নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনাসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমের বিশাল জনগোষ্ঠীর মাছের চাহিদা পূরণে বড় উৎস চলনবিল। দেশি মাছের বিপুল সম্ভার এই বিশাল জলাভূমি। তবে এই চিত্র অতীত হয়ে গেছে। নাব্যতা হারিয়েছে চলনবিল। নির্বিচারে পোনা ও মা মাছ নিধন, সুতি ও কারেন্ট জালের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং শুষ্ক মৌসুমে বিলের জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় দেশি মাছের এই বিশাল ভাণ্ডার এখন তলানিতে।
চলনবিলের এখন বড় বৈশিষ্ট্য দিগন্ত জুড়ে কেবলই সবুজ ধানের ক্ষেত। মাঝে মধ্যে ডোবার মতো খণ্ড খণ্ড অংশে পানি থাকলেও তাতে মাছ থাকার সুযোগ কম। এমনই একটি অংশের নাম হালতি বিল। নাটোর সদর ও নলডাঙ্গা উপজেলার অংশ বিশেষ জুড়ে এর অবস্থান। কিছু দিন আগে পর্যন্ত এখানে ছিল বৃহত্তর চলন বিলেরই চিত্র। জলাশয় থাকলেও মাছের সংকট তীব্র। গত পাঁচ বছরে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। হালতি বিলকে মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলায় এখানে দেশি মাছের প্রাচুর্য ফিরেছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ও জেলেদের উদ্যোগে একইভাবে অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কিছু নদীতেও। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় মৎস্য আবাসন পুনরুদ্ধার প্রকল্পের আওতায় নাটোর সদর উপজেলার বারণই নদীতে দুটি, চলনবিল মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নাটোর সদর উপজেলার নন্দকুজা ও মরা আত্রাই নদীতে পাঁচটি, বড়াইগ্রাম উপজেলায় মরা বড়াল নদে চারটি, সিংড়া উপজেলায় আত্রাই নদীতে চারটি, গুরুদাসপুর উপজেলায় নন্দকুজা ও আত্রাই নদীতে দুটি অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া নাটোরের পশ্চাৎপদ এলাকা হিসেবে সদর উপজেলার বারণই নদী ও টাংগীতে দুটি, বড়াইগ্রাম উপজেলার ছাতিয়ানগাছায় একটি, সিংড়া উপজেলার গুরনদী-বড়দহ ও ডাঙ্গাপাড়া মরা নদীতে দুটি, লালপুর উপজেলার বড়াল নদীতে একটি করে অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে। মূল লক্ষ্য এসব অভয়াশ্রমে মা মাছ ডিম দেবে এবং মাছের প্রজনন বাড়বে। ফলে চলন বিল ও হালতি বিলে মাছের পরিমাণ বাড়বে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নাটোর জেলা শহর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে ত্রিমোহিনীর হালতি বিলে চোখে পড়ে জেলে নৌকায় মাছ শিকারের ব্যস্ততা। জেলেরা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে দলে দলে ভাগ হয়ে মাছ ধরছে। পুঁটি, টেংরা, পাবদা, খয়রা, শোল, বোয়াল, শিং, কৈ, মাগুর, ফলি, কাতল, রুই, মৃগেল, চিতল ইত্যাদি নানা প্রজাতির দেশি মাছে পূর্ণ বিলটি। ফলে এই জলাধার এলাকার জেলেদের আয়-রোজগারের অন্যতম ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে। স্থানীয় হাটবাজারেও কমে এসেছে মাছের দাম। ফলে ধনী-দরিদ্র সবাই মাছের স্বাদ নিতে পারছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৃহত্তর চলন বিলের অংশ এই হালতি বিলেও এক সময় মাছ কমে যেতে শুরু করে। স্থানীয় হাটবাজারে খোলা পানির দেশি প্রজাতির মাছের আমদানি কমে যায় আশঙ্কাজনকভাবে। জেলেরাও পড়ে যায় অস্তিত্ব সংকটে। এক পর্যায়ে বিলটিকে মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তার সুফলও পেতে শুরু করেছে সবাই।
নাটোর সদর উপজেলার ধুলদহ, কামারদহ মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনসুর রহমান বলেন, ‘এক সময় হালতি বিলে মাছ কমে যাওয়ায় জেলেরা পড়ে বিপাকে। পরে মৎস্য কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করলে তারা হালতি বিলে অভয়াশ্রম গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। সে অনুসারে হালতি বিলের ধুলদহ ও কামারদহে আমরা দুটি অভয়াশ্রম গড়ে তুলি। মাত্র দুই বছরে হালতি বিলে মাছ উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে যায়। বর্তমানে জেলেরা নিয়মিতভাবে অভয়াশ্রম পাহারা দিচ্ছে।’
ত্রিমোহিনী থেকে নৌকায় নদী পথে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে মরা আত্রাই নদীতে ধুলদহ এবং সেখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে কামারদহ অভয়াশ্রম। এ দুটি স্থানে মাছের নিরাপদ বসবাসের লক্ষ্যে ফেলে রাখা হয়েছে গাছের ডাল। পুঁতে দেয়া হয়েছে বাঁশ। জেলেরা নৌকা করে সারাক্ষণ পাহারা দিচ্ছে।
স্থানীয় করেরগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ আলী কথা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এত মাছ গত ৪০ বছরে দেখিনি। এসবই সম্ভব হয়েছে হালতি বিলে অভয়াশ্রম গড়ে তোলায়।’
মৎস্যজীবী বৃন্দাবন দাস জানান, অভয়াশ্রমের কারণে তারা প্রচুর মাছ পাচ্ছেন। ফলে তাদের সংসার চালাতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না।
অনন্ত কুমার চন্দ্র অভিযোগ করেন, মাছ পাওয়া গেলেও মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কারণে তারা অনেক সময় মাছ মারতে পারেন না। প্রভাবশালী মহল নদী দখল করে মাছ মেরে নেয়। এ বিষয়ে প্রশাসনকে জানিয়েও কার্যকর ফল পাওয়া যায় না।
নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘জেলায় বর্তমানে ৩৫ হাজার ৯৮৫ টন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। আর স্থানীয়ভাবে চাহিদা রয়েছে ২৭ হাজার ১৫০ টন। ফলে জেলার চাহিদা মিটিয়েও আট হাজার ৮৩৫ টন মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে।’
নাটোর সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুদ দাইয়ান বলেন, ‘বড় সমস্যা অভয়াশ্রমগুলো পাহারা দিয়ে রাখা। সে কারণে কোথাও কোথাও অভয়াশ্রমের সুফল থেকে জনগণ বঞ্চিত হয়।’