সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল! সারা রাত অঝোরে বৃষ্টি পড়েছে। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের পুরনো অনুভূতির স্পর্শ পেতে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। ফলে ঘুমের বারোটা বেজে গেল। তার ওপর সারা দিনের ক্লান্তিকর জার্নি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, তারপর খাগড়াছড়ি হয়ে বোয়ালখালী- প্রায় আঠারো ঘণ্টা জার্নি করেছি। তাও আবার ভেঙে ভেঙে আসতে হয়েছে।
আগেই কথা বলে রেখেছিলাম, মোটরসাইকেল চালক আশরাফুলের সঙ্গে। বোয়ালখালী বাস টার্মিনালে এমন মোটরসাইকেল অনেক পাওয়া যায়। আনোয়ার ফোন দিতে দিতে হয়রান হয়ে শেষে দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু করলে ঘুম ভাঙল আমার। বেশ আন্তরিক চালক আশরাফুল। যতবার গিয়েছি প্রয়োজনে একমাত্র তাকেই সঙ্গে নিয়েছি।
মাল্টা বাগানে গাছে ঝুলছে অজস্র মাল্টা
স্থানীয় তুষার বাবুর বাগানের কথা আগের বার গিয়ে জেনেছিলাম। বোয়ালখালী বাজার থেকে মোটরসাইকেলে যাওয়া যয়। সচরাচর বাহন হিসেবে রয়েছে পাহাড়ি এলাকার বহুল প্রচলিত চান্দের গাড়ি। কিন্তু ওই গাড়ির সঙ্গে সিডিউল মেলানো ভারি কষ্টকর! সুতরাং পা অথবা মোটরসাইকেলই ভরসা। ছায়া সুনিবিড় শান্ত পাহাড়ের মাঝ দিয়ে পথ। দুই পাশে এক, দুই, তিন করে ছেড়ে যাই বেশ কয়েকটি পাড়া। কিছু দূর পর থেকে মূল সড়ক ছেড়ে গ্রামের মাঝ দিযে মেঠো পথ।
আর কত দূর আশরাফুল? সহযাত্রীকে প্রশ্ন করতেই ‘তেষ্টা পেয়েছে, আসেন আগে চা-পানি খেয়ে নেই তারপর যাওযা যাবে’ বলে সে সাইকেল থামাল। পাড়ার মুখে ছোট্ট দোকান। জানালা দিয়ে চলে বিকিকিনি। চাকমা বৃদ্ধা অনেকটা সময় নিয়ে যত্ন করে চা বানালেন। সাথে নিলাম একটি করে বেলা বিস্কুট ও বুনো কলা। চুমুক দিতেই গা-মাথা গুলিয়ে উঠল। চা তো নয় যেন মিছরির শরবত! বৃদ্ধা আগ্রহ ভরা নয়নে মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন- চুমুক দেয়ার পর কেমন লাগে তা দেখতে।
দেখতে প্রায় এক রকম হলেও বাগানে মাল্টার পাশাপাশি কমলালেবু গাছও রয়েছে
খানিক পথ যাওয়ার পর আশরাফুল বলল, ওই দেখেন পাহাড়ের উপর বাগান।
আমি তাকিয়ে দেখলাম। বাগানের প্রবেশদ্বার পেরিয়ে সেখানে কর্মরতদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। মনে হলো তারা যেন আমাদের আসার সংবাদ আগেই পেয়েছেন। ২০-২৫ একর পাহাড়জুড়ে ফলজ বাগান। উন্নত প্রজাতির আম, কাঁঠাল, লিচু, আমড়া, লটকন থেকে শুরু করে কমলালেবু, মাল্টা, মুসুম্দী, আঙুর ও অন্যান্য অনেক প্রকার ফলের গাছ রয়েছে। বাগানের ভেতরে প্রত্যেকটি ফলের জন্য রয়েছে আলাদা একটি করে বাগান। একজন অভিজ্ঞ সার্বক্ষণিক শ্রমিক একে একে ঘুরে দেখালেন বেশ কয়েকটি বাগান।
দেখলাম অধিকাংশ ফল গাছ সাধারণত পাহাড়ে জন্মে না। জন্মালেও আশানুরূপ ফলবান হয়ে ওঠে না। কিন্তু দীর্ঘ প্রচেষ্টায় বাগানের উদ্যোক্তা তুষার বাবু সে ধারণা পাল্টে দিয়েছেন। সিলেট বিভাগের কিছু জায়গায় স্বল্পমাত্রায় কমলালেবুর চাষ হলেও বাণিজ্যিকভাবে দেশের কোথাও আঙুর চাষ এখনও শুরু হয়নি। সেই পরিস্থিতিতে মাল্টা, মুসুম্দীর মতো একেবারেই ভিনদেশী ফল উৎপাদনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে শুভ সংবাদ। গাছে ধরে রয়েছে কমলালেবু, মাল্টা ও মুসুম্দী। কাঁচা অবস্থায় সব প্রায় একই দেখায়। ভালো করে দেখতে চাইলে তিনি বলেন, সমস্যা নেই স্পর্শ করে দেখতে পারেন। ভাবতেই ভালো লাগল, আমাদের দেশের মাটিতে নানান সব ভিনদেশী ফলের চাষ হচ্ছে!
পথের পাশে জুমঘরে পাহাড়ি নারী
নিকটেই একটি আম গাছে পরজীবী লতাপাতার থোকায় গিয়ে চোখ থেমে গেল। একেকটি শিষে ধরে রয়েছে বেঁতের ফলের মতো গোল গোল গাঢ় সবুজ গোটা। প্রত্যেকটি শিষ উপুর হয়ে ঝুলে রয়েছে। আগ্রহের চাহুনি লক্ষ করে অভিজ্ঞ শ্রমিক বললেন, গোলমরিচ।
পরীক্ষামূলক পর্বে সফলতা এসেছে। আগামীতে গোলমরিচের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে আলাদা একটি অংশ। এই মশলার নামের সাথে জড়িয়ে রয়েছে পারস্য, কাশ্মির অথবা মালয় দ্বীপপুঞ্জের নাম। আজ সেই মশলা উৎপাদনের উদ্যোগ আমাদের দেশেও শুরু হয়েছে। আসলে সঠিক পদ্ধতিতে উপযুক্ত জাত নির্ধারণের মাধ্যমে এ দেশে অনেক কিছুই চাষ করা সম্ভব। কারণ এখানকার মাটিতে রয়েছে এক অসাধারণ উৎপাদন শক্তি।
বাগানের বেশ বড় এক অংশ ঘুরে দেখার পর টিনের চালার নিচে এসে লক্ষ করলাম, আমাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। টেবিলে কয়েকটি পিরিচে পাকা পেঁপে, আমড়া, মুসুম্দী ও পেয়ারা কেটে রাখা। নেই ফর্মালিন, নেই অন্যান্য প্রিজার্ভেটিভ, গাছ থেকে পেড়ে আনা টাটকা ফল! বেশ কয়েক বছর আগে বাগানের শুরু, বর্তমানে দেশে ফলজ বাগানের মধ্যে অন্যতম দৃষ্টান্ত তুষার বাবুর বাগান। এটি এখন পর্যটক আকর্ষণের একটি স্পট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা বাগানটি দেখতে আসছেন।
দুইদিন পর গিয়ে উপস্থিত হলাম দিঘীনালা বনবিহারের সদর দরজায়। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত আশ্রম ও মন্দীরের দরজা থেকে মন্দীর গৃহ পর্যন্ত পৌঁছতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল। পথের দুই পাশে লাগানো হরেক প্রকার বৃক্ষ থেকে পাতা ঝরছে অনবরত। উভয় পাশে পাহাড়ের ঢালু গায়ে ঘন অরণ্যের মাঝ থেকে ক্ষণেই ডেকে যায় অপরিচিত পাখি। সাজানো বাগানে ধরেছে অজস্র ফুল। নিরিবিলি পরিবেশ, মাঝেমধ্যে কেবল দুই-একজন গেরুয়া পোশাকী ভিক্ষু-শ্রমনের পায়চারী।
ঢালু পথে এগিয়ে ডান পাশেই মহামতি বুদ্ধের বড়সর একটি মূর্তি। সামনে রাখা ফুল পাপড়ি আর আগরবাতির সুগন্ধ চারিদিকে। অতঃপর সামান্য উঁচু পথ মাড়িয়ে দৃষ্টি কাড়ে চীনের দালানের আদলে নির্মিত মন্দীরের শীর্ষদেশ। তার মাঝে বুদ্ধের ২৩ ফুট উঁচু একটি মূর্তি। এক সময় দেশের বৃহত্তম মূর্তিগুলোর মধ্যে একটি বলে এটি গণ্য হতো।