো, সন্ধ্যার পর রওনা দিলাম সীমান্তের উদ্দেশ্যে। যুদ্ধে যাবো এরকম চিন্তাভাবনা আগে থেকে করে রাখিনি। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে জমিতে চাষাবাদ করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ১৫/২০ জনের একটা দল আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে অাসার পর সবাইকে চিনলাম। এরা আমাদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর চাচাত-জ্যাঠাত আর দূরসম্পর্কের ভাই। ওদের মধ্যে আমার চেয়ে কমবয়সী যেমন আছে, তেমনি আছে বেশি বয়সী। সবার বয়সই ১৬ থেকে ২২ এর মধ্যে। ওদের একজন আমাকে বললো, দেশে এতোকিছু হইতাছে। তুমি কি কোনো খবর রাখো? এখন কি জমিতে লাঙ্গল দিয়া দিন কাটানোর সময়? আমি ধরে ফেললাম ওরা কী বলতে চায়? স্পষ্টভাবেই বললাম, তোমরা কী মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা বলছো? ওরা জানালো, সবাই মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায়। আমাকে ওদের সঙ্গে যেতে হবে। বললাম, যাবো মুক্তিযুদ্ধে।’

‘সেদিন সন্ধার পরই বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা হবো বলে ঠিক হলো। ত্রিপুরায় তখন মেজর হায়দার ক্যাম্প খুলেছেন। তার ক্যাম্পেই গেরিলা ট্রেনিং নেব বলে ঠিক করি। জমিতে লাঙ্গল দেওয়ার কাজ শেষ করে বিকেলে বাড়ি ফিরে বোনকে ডেকে বললাম, আমার কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে চাদরে বেঁধে দিতে। বাবা মসজিদে মাগরেবের নামাজ বাড়িতে ফিরে তাকে সালাম করলাম। বললাম, আপনি অনুমতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চাই। বাবা বললেন, ঠিক আছে যাও। আমার মা চিৎকার করে কেঁদে বললেন, অনুমতি দিবেন না। বাবা তখন মাকে ধমক দিয়ে বললেন, তুমি কি চাও তোমার ছেলে বেয়াদবী করুক। বাবার এই কথার অর্থটা পরে বুঝতে পেরেছি। আমাকে অনুমতি না দেলেও তার অবাধ্য হয়ে বেয়াদবী করে আমি য়ে মুক্তিযুদ্ধে যাবো, এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বলেই মাকে ওই কথা বলেছিলেন।’

‘আমাদের ২০ তরুণের ওই দলটি রাতেই সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরার মেলাঘরের মেজর হায়দারের ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌাছাই। একটা জঙ্গলের ভেতর ছিল ওই ক্যাম্প। সেখানে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নেই। ট্রেনিং শেষে যার যার এলাকায় ফিরে গিয়ে পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প ও স্থাপনার ওপর গেরিলা হামলা চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়। আমাদের দেয়া হয় এলএমজি-গ্রেনেডসহ বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ। প্রায় দেড়মাস পর ফিরে আসি নিজ গ্রাম মহেশখোলাতে। অস্ত্র-গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখি সবার অজান্তে আমাদের বাড়ির ধানের গোলার ভেতর। আর খোঁজখবর নিতে থাকি আশেপাশের কোথায় কোথায় পাকিস্তানি মিলিটারিরা ক্যাম্প করেছে। কখন দাউদকান্দি দিয়ে অার্মির কনভয় যাওয়া-আসা করে। মেঘনা অার গোমতি দিয়ে আর্মি নেভির শিপ সপ্তাহে কয়বার টহল দেয়, কখন আসে, কতোজন থাকে। স্বতস্ফুর্তভাবে মানুষের কাছ থেকে তথ্য পেতে থাকি। এমন কী রাজাকাররাও আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে। তারা বলতো, আমরা চাপে পড়ে পরিবার-পরিজনকে রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছি। কিন্তু পাকিস্তানিদের আমরা ঘৃণা করি। আমরা চাই স্বাধীন বাংলার পক্ষে থাকতে। অামরা ওদের বলতাম, তোমরা মিলিটিারিদের সঙ্গেই থাকো। আর ওদের খবরাখবর আমাদের জানাও। ওরা তাই করতো। এখন ওদের রাজাকার বলবো নাকি মুক্তিযোদ্ধা বলবো!’

‘আমার বাড়ির ধানের গোলার ভেতর লুকিয়ে রাখা অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে ঘটলো আরেক ঘটনা। কাউকে না জানিয়ে আমি ওইগুলো রেখেছিলাম। একদিন মা গোলাঘর থেকে ধান অানতে গেলেন। ধানের ভেতর লুকিয়ে অস্ত্রগুলো দেখে আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে ওঠলেন। চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই ছুটলো গোলাঘরে। আমি বুঝে ফেললাম, ঘটনা কী ঘটেছে! পাগলের মতো ছুটে গিয়ে গোলাঘরের দরোজা আগলে দাঁড়িয়ে সবাইকে বললাম, খবরদার ভেতরে কেউ ঢুকবে না। কী হয়েছে আমি দেখছি। আমার কণ্ঠে এমন কিছু হয়তো ছিল সবাই চলে গেল। বাবাকে নিয়ে গোলাঘরে ঢুকলাম। ধানের ভেতর থেকে হাত ঢুকিয়ে একটা এলএমজি উচু করে ধরে বললাম, যা দেখার দেখেছো। কিন্তু এটা যদি অন্য কারে কানে যায়, তাহলে বুঝবো তোমরাই বলেছো। দায়ি হবে তোমরা। মা-বাবা হলেও তোমাদের ছাড় দেওয়া হবে না। বাবা-মার চোখে সেদিন দেখেছিলাম শূন্য দৃষ্টি। কিন্তু আমার করার কিছু ছিল না। কারণ ওই সময়টায় বাবা-মায়ের চেয়েও আমাদের কাছে দেশ ছিল বড়’।

‘দাউদকান্দি আর চিটাগাং রোডে বেশ কয়েকটা গেরিলা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করি। গোমতি নদীতে পাকিস্তানি নেভির গান শিপ উড়িয়ে দেই। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্যকে খতম করলেও আমাদের গেরিলা দলটির কেউ প্রাণ হারায়নি, তবে একাধিক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হয় বেশকয়েকজন।
আমাদের গেরিলা হামলার কৌশল ছিল- কিছু বুঝে ওঠার আগেই শত্রুদের ওপর আচমকা হামলা চালানো। ওদের ক্ষয়ক্ষতি করে নিজেরা নিরাপদে ফিরে আসা। কুমিল্লার মধ্যে গেরিলা হামলায় আমাদের দলটাই নিজেদের নিরাপদে রেখে সবচেয়ে বেশি অপারেশন করে। আমাদের কুমিল্লা অঞ্চল স্বাধীন হয়ে যায় ৮ ডিসেম্বর।’

স্বাধীনতার পর পাসপোর্ট অফিসের সরকারী চাকরিতে যোগ দেই। সহযোদ্ধাদের অনেকে আওয়ামী লীগ, আবার কেউ কেউ জাসদে যোগ দিলেও রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াতে ইচ্ছে করেনি। অনেক চাপ এসেছে, প্রলোভন এসেছে। দলীয় রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি। কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য তো আমি মুক্তিযুদ্ধ করিনি। দেশের জন্য দেশপ্রেম থেকেই যুদ্ধ করেছি। রাজনৈতিক দলের ব্যানারে কাজ করলে হয়তো প্রমোশন হতো, আরো বড় পদে গিয়ে অবসরে যেতে পারতাম। কিন্তু মন থেকে সাড়া পাইনি। সরকারী চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে এখন কাজ করছি।

‘অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই বলতে শুনি, দেশ স্বাধীন করে কী পেলাম? কিংবা দেশ আমাদের কী দিল? আসলে কিছু পাওয়ার লোভে পড়ে তো আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করি নাই। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসেব করে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি নাই। বরং দেশকে কিছু দেওয়ার জন্য, দেশের মানুষের স্বাধীনতার সাধ পূরণের জন্যই যুদ্ধ করেছি। এখন কেন মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য প্রতিদান চাইবো? তবে হ্যা, মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দরকার। তাদের যোগ্য সম্মান দেওয়া দরকার। সুবিধার জন্য নয়, সম্মান আর স্বীকৃতি জন্যই মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ও নির্ভুল তালিকা প্রয়োজন। মেঘনা অঞ্চলে আমাদের দলের এমন কয়েকজন সদস্য আছে, যারা আমার পাশে থেকে মুক্তিযুদ্ধ অংশ নিয়েছে। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় কখনো তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এটা আমাকে কষ্ট দেয়। কখনো তাদের কারো সঙ্গে দেখা হলে অামার মাথা নিঁচু হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকার অাদায় নয়, তাদের সম্মান ও মর্যাদা আদায়ের জন্যই মুক্তিযোদ্ধা সংসদে সাংগঠনিক কাজে নিজেকে জড়িয়েছি।’