হাওর বার্তা ডেস্কঃ ডিজিটাল দুনিয়ার সুবিধা পাচ্ছে তৃণমূলের মানুষও। শহর-বন্দর ছাড়িয়ে ইন্টারনেট এখন গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর বড় অংশ কিশোর-তরুণ। এতে কিছু সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। কিশোর-তরুণদের একটা বড় অংশ পাবজি, ফ্রি-ফায়ার খেলার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। টিকটক তৈরির হিড়িকও আছে। ইন্টারনেট গেমসের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে অনেকে অপরাধ জগতেও ঢুকছে। কিশোর-তরুণদের ইন্টারনেট গেমস থেকে দূরে রাখতে সাইট-অ্যাপ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তবে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইট-অ্যাপস বন্ধ করলেও ইন্টারনেট গেমস বন্ধ রাখা যাবে না। অভিভাবকদের সচেতনতাই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে পারে।
সম্প্রতি দেশের সব অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে টিকটক, বিগো লাইভ, পাবজি, ফ্রি-ফায়ার গেম ও লাইকিসহ ক্ষতিকর সব খেলা ও অ্যাপস অপসারণ এবং সব লিংক তিন মাসের জন্য বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কিন্তু সেটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাইকোর্টের আদেশ এখনো তাদের কাছে পৌঁছায়নি। অপরদিকে, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইট-অ্যাপ বন্ধ করলেও ইন্টারনেট গেমস খেলা বন্ধ রাখা যাবে না। কারণ ভিপিএন, ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করে এসব খেলা চলবেই। ডিভাইসের ‘প্যারেন্টাল গাইডেন্স’ জানা ও ব্যবহার করার পাশাপাশি অভিভাবকদের ডিজিটাল দক্ষতা বাড়ানোই এর প্রকৃত সমাধান বলে মনে করেন তারা।
১৬ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার হাইকোর্ট বেঞ্চ ইন্টারনেটের গেমস বিষয়ে একটি আদেশ দেন। আদালত অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনার পাশাপাশি রুল জারি করেন। মানবাধিকার সংগঠন ‘ল অ্যান্ড লাইফ’ ফাউন্ডেশনের পক্ষে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির পল্লব এবং ব্যারিস্টার মোহাম্মদ কাউছারের করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেওয়া হয়। বিবাদীদের প্রতি আইনি নোটিশ দেওয়ার পরও কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ২৪ জুন হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ মো. রাসেল চৌধুরী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল গোলাম সরোয়ার পায়েল। বিটিআরসির পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার খন্দকার রেজা-ই-রাকিব।
হাইকোর্টের রুলে সব অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে টিকটক, বিগো লাইভ, পাবজি, ফ্রি-ফায়ার গেম ও লাইকিসহ ক্ষতিকর সব খেলা ও অ্যাপস অপসারণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অবিলম্বে সব লিংক বন্ধের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না। এ ছাড়া ওই সব অ্যাপস ও গেমের মাধ্যমে কি পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়েছে তা নিরূপণ, ওই অর্থ লেনদেনে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কেন যথাযথ আইনি পদক্ষেপ এবং ক্ষতিকর গেমস ও অ্যাপস বিষয়ে তদারকি ও গাইডলাইন তৈরি করতে কমিটি গঠনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব, শিক্ষা সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, স্বাস্থ্য সচিব, বিটিআরসির চেয়ারম্যান, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজি), বাংলাদেশ ব্যাংক, সব মোবাইল অপারেটর, বিকাশ ও নগদকে ১০ দিনের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
রিট আবেদনে ওই সব অ্যাপস ও গেমের আড়ালে শত শত কোটি টাকা পাচার এবং লেনদেনে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়। পাশাপাশি ক্ষতিকর গেমস ও অ্যাপস বন্ধে বিটিআরসিকে নিয়মিত সুপারিশ করতে প্রযুক্তিবিদ, শিক্ষাবিদ ও আইনজীবী সমন্বয়ে কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়।
এ বিষয়ে বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র যুগান্তরকে বলেন, হাইকোর্টের আদেশ এখনো আমরা হাতে পাইনি। টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রিকায় বিষয়টি দেখেছি। আদেশটি এলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার যুগান্তরকে বলেন, পত্রিকায় পড়েছি হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছেন। এগুলো বন্ধ এবং কোনটা ক্ষতিকর ও কোনটা ক্ষতিকর নয় তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কমিশন গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করার কোনো সুযোগ নেই। হাইকোর্টের রায়ের কপি এলে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
স্বনামধন্য প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার বলেন, এ গেম নতুন কিছু নয়। আমরা যখন ডিজিটাল প্রযুক্তি যুগে ছিলাম না তখনও ছেলেমেয়েরা খেলেছে। এটাই প্রত্যাশিত, এটাই চিরায়ত। মাঠের খেলার পাশাপাশি এক সময় সেটা ঘরেও এসেছে। এখন অনলাইন একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। গেমস খেলার সুযোগও তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, ইন্টারনেট গেমস ঘিরে কিশোর-তরুণদের মধ্যে নেশা তৈরি হয়েছে। কিন্তু মাথা ব্যথা বলে মাথা কেটে ফেলবেন এটা সমাধান হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। কিন্তু এখন সেটাই ঘটছে। আমরা বোধহয় মাথা কাটাকেই পছন্দ করছি। ওয়েবসাইট বা অ্যাপস বন্ধ করার প্রযুক্তি আমি সংগ্রহ করেছি। এটা দিয়ে আমি কোনো সাইট বন্ধ করতে পারি, অ্যাপসও বন্ধ করতে পারি। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া আমি কন্ট্রোল করতে পারি না। আমাকে বন্ধ করতে বলা হলে-এ সাইট বা অ্যাপসগুলো আমরা বন্ধ করে দিতে পারব। এটি বন্ধ করার অর্থ হলো-অ্যাপসগুলো বাংলাদেশে আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমাদের এ অনলাইন দুনিয়াতে ভিপিএন আছে, ডার্ক ওয়েভ আছে। সেগুলো কেউ চাইলে বা না চাইলেও ছেলেমেয়েরা এর সঙ্গে যুক্ত হবে। তারা খেলা চালিয়ে যাবে। প্রশ্ন আসতে পারে- তাহলে ভিপিএনও বন্ধ করে দেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমি পাইকারি হারে সবকিছু বন্ধ করে দিলে জীবন চালাতে পারব না। ভিপিএন অনেক প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহৃত হয়। ফলে এটি বন্ধ করে দিলে অনলাইন জগত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আদালত যে নির্দেশনা দেবে সেই অনুযায়ী হয়তো অ্যাপ বন্ধ করা, সাইট বন্ধ করা যাবে। কিন্তু ছেলেমেয়েদের এসব খেলা থেকে দূরে রাখা যাবে না। এর আগেও একবার আমরা পাবজি বন্ধ করেছি। কিন্তু বন্ধ করার পরও আমরা লক্ষ্য করেছি একটু কমেছে। সাধারণ ছেলেমেয়েরা খেলেনি। কিন্তু পাবজি খেলা বন্ধ হয়নি। ফ্রি-ফায়ার খেলাও বন্ধ হবে না।
অভিভাবকদের ডিজিটাল অদক্ষতার কারণে বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে মন্তব্য করে এর সমাধানে প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমাদের দেশের বেশিরভাগ অভিভাবক ডিজিটালি দক্ষ নন। সেটা না থাকাতে এটি এখন ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেট ও ডিভাইসের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের নানা টুলস আছে। প্রতিটি ডিভাইসের সঙ্গে অপারেটিং সিস্টেমে ‘প্যারেন্টাল গাইডেন্স’ অপশন থাকে। ‘প্যারেন্টাল গাইডেন্স’ হলো-ছেলেমেয়েরা কি পরিমাণ সময় এ ডিভাসে কাটাতে পারে, কোথায় কোথায় যেতে পারে, কোন কোন সাইটে যেতে পারে, কতক্ষণ থাকতে পারে সেটা সম্পূর্ণভাবে মনিটর করার ব্যবস্থা। বিটিআরসি প্রতিটি আইএসপি থেকে শুরু করে যারাই অনলাইন জগতে আছে তাদের প্যারেন্টাল গাইডেন্স দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু সমস্যা হলো-এটি যাদের ব্যবহার করার কথা তারা সেটি অদক্ষতার কারণে ব্যবহার করতে পারছেন না। অভিভাবকদের সচেতনতাই এই পরিস্থিতি থেকে সবাইকে উদ্ধার করতে পারে। আমরাও তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ডিজিটাল দক্ষতা বাড়াতে কি করা যায় সেই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি।