কেন এই নিঃসঙ্গতা, কেন এই মৌনতা ? …পার্থ বড়ুয়ার গাওয়া সোলসের এই গানটি আমাদের অনেকেরই প্রিয়। মাঝেমাঝেই আমরা সবাই কম-বেশি নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্বে ভুগি। আসুন, জেনে নেই নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব কাটানোর বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে।
আশেপাশে তাকালে আমরাদেখতে পাই প্রত্যেকে প্রচণ্ড ব্যস্ত, কম্পিউটার, ফেসবুক, অনলাইন চ্যাটিং, টিভি, মোবাইল, বাইরে আড্ডা, রাতের পার্টি, ক্লাসে পড়াশোনার চাপ, অ্যাসাইনমেন্ট, দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি। এ সব কিছুর মধ্যে আমরা হারিয়ে ফেলেছি মা-বাবা, ভাইবোন- সবাই একসঙ্গে টেবিলে বসে খাওয়া, গল্প করা, হাসাহাসি। আমরা এখন ক্লাসে বা কাজে যাওয়ার পথে রাস্তায়, ক্লাসের ফাঁকে কিছু একটা খেয়ে নিই। টেকনোলজি আমাদের সব কাজ এত সহজ করে দিয়েছে যে একেবারে হাতের মুঠোয় পৃথিবীকে এনে দিয়েছে। কিন্তু তারই আড়ালে কেড়ে নিয়েছে আমাদের আত্নিক সম্পর্কগুলো। আর উপহার দিয়েছে আমাদের ‘মা’ পর্যায়ের শ্রেণীকে একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা ও ভয়াবহতা। একাকিত্বের সঙ্গে ডিপ্রেশন বা মন খারাপ রোগের খুবই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। যাঁরা একাকি জীবন যাপন করেন, তাঁদের মধ্যে আরো কিছু ফলাফল লক্ষণীয়। এদের মধ্যে অন্যের সানি্নধ্যে যাওয়ার অথবা নৈকট্য পাওয়ার প্রতি ভীতি জন্মে যায়। যেমন- ‘ছেলের সঙ্গে এখন কথা বলতে চেষ্টা করলে ও রেগে যাবে হয়তো।’ নিজের আত্মমর্যাদাবোধ নিচে নেমে যায়। একাকিত্ব নিম্ন আত্মমর্যাদার জন্ম দেয়, আবার এই নিম্ন আত্মমর্যাদার কারণে সে তার একাকিত্বের চক্র ভেঙে বের হয়ে আসতেও পারে না। একাকী ব্যক্তির মধ্যে সামাজিক দক্ষতাগুলোর ঘাটতি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। সামাজিকতার ভয় পায় এবং লজ্জাও পেতে পারে। এদের মধ্যে সমাজের অন্য মানুষের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠতে থাকে।
কিন্তু সবই তো বুঝলাম, সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত, কী করে নিঃসঙ্গতা কাটাব?
প্রথম কথা, যেহেতু এই একাকিত্বটি আমাদের সমাজের প্রবহমানতার একটি ফল। তাই এর সমাধান খুব সহজ নয়। কখনো ভালো সময় যাবে- যখন একাকিত্বকে আপনার আশপাশে খুঁজেই পাবেন না। আবার কখনো মন্দ সময় যাবে- যখন একাকিত্ব আপনাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করবে। অর্থাৎ পরিস্থিতির সঙ্গে অনিবার্যভাবে এর একটি ওঠানামা চলবে।
* সাধারণত আমরা বই পড়ে, গান শুনে, পছন্দের টিভি চ্যানেল বা সিনেমা দেখে একা সময় কাটাই। সময় পার করে দেওয়ার জন্য উল্লিখিত কাজগুলো কার্যকর হলেও দূরবর্তী ফলাফল চিন্তা করলে দেখা যায় যে নতুন কোনো বন্ধু বা সম্পর্ক তৈরিতে এগুলো তেমন কোনো কাজে দেয় না। এগুলো হচ্ছে মানুষের নীরব বন্ধু এবং একপক্ষীয়। যার সঙ্গে ব্যক্তির নিজের কোনো ভাব বিনিময় হয় না। অর্থাৎ দ্বিপক্ষীয় কোনো ভাব বিনিময়ের রাস্তা থাকলে আরো ভালো। তার পরও অনেকেই বই, গান, পত্রিকা, টিভির মধ্যেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
* নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক আত্মধারণাগুলোকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেবেন না। যেমন- আমি হয়তো সুন্দর করে কথা বলতে পারব না, মানুষ আমার প্রতি বিরক্তি বোধ করবে, যোগাযোগ রাখার মতো তেমন কোনো দক্ষতা বা গুণ আমার নেই, আমাকে অন্যদের কাছে আকর্ষণীয় বা হাস্যরসিক বা জ্ঞানী হতে হবে নতুবা আমাকে কেউ পাত্তা দেবে না ইত্যাদি। নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক চিন্তা করুন। আপনার যতটুকু দক্ষতা আছে, তাই কাজে লাগান। ফলাফল ভালো হবে না মন্দ হবে- সে চিন্তা পরিস্থিতির হাতে ছেড়ে দিন।
* ভয়, লজ্জা, টেনশন ইত্যাদির কারণে কোনো সামাজিক ঘটনা বা পরিস্থিতি এড়িয়ে যাবেন না।
* প্রয়োজনে আপনি সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিশেষ ব্যক্তিদের সাহায্য নিতে পারেন।
* আপনার নিজস্ব পৃথিবীর গণ্ডিটা বাড়ানোর চিন্তা করুন। অর্থাৎ প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। বনু্ল ও পরিচিতদের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিন। এদের সঙ্গে দিনের একটা সময় একসঙ্গে বসে কিছু গল্পগুজব করে নিজেকে ভালো রাখতে পারেন। এদের সঙ্গে করে বাইরে ঘুরতে যেতে পারেন, বাজার করতে পারেন। সপ্তাহের যেকোনো একটা দিন এদের কারো বাসায় কিছুএকটা রান্না করে (খুব সামান্য কিছুও হতে পারে, যেমন- ঝালমুড়ি) সবাই একসঙ্গে মজা করে খেলেন।
* দিনের নির্দিষ্ট কোনো সময়ে ফোনে আত্মীয়স্বজন বা অন্যদের খোঁজখবর নিতে পারেন। এতে আপনার প্রতি তাদের মনোভাব বদলাবে। তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের গভীরতা কখনো হালকা হবে না এবং সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আপনার যোগাযোগ দক্ষতা বাড়বে।
নিজেকে এমন একজন নিরপেক্ষ বন্ধু বা মানুষ হিসেবে অন্যের কাছে উপস্থাপন করতে পারেন, যাতে তারা তাদের সুখ-দুঃখের কথা অকপটে বলতে পেরে নিরাপদ বোধ করে। এতে আপনি তাদের কাছে খুব ভালো এবং প্রয়োজনীয় একজন মানুষ হিসেবে স্থান পাবেন।
* যারা অনেক ব্যস্ত, তাদের ব্যস্ত থাকতে দিন। সময় হলে তারা নিজেরাই যেন আপনার কাছে আসে সেই সুযোগ তৈরি করুন। তাদের পেছনে আপনার ঘোরার দরকার নেই, তাদের কারণে নিজের মন খারাপ করারও দরকার নেই।
* এই একাকী মানুষের জন্য আমাদের পরিবার-পরিজনের কিছু দায়িত্ব এবং কর্তব্য আছে। যা হয়তো আমরা ভুলেই যাই। আপনারা সারা দিন যে যেখানেই থাকেন না কেন, যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, বাড়ি ফিরে ওই একা মানুষটির কাছে কিছুক্ষণ বসুন। সারা দিন তিনি কী করলেন, কেমন আছেন তিনি, কোনো সমস্যা বা কষ্ট আছে কি না- খোঁজ নিন। আপনাদের সারা দিনের বিশেষ কোনো ঘটনা থাকলে তাঁর সঙ্গে গল্পের মাধ্যমে জানান। ব্যস, এতেই দেখবেন তিনি খুশি হবেন, সন্তুষ্ট থাকবেন- সারা দিনের একাকিত্ব এক নিমিষেই ভুলে যাবেন।
বি.দ্র: অনেকে নিঃসঙ্গতায় দেখা যায় অতিরিক্ত চা, পান ইত্যাদির প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এগুলো থেকে কোনো অসুখ-বিসুখের জন্ম হতে পারে। তাই নিজের প্রতি লক্ষ রাখুন।