ঢাকা ০৪:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চরাঞ্চলের সংগ্রামী জীবন এবং…

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৪১:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ মার্চ ২০১৬
  • ৩৫৮ বার

ঘাঘট, তিস্তা, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীবেষ্টিত গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে ১৬৫টি চরাঞ্চল আছে। এ সব চরাঞ্চলে দীর্ঘকাল থেকে ৩ লাখ ৮০ হাজার ৪২৭ জনসংখ্যার প্রায় ৭৬ হাজার ৮৫টি পরিবার বাস করছে। তারা সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্র প্রদত্ত নাগরিকদের মৌলিক সেবা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, আশ্রয়সহ জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সব সেবা থেকেই বঞ্চিত। চরাঞ্চলের পলিপড়া উর্বর মাটিতে ধান, পাট, তামাক, সবজি, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, সবজি এবং বালু মাটিতে বাদাম, ডাল ও মিষ্টি আলুর ফলন অনেক বেশি। চরে বসবাসকারী ৬৫ ভাগ পরিবার কৃষিজীবী হলেও অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও বর্গাচাষী।

এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, সদর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন মোল্লার চরের ৬ গ্রামের ২ হাজার ৩৮৮টি পরিবারের মধ্যে ধনী লোকের সংখ্যা মাত্র ২ ভাগ এবং এরাই সিংহভাগ জমির মালিক। ১৮ ভাগ ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষী ও অন্য পেশার মানুষ আর ৮০ ভাগ হচ্ছে কৃষি ও শ্রমজীবী। এই চিত্র সব চরাঞ্চলেই। বন্যা ও নদী ভাঙন চরাঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারগুলোর জীবন-জীবিকার প্রধানতম সমস্যা। প্রতিনিয়তই নদী ভাঙনে আবাদি জমি, গাছপালা হারিয়ে নিঃস্ব ভূমিহীন হচ্ছে কৃষক পরিবারগুলো। বন্যায় বাড়িঘর ভেঙে নিরাশ্রয় হচ্ছে চরের মানুষ। এছাড়া জমিতে বালুর স্তর জমে উর্বরা ফসলী জমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে। কিন্তু এসব সর্বহারা মানুষের সরকারি পর্যায়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই। নদী ভাঙনে দুর্দশাকবলিত এসব পরিবারের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থাও করা হয় না। ফলে চরাঞ্চলের এসব কৃষক পরিবার বাধ্য হয়ে ভিন্ন জেলায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনো রকমে একবেলা আধাপেটা খেয়ে বেঁচে থাকার নিরন্তর প্রয়াস চালাচ্ছে।

এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, এই জেলায় চরাঞ্চলে গত ১০ বছরে প্রায় ৫০ হাজার পরিবার গৃহহারা এবং ৮ হাজার হেক্টর আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে ভূমিহীন হয়েছে ২৫ হাজার পরিবার। এছাড়াও ভাঙনের শিকার কত পরিবার যে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। উল্লেখ্য, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর উপজেলায় এখন ১৫৬টি চর হলেও ১৫ বছর আগেও ছিল মাত্র ৮৬টি। এছাড়া এক দশকে ৭০টি মেইন ল্যান্ডের অনেক গ্রাম নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। আবার তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় জেগে উঠেছে নতুন চর। ৪টি উপজেলার মধ্যে গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি, মোল্লার চর, গিদারি, ঘাগোয়া ইউনিয়ন, সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া, সাঘাটা, ঘুড়িদহ, ভরতখালী ইউনিয়ন, ফুলছড়ি উপজেলার ফুলছড়ি, গজারিয়া, ফজলুপুর এরে-াবাড়ী, উড়িয়া, উদাখালী, কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদী এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাপাসিয়া, চ-িপুর, বেলকা, হরিপুর, তারাপুর ইউনিয়নজুড়েই নদী ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।

নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এসব দুর্গম এলাকায় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং প্রয়োজনীয় ওষুধের দোকান না থাকায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে হঠাৎ করে আক্রান্ত রোগীরা যোগাযোগ সমস্যার কারণে জরুরি চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মারাত্মক জটিলতায় পড়েছে। এছাড়া দরিদ্র রোগীরা অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় অকালেই ধুঁকে ধুঁকে মরছে। নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলভুক্ত ইউনিয়নের গ্রামগুলোর জন্য স্বাস্থ্য ক্লিনিক রয়েছে মাত্র ২টি। এর মধ্যে সদর উপজেলার মোল্লার চরে ১টি এবং অপরটি ফুলছড়ির এরে-াবাড়িতে। তবে এগুলোর অবস্থা আরও করুণ। সেখানে চিকিৎসক বা প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নেই এবং অধিকাংশ সময়ই বন্ধ থাকে। একজন কম্পাউন্ডার মাঝেমধ্যে স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলো খুললেও চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা না থাকায় তা থেকে চরাঞ্চলের মানুষ কোনো উপকৃত হচ্ছে না।

এছাড়া মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। অপুষ্টি এবং শিশু ও গর্ভবতী মৃত্যুর হার আরও বেশি। অসচেতনতার কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার প্রবণতা একেবারেই না থাকায় সম্প্রতি চরের গ্রামগুলোতে শিশু জন্মের হার ক্রমেই বাড়ছে। শিক্ষার অব্যবস্থা এ জেলার চরাঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে জীবনধারণের সার্বিক অগ্রগতি থেকে অনেক পিছিয়ে রেখেছে। নিরক্ষরতার কারণে কুসংস্কার, অসচেতনতা চরাঞ্চলের মানুষদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এসব এলাকায় ৭৬ হাজার শিশুর জন্য উচ্চ ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে মাত্র ৬টি এবং মাদ্রাসা রয়েছে ২টি। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১১৬টি। প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, চরাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ২৯ হাজার ১৫ জন ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া শিখছে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। চরাঞ্চলের ২০ ভাগ শিশু এখনো লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া শিশুদের অধিকাংশই ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার পর আর সুযোগ পাচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে পিতা-মাতার অসচেতনতা, দারিদ্র্য, যোগাযোগের ক্ষেত্রে অব্যবস্থা এবং বিদ্যালয় সংকট।

চরে কোনো কলকারখানা না থাকায় এবং কৃষি সেক্টরেও শ্রমজীবী সারা বছরের কাজ না থাকায় এখানকার ৮০ ভাগ শ্রমজীবী মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশেষ করে চরের দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষকে কাজের সন্ধানে এই জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে হয়। এ জন্য নানা সামাজিক সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে। অভাবের তাড়নায় বউ-ছেলেমেয়ে ফেলে রেখে কাজে গিয়ে আর ঘরে ফেরে না অনেকেই। সেখানেই বিয়ে করে আর একটা সংসার পাতে। আর এদিকে স্বামীহারা গৃহবধূ ছেলেমেয়ে নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটায়। ইদানীং স্বামী পরিত্যক্ত এ ধরনের পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে পিতৃহীন অনাথ শিশু। চরাঞ্চলগুলোতে বাল্য বিয়ে ও বহু বিয়ের প্রবণতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। জানা গেছে, চরাঞ্চলের শতকরা ৯৮ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ৯ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। চরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ এখনো মনে করে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের অবশ্যই বিয়ে দেওয়া উচিত। শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে নয়, চরাঞ্চলের পুত্র সন্তানের অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের কম বয়সে বিয়ে দিচ্ছেন এবং তাদের অল্প বয়সী মেয়েদের পুত্রবধূ করে ঘরে তোলার প্রবণতাও বেশি লক্ষ করা যায়।

উল্লেখ্য, বাল্য বিয়ের প্রবণতা বেশি হওয়ায় জেলায় পারিবারিক পর্যায়ে নারী নির্যাতনও ক্রমে বাড়ছে। এ কারণে নারী নির্যাতন এবং যৌতুক নিয়ে মামলা করার প্রবণতাও বেড়েছে। বাল্য বিয়ের প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধা জেলার পল্লী অঞ্চলে মা ও শিশুদের অপুষ্টি, রক্তস্বল্পতা, আয়োডিন ঘাটতিসহ নানা রোগব্যাধি বাড়ছে। এ কারণেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অর্থাভাবে মা ও শিশুদের সঠিক চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করতে পারছে না বলে প্রসবজনিত মা ও শিশুর মৃত্যু এবং মেয়েদের গড় আয়ুও হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু ও পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা জেলার নদীগুলোতে নাব্য সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বছরে প্রায় ৬ মাসের বেশি সময় নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ায় জেলার চরাঞ্চলগুলো ৩০টি নৌরুটের মধ্যে ১২টিতে শুকনো মৌসুমের ৯ মাসেই নদী পথে নৌ-চলাচল বন্ধ থাকে। ফলে নৌকা-নির্ভর চরাঞ্চলবাসীর যাতায়াতে মারাত্মক দুর্ভোগের কবলে পড়তে হয়। হাঁটা পথে বালু পেরিয়ে এবং কিছু এলাকা নৌকায় এসে দীর্ঘ সময় ব্যয়ে তাদের মেইন ল্যান্ডে পৌঁছতে হয়। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এতে চরম দুর্ভোগের কবলে পড়ে।

চরাঞ্চলে কোনো পুলিশ ফাঁড়ি না থাকায় সেখানে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকে প্রভাবশালী সন্ত্রাসী ও চেয়ারম্যান, মেম্বার, গ্রাম্য টাউট দেওয়ানিদের কাছে। থানা পুলিশও এসব অশুভ চক্রের প্রভাব বলয়ে বন্দি। সুতরাং চরের মানুষ একশ্রেণির সামন্ত প্রভুর খপ্পরে চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিনাতিপাত করে। বর্ষা মৌসুমে নৌ-ডাকাতরা নির্বিঘেœ গরু-ছাগল এমনকি ঘরের চালের টিন পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায় শ্যালো নৌকায়। এত সমস্যা-সংকট সত্ত্বেও নদী যেন মোহবিষ্ট করে আঁকড়ে ধরে রাখে চরের এই পরিশ্রমী মানুষজনকে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

চরাঞ্চলের সংগ্রামী জীবন এবং…

আপডেট টাইম : ০৯:৪১:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ মার্চ ২০১৬

ঘাঘট, তিস্তা, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীবেষ্টিত গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে ১৬৫টি চরাঞ্চল আছে। এ সব চরাঞ্চলে দীর্ঘকাল থেকে ৩ লাখ ৮০ হাজার ৪২৭ জনসংখ্যার প্রায় ৭৬ হাজার ৮৫টি পরিবার বাস করছে। তারা সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্র প্রদত্ত নাগরিকদের মৌলিক সেবা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, আশ্রয়সহ জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সব সেবা থেকেই বঞ্চিত। চরাঞ্চলের পলিপড়া উর্বর মাটিতে ধান, পাট, তামাক, সবজি, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, সবজি এবং বালু মাটিতে বাদাম, ডাল ও মিষ্টি আলুর ফলন অনেক বেশি। চরে বসবাসকারী ৬৫ ভাগ পরিবার কৃষিজীবী হলেও অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও বর্গাচাষী।

এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, সদর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন মোল্লার চরের ৬ গ্রামের ২ হাজার ৩৮৮টি পরিবারের মধ্যে ধনী লোকের সংখ্যা মাত্র ২ ভাগ এবং এরাই সিংহভাগ জমির মালিক। ১৮ ভাগ ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষী ও অন্য পেশার মানুষ আর ৮০ ভাগ হচ্ছে কৃষি ও শ্রমজীবী। এই চিত্র সব চরাঞ্চলেই। বন্যা ও নদী ভাঙন চরাঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারগুলোর জীবন-জীবিকার প্রধানতম সমস্যা। প্রতিনিয়তই নদী ভাঙনে আবাদি জমি, গাছপালা হারিয়ে নিঃস্ব ভূমিহীন হচ্ছে কৃষক পরিবারগুলো। বন্যায় বাড়িঘর ভেঙে নিরাশ্রয় হচ্ছে চরের মানুষ। এছাড়া জমিতে বালুর স্তর জমে উর্বরা ফসলী জমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে। কিন্তু এসব সর্বহারা মানুষের সরকারি পর্যায়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই। নদী ভাঙনে দুর্দশাকবলিত এসব পরিবারের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থাও করা হয় না। ফলে চরাঞ্চলের এসব কৃষক পরিবার বাধ্য হয়ে ভিন্ন জেলায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনো রকমে একবেলা আধাপেটা খেয়ে বেঁচে থাকার নিরন্তর প্রয়াস চালাচ্ছে।

এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, এই জেলায় চরাঞ্চলে গত ১০ বছরে প্রায় ৫০ হাজার পরিবার গৃহহারা এবং ৮ হাজার হেক্টর আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে ভূমিহীন হয়েছে ২৫ হাজার পরিবার। এছাড়াও ভাঙনের শিকার কত পরিবার যে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। উল্লেখ্য, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর উপজেলায় এখন ১৫৬টি চর হলেও ১৫ বছর আগেও ছিল মাত্র ৮৬টি। এছাড়া এক দশকে ৭০টি মেইন ল্যান্ডের অনেক গ্রাম নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। আবার তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় জেগে উঠেছে নতুন চর। ৪টি উপজেলার মধ্যে গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি, মোল্লার চর, গিদারি, ঘাগোয়া ইউনিয়ন, সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া, সাঘাটা, ঘুড়িদহ, ভরতখালী ইউনিয়ন, ফুলছড়ি উপজেলার ফুলছড়ি, গজারিয়া, ফজলুপুর এরে-াবাড়ী, উড়িয়া, উদাখালী, কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদী এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাপাসিয়া, চ-িপুর, বেলকা, হরিপুর, তারাপুর ইউনিয়নজুড়েই নদী ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।

নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এসব দুর্গম এলাকায় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং প্রয়োজনীয় ওষুধের দোকান না থাকায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে হঠাৎ করে আক্রান্ত রোগীরা যোগাযোগ সমস্যার কারণে জরুরি চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মারাত্মক জটিলতায় পড়েছে। এছাড়া দরিদ্র রোগীরা অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় অকালেই ধুঁকে ধুঁকে মরছে। নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলভুক্ত ইউনিয়নের গ্রামগুলোর জন্য স্বাস্থ্য ক্লিনিক রয়েছে মাত্র ২টি। এর মধ্যে সদর উপজেলার মোল্লার চরে ১টি এবং অপরটি ফুলছড়ির এরে-াবাড়িতে। তবে এগুলোর অবস্থা আরও করুণ। সেখানে চিকিৎসক বা প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নেই এবং অধিকাংশ সময়ই বন্ধ থাকে। একজন কম্পাউন্ডার মাঝেমধ্যে স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলো খুললেও চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা না থাকায় তা থেকে চরাঞ্চলের মানুষ কোনো উপকৃত হচ্ছে না।

এছাড়া মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। অপুষ্টি এবং শিশু ও গর্ভবতী মৃত্যুর হার আরও বেশি। অসচেতনতার কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার প্রবণতা একেবারেই না থাকায় সম্প্রতি চরের গ্রামগুলোতে শিশু জন্মের হার ক্রমেই বাড়ছে। শিক্ষার অব্যবস্থা এ জেলার চরাঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে জীবনধারণের সার্বিক অগ্রগতি থেকে অনেক পিছিয়ে রেখেছে। নিরক্ষরতার কারণে কুসংস্কার, অসচেতনতা চরাঞ্চলের মানুষদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এসব এলাকায় ৭৬ হাজার শিশুর জন্য উচ্চ ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে মাত্র ৬টি এবং মাদ্রাসা রয়েছে ২টি। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১১৬টি। প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, চরাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ২৯ হাজার ১৫ জন ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া শিখছে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। চরাঞ্চলের ২০ ভাগ শিশু এখনো লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া শিশুদের অধিকাংশই ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার পর আর সুযোগ পাচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে পিতা-মাতার অসচেতনতা, দারিদ্র্য, যোগাযোগের ক্ষেত্রে অব্যবস্থা এবং বিদ্যালয় সংকট।

চরে কোনো কলকারখানা না থাকায় এবং কৃষি সেক্টরেও শ্রমজীবী সারা বছরের কাজ না থাকায় এখানকার ৮০ ভাগ শ্রমজীবী মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশেষ করে চরের দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষকে কাজের সন্ধানে এই জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে হয়। এ জন্য নানা সামাজিক সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে। অভাবের তাড়নায় বউ-ছেলেমেয়ে ফেলে রেখে কাজে গিয়ে আর ঘরে ফেরে না অনেকেই। সেখানেই বিয়ে করে আর একটা সংসার পাতে। আর এদিকে স্বামীহারা গৃহবধূ ছেলেমেয়ে নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটায়। ইদানীং স্বামী পরিত্যক্ত এ ধরনের পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে পিতৃহীন অনাথ শিশু। চরাঞ্চলগুলোতে বাল্য বিয়ে ও বহু বিয়ের প্রবণতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। জানা গেছে, চরাঞ্চলের শতকরা ৯৮ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ৯ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। চরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ এখনো মনে করে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের অবশ্যই বিয়ে দেওয়া উচিত। শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে নয়, চরাঞ্চলের পুত্র সন্তানের অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের কম বয়সে বিয়ে দিচ্ছেন এবং তাদের অল্প বয়সী মেয়েদের পুত্রবধূ করে ঘরে তোলার প্রবণতাও বেশি লক্ষ করা যায়।

উল্লেখ্য, বাল্য বিয়ের প্রবণতা বেশি হওয়ায় জেলায় পারিবারিক পর্যায়ে নারী নির্যাতনও ক্রমে বাড়ছে। এ কারণে নারী নির্যাতন এবং যৌতুক নিয়ে মামলা করার প্রবণতাও বেড়েছে। বাল্য বিয়ের প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধা জেলার পল্লী অঞ্চলে মা ও শিশুদের অপুষ্টি, রক্তস্বল্পতা, আয়োডিন ঘাটতিসহ নানা রোগব্যাধি বাড়ছে। এ কারণেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অর্থাভাবে মা ও শিশুদের সঠিক চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করতে পারছে না বলে প্রসবজনিত মা ও শিশুর মৃত্যু এবং মেয়েদের গড় আয়ুও হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু ও পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা জেলার নদীগুলোতে নাব্য সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বছরে প্রায় ৬ মাসের বেশি সময় নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ায় জেলার চরাঞ্চলগুলো ৩০টি নৌরুটের মধ্যে ১২টিতে শুকনো মৌসুমের ৯ মাসেই নদী পথে নৌ-চলাচল বন্ধ থাকে। ফলে নৌকা-নির্ভর চরাঞ্চলবাসীর যাতায়াতে মারাত্মক দুর্ভোগের কবলে পড়তে হয়। হাঁটা পথে বালু পেরিয়ে এবং কিছু এলাকা নৌকায় এসে দীর্ঘ সময় ব্যয়ে তাদের মেইন ল্যান্ডে পৌঁছতে হয়। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এতে চরম দুর্ভোগের কবলে পড়ে।

চরাঞ্চলে কোনো পুলিশ ফাঁড়ি না থাকায় সেখানে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকে প্রভাবশালী সন্ত্রাসী ও চেয়ারম্যান, মেম্বার, গ্রাম্য টাউট দেওয়ানিদের কাছে। থানা পুলিশও এসব অশুভ চক্রের প্রভাব বলয়ে বন্দি। সুতরাং চরের মানুষ একশ্রেণির সামন্ত প্রভুর খপ্পরে চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিনাতিপাত করে। বর্ষা মৌসুমে নৌ-ডাকাতরা নির্বিঘেœ গরু-ছাগল এমনকি ঘরের চালের টিন পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায় শ্যালো নৌকায়। এত সমস্যা-সংকট সত্ত্বেও নদী যেন মোহবিষ্ট করে আঁকড়ে ধরে রাখে চরের এই পরিশ্রমী মানুষজনকে।