পুকুরে শিং মাছের চাষাবাদ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পুকুরে শিং মাছের চাষাবাদ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ মৎস্য চাষিদের ভালোভাবে জেনে রাখতে হবে। বর্তমান সময়ে প্রাকৃতিক উৎসে মাছের উৎপাদন কমায় পুকুরে মাছ চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। পুকুরে চাষের জন্য অনেকেই এখন শিং মাছ বেছে নিচ্ছেন। এর অন্যতম কারণ শিং মাছ চাষে লাভ বেশি পাওয়া যায়। তবে সঠিক চাষাবাদ পদ্ধতি না জানার কারণে অনেকেই লোকসানে পড়ছেন। চলুন আজ জানবো পুকুরে শিং মাছের চাষাবাদ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ সম্পর্কে-

পুকুরে শিং মাছের চাষাবাদ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শঃ

শিং চাষের সুবিধাঃ

শিং মাছ সুস্বাদু এবং বাজার চাহিদা অনেক বেশি। ডোবা, ছোট ছোট পরিত্যক্ত পুকুর এবং পরিকল্পিত পুকুরে চাষ যোগ্য। অন্যান্য মাছের তুলনায় কম খাদ্যে বাঁচে। সাধারণ প্রতিকূল অবস্থা কাটাতে পারে। হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন করা যায়। সম্পূরক খাবারে সহজে অভ্যস্ত। একক এবং মিশ্র চাষ করা যায়।

পুকুর প্রস্তুতিঃ

সাধারণত ৩০-৫০ শতাংশের পুকুরে শিং চাষ অধিক উপযোগী,তবে এক একরের পুকুরেও চাষ করা যায়। প্রথমে পুকুরের পানি সেচ দিয়ে শুকিয়ে পুকুরের তলদেশে রোদ লাগাতে পারলে ভালো হয়। এ সময় পাড় কাটা পুকুরের ক্ষেত্রে নিজেদের মনের মতো পুকুর প্রস্তুত করা যায়। শুকানো সম্ভব না হলে পানিপূর্ণ পুকুরে প্রথমে রোটেনন ট্যাবলেট ব্যবহার করা যায়। ট্যাবলেট প্রয়োগে অবাঞ্ছিত ও রাক্ষুসে মাছ অপসারণ বেশি কার্যকর।

পরে প্রতি শতাংশে এক কেজি হারে চুন প্রয়োগের মাধ্যমে পুকুর প্রস্তুতির মূল কাজ শুরু করা হয়। প্রয়োগের পর প্রতি শতকে ২৫০ গ্রাম শিং ব্রাইট গোল্ড (দানাদার) প্রয়োগ করলে পানির রং স্থির থাকবে। এরপর প্রতি শতাংশে পাঁচ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম টিএসপি একত্রে গুলে প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পাঁচ থেকে ছয় দিন পর শিং মাছের ২ ইঞ্চি থেকে ৩ ইঞ্চি সাইজের পোনা মজুদ করা যাবে।

পোনার পরিমাণঃ

একক চাষে শিং মাছ প্রতি শতাংশে ৫০০ থেকে ১ হাজার পোনা ছাড়া যায়। এক্ষেত্রে পোনা ছাড়ার আগে এবং পরে পুকুরের পানির গুণাগুণ রক্ষা করতে হবে। পানি পরিবর্তনের সুযোগ না থাকলে পোনা কম ছাড়া ভালো। মিশ্র চাষে মাগুর এবং কৈ মাছের সঙ্গেও শিং মাছ ভালো হয়। এক্ষেত্রে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যবান পোনা অপরিহার্য।

মাছের খাদ্যঃ 

শিং মাছের জন্য অধিক প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার সরবরাহ ভালো। শিং মাছ পুকুরের তলদেশের জলজ কীট খেয়ে থাকলেও লাভজনক চাষে মানসম্মত সম্পূরক খাবার (কমপক্ষে ৩২ ভাগ প্রোটিনসমৃদ্ধ) অপরিহার্য। এক্ষেত্রে কারখানায় প্রস্তুতি মানসম্মত খাবার উত্তম,তবে মানসম্মত ভাসমান খাবার প্রয়োগেরও শিং চাষ করা যায়। এক্ষেত্রে পুকুরের তলদেশের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রক্ষা করা যায়।

মেয়াদকালঃ

মানসম্মত পোনা,সুষম খাবার এবং আদর্শ চাষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে ছয় থেকে সাত মাসে প্রতিটি শিং মাছ ৬০ থেকে ৭০ গ্রাম হয়ে থাকে। এ সময়ের মধ্যে নিয়মিত পানির গুণাগুণ আদর্শমাত্রায় রক্ষা করা গেলে আরও ভালো ফল প্রত্যাশা করা যায়।

আদর্শ সময়ঃ

এপ্রিল-মে মাস থেকে এ মাছ চাষ শুরু করা যায়। যারা আগের বছরের শেষ দিকে নার্সিংয়ে চাপে পোনা রাখেন,তারা ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকে পরিকল্পিত চাষ শুরু করতে পারেন। তবে প্রতি বছরে মে-জুন থেকে পোনাপ্রাপ্তি সুবিধা হয়।

পরিচর্যাঃ

শিং মাছ চাষে অনেক বেশি পানি দরকার হয় না। পোনা নার্সিংয়ের সময় ২ থেকে ২.৫ ফুট পানিই যথেষ্ট,পরে ৩ থেকে ৩.৫ ফুট পানিতে শিং মাছ চাষ করা যায়। পোনা ছাড়ার পর নিয়মিত ও পরিমিত খাবার দিতে হবে। মোট খাবারকে দুই থেকে তিনবারে ভাগ করে দেয়া ভালো। হ্যাচারি থেকে নেয়া ছোট পোনা সরাসরি চাষে না দিয়ে আলাদা নার্সিং করে ২ ইঞ্চি থেকে ৩ ইঞ্চি হলে চাষ পুকুরে দেয়া উত্তম।

পুকুরের পানির গুণাগুণ এবং তলদেশের পরিবেশের ওপর শিং মাছের বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণেই পানির গুণাগুণ রক্ষা করা আবশ্যক। প্রতি মাসে একবার শিঙাইট ও প্রোবায়োটিঙ্রে সমন্বয়ে ‘অ্যাকোয়া ম্যাজিক প্লাস’ একবার প্রয়োগ করলে পুকুরের তলদেশ এবং পানির গুণাগুণ রক্ষা করতে সহায়ক হবে।

কখনও কখনও পোনার ত্বক ও ঠোঁটে তুলার মতো সাদা দাগ দেখা দিতে পারে। সেপ্রোলেগনিয়া নামক ছত্রাকের জন্য এমনটি হয়। এক্ষেত্রে প্রতি একরে প্রতি ৩ ফুট পানির জন্য ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিলিটার ‘পলগার্ড প্লাস’ পরপর দুই দিন দুই ডোজ ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যাবে। তাছাড়া ফরমালিন বা ম্যালাকাইট গ্রিনের মাধ্যমেও চিকিৎসা করা যায়।

পরজীবী বা প্রোটোজোয়া কর্তৃক শিং মাছ আক্রান্ত হলে ডেলেটিঙ্ প্রয়োগে চমৎকার সুফল পাওয়া যায়। বেশি খাবার প্রয়োগ বা জৈব পদার্থের পচনের মাধ্যমে পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাসের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, এ অবস্থায় মাছ মারা যেতে পারে খুব দ্রুত। এ সমস্যা দূরীকরণে প্রতি একরে ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম গ্যাসোনেঙ্ প্লাস সারা পুকুরে (বালির সঙ্গে মিশিয়ে) ছিটিয়ে দিলে তাৎক্ষণিক সুফল পাওয়া যায়। একই সঙ্গে পানি পরিবর্তন করে দিতে পারলে ভালো হয়। মূলত অ্যামোনিয়াজনিত সমস্যাই শিং মাছের চাষে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক।

মানসম্মত খাবার ছাড়া শিং চাষ লাভবান হয় না। প্রাণিজ প্রোটিন হিসেবে মিট অ্যান্ড বোন মিলের ব্যবহারের পরিবর্তে ভালো মানের ফিশমিল ব্যবহার করা আবশ্যক। খাবারের সঙ্গে দ্রুত হজমের জন্য ‘বায়োজাইম’ এবং গ্রোথ প্রোমোটর প্রয়োগ করলে অত্যন্ত ভালো ফল লক্ষ করা যায়। শিং মাছের পুকুরের মধ্যে বা একপাশে বাঁশের বেষ্টনীর মধ্যে কিছু কচুরিপানা রাখা গেলে পানির পরিবেশ এবং শিং মাছের জন্য উপযোগী হয়।

রোগ প্রতিরোধ করার জন্য চাষকালীন সময়ে দ্বিতীয় মাস থেকে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পলগার্ড প্লাস অথবা পন্ড সেফ,দ্বিতীয় সপ্তাহে গ্যাসোনেঙ্ প্লাস এবং তৃতীয় সপ্তাহে অ্যাকোয়া ম্যাজিক প্লাস প্রয়োগ করলে রোগমুক্ত মাছ চাষ করা সম্ভব। মাঝে মধ্যে মাছের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা আবশ্যক।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর