আমাদের ক্ষমা করো তনু

তনু। সোহাগী জাহান তনু। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ২০ মার্চ সোমবার কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকা থেকে তনু’র (২০) লাশ উদ্ধার করা হয়। হয়তো কোন কাপুরুষ তার পুরুষত্য দেখাতে চেয়েছিল। হয়তো অপকর্ম করেছে বা করার চেষ্টা করেছে। পরে ঝামেলা মনে করে সোহাগী জাহান তনুকে হত্যা করে উপর ওয়ালার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই ঘটনাটি বর্তমানে দেশে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনা থেকে তো কোন পৃথক ঘটনা নয়। এরকম ঘটনা তো আমাদের দেশে হারহামেসা ঘটছেই। মাত্র এক মাসের কম সময়ের মধ্যেই কুমিল্লার সদর দক্ষিণ ও মনোহরগঞ্জে তিন শিশুকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে। কয়েকদিন আমরা সাংবাদিকরা লেখার জন্য লিখছি।
এসব ঘটনা পড়ে অভ্যাসে পরিণত হওয়া পাঠকরাও পড়ার জন্যই পড়ে। আস্তে আস্তে আমরা তা ভুলে গেছি। এই তনুর ঘটনাও আর কয়েকদিন পর ভুলে যাবো। এটা তো নতুন কোন বিষয় না। সে’তো আমার ছোট বোন না, না কোন আত্মীয় স্বজন বা পাড়া প্রতিবেশী, না কোন সহকর্মী। কোন ভাবেই তার সঙ্গে আমার নূন্যতম কোন দিন পরিচয় আছে বা ছিল বলে মনে হয়নি। কিন্তু এই সোহাগী জাহান তনুর জন্য আমার প্রাণ কাঁদছে কেন ? রাত সোয়া একটায় ঘুমাতে গিয়েও ঘুমাতে পারিনি কেন ? সকালে অফিসে এসেও রিপোটিংয়ে মন বসাতে পারছি না। বার বার চোখের সামনে ভেসে আসছে তনুর সুন্দর সুশ্রী নিস্পাপ নিস্কলঙ্ক চেহারাটি। কেন তার জন্য আমার এত অস্থিরতা। স্বাধীন সার্বভৌম এই দেশের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায়ও যদি তনুরা নিরাপদ না থাকে তাতে আমার মত ছাপোষা সাংবাদিকেরই বা কি করার আছে।
সোহাগীর পরিবারের সূত্রে জানা যায়, পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে সোহাগী পাড়াশোনার পাশিপাশি বাসার কাছে অলিপুর গ্রামে এক বাসায় টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে আসছিল। তার বাবা একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। ২১ মার্চ সন্ধ্যায় টিউশনি করতে গিয়ে সে আর বাসায় ফিরে আসেনি। তার ব্যবহৃত সেল ফোন নাম্বারে একাধিকবার চেষ্টা করে তা বন্ধ পেয়ে বাবা গেলেন তনুর টিউশনির বাড়িতে। সেখানে খবর পেলেন, সে তো অনেক আগেই পড়া শেষ করে চলে গেছে। এই কথা শুনে সন্তান হারানোর আশঙ্কায় ডুকরে কেঁদে উঠে বাবা ইয়ার হোসেনের প্রাণ। দিক ভ্রান্ত হয়ে পরিবারের সকলকে নিয়ে খুঁজতে থাকেন সন্তান তনুকে। যে সন্তান বাবার অসচ্ছলতার কষ্টকে কিছুটা লাগব করার জন্য নিজেই বেছে নিয়েছে সংগ্রামী জীবন। লেখা পড়া, সংসারের কাজ আবার পড়াশুনার খরচ মিটিয়ে সংসারকে সহযোগিতা করার জন্য ছাত্র পড়িয়ে কিছু টাকা উপার্জন করে চরম ধৈর্য্য ধরে সব কিছুই করে যাচ্ছিল তনু। সেই প্রিয় সন্তানের প্রিয় মুখটি দেখার জন্য যখন পাগলের মত ঘুরছে বাবা, ঠিক এ পর্যায়ে অলিপুর কালো পানির টাংকি নামক স্থানে রাস্তায় তনুর ব্যবহৃত জুতা দেখতে পাওয়া যায়। পরে এখানে সেখানে ছেড়া চুল, ছেড়া ওড়না ও রাস্তার পাশে ঝোপের ভিতরে মাথা থেতলানো লাশ পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ছাড়া ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে না। হত্যার ঘটনায় সোহাগীর বাবা বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের নামে কুমিল্লা কোতয়ালী মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
সোহাগী জাহান তনুকে যারা হত্যা করেছে, হত্যার আগে তার হীন লোভাতুর কায়েমী স্বার্থ চারিতার্থ করেছে বা করার চেষ্টা করেছে আমার দৃষ্টিতে তারা মানুষ না, বখাটে না, দুর্বৃত্ত্ না। তারা মানুষ নামের কুলাঙ্গার, জানোয়ার, নর্দমার কীট। যে কোন স্বাভাবিক সমাজে তাদের বেঁচে থাকার কোন নৈতিক এবং নাগরিক অধিকার নেই। ঘটনার ২ দিন অতিবাহিত হলেও এখনো (এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত) পুলিশ ঘটনার রহস্য উদঘাটন কিংবা জড়িতদের গ্রেফতার করতে পারে নি। ইতিমধ্যে ওই সকল কুলাঙ্গার ঘাতকদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে ২২ মার্চ মঙ্গলবার কুমিল্লা ছিল এক উত্তাল নগরী। ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বিক্ষুদ্ধ এবং আন্দোলনের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়ে রেখেছে। হয়তো তারা তাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবে। ন্যায় সংগত আন্দোলনের অংশ হিসেবে যেটুকু ছাত্রদের করার কথা তারা তাই করে যাচ্ছে সঙ্গে যোগ দিয়েছে কুমিল্লার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনও। কারণ, মেধাবী তনু ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের সদস্যও ছিল।
কিন্ত সোহাগী জাহান তনুর জন্য আমরা কি করতে পারছি। আমরা সাংবাদিকরা পত্রিকায় লিখছি, ছাত্ররা মিছিল, মানববন্ধন করছে হয়তো আরো কয়েকদিন করবে। এরপর এক পর্যায়ে পত্রিকার সংবাদ বন্ধ হয়ে অন্য সংবাদ বেরুবে পাঠকও ওই সংবাদ পড়ার নেশায় থাকবে। হারিয়ে যাবে মেধাবী সোহাগী জাহান তনুর ঘটনাটি। হয়তো ধামাচাপা পড়ে যাবে পুরো ঘটনাটি। কিন্ত তনুর পরিবারের কি হবে ?
এভাবে আর কত সোহাগী জাহান তনুরা কুলাঙ্গার পুরুষদের লালসার শিকার হয়ে অকালে জীবন দিবে ? এই বেদনা দায়ক গল্পের কি পূনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। এর কি কোন শেষ নেই। এভাবে একটি সমাজ, একটি দেশ চলতে পারে না। মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই সম্পন্ন হল আস্তর্জাতিক নারী দিবস। এই নারী দিবসে সমাজের, রাষ্ট্রের অঙ্গিকার ছিল নারীদের সুরক্ষা দেয়ার।
প্রিয় সোহাগী, অনেক কথা বলার ছিল, বলতে পারছি না, লেখার ছিল লেখতেও পারছি না। কেন যে পারছি না সেটাও জানাতে পারছি না। এটা আমার, আমাদের দুর্ভাগ্যজনক সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতার জন্য ক্ষমা চাই সোহাগী তোমার কাছে।
আর মাত্র ২ দিন পরেই আমরা মহা আনন্দে পালন করব আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন দিন স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। দেখতে দেখতে ৪৫টি বছর কেটে গেল। কিন্ত স্বাধীনতার মূল যে চেতনা সেই চেতনা আজো আমরা খুঁজে বেড়াই। সেই চেতনা যদি থাকত তাহলে আজ সোহাগী জাহান তনুকে এভাবে চলে যেতে হতো না। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও ২ লাখ মা বোনের ইজ্জ্বতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যে লাল সবুজ পতাকা আমরা পেয়েছিলাম সেই পতাকা কেন বিজয়ের ৪৫ বছর পরেও আমাদের নারীদের সুরক্ষা দিতে পারছে না। একটা স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশে একজন নারী কতটুকু নিরাপদে বসবাস করছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের মেধাবী ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর অকালে জীবন চলে যাওয়া এ লেখায় তার সর্বশেষ উদাহরণ হয়ে থাকবে।
সোহাগী, নর্দমার পাপিষ্ট কীটরা তোমাকে যেখানে পাঠিয়ে দিয়েছে, আমরা দোয়া করি মহান আল্লাহ যেন তোমাকে সেখানে ভাল রাখে। তুমিও আমাদের এই পাপেধরা অবক্ষয় সমাজের জন্য দোয়া করিও, আর যেন তোমার মত সোহাগী জাহান তনুকে এভাবে বড্ড অসময়ে চলে যেতে না হয়। সমাজ এবং রাষ্ট্রের যেন বোধোদয় ঘটে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর